খাস কলকাতা, কিংবা মফসসলের বহু দেওয়ালই ভরে যেত বি-গ্রেড সিনেমার পোস্টারে। সিনেমাহলের আশপাশেই যে তা পড়ত, তা নয়। শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকত সেই উত্তেজক পোস্টার সিরিজ। ইন্টারনেট আজকের মতো যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে না, তখন এই ছবিগুলোই ছিল বড় হওয়ার সহজপাঠ। উত্তেজক পোস্টারে বি-গ্রেড সিনেমার নায়িকার বক্ষবিভাজিকা বা স্বল্পবাস ঢেকে দেওয়া হত আলকাতরা দিয়ে। কারা ঢাকতেন? কতই বা পারিশ্রমিক পেতেন তাঁরা? কলকাতার সেই হারানো পোস্টার বিচিত্রা নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ।
রোমাঞ্চকর যৌনগন্ধী পোস্টার। শহরের এ-দেওয়াল সে-দেওয়াল। পোস্টারে চাপা উত্তেজনা। সেই নীল-সাদা বা গোলাপি পোস্টারের মোহে বুঁদ থাকত ভাঙা যৌবনের সিঁড়ি। কখন, কোন সিনেমাহলে দুম করে পাওয়া যাবে বড় হওয়ার সিঁড়ি– মুখস্থ রাখত যৌবনকাল। শুধু তথ্য নয়, ছবি থাকত এমন আয়তকার পোস্টারও চোখে পড়ত প্রায়শই। স্বল্পবাস, গভীর বক্ষবিভাজিকা চোখে পড়ে যেত। বেশিরভাগ সময়ই সেসব পোস্টারের রং উজ্জ্বল। কখনও-সখনও সিনেমায় সে দৃশ্য থাকত না। এ নেহাতই দর্শককে হলের দিকে টেনে আনা। আজকের নিউজের ‘ক্লিকবেট’-এর বহু আগেই এমন কাণ্ডকারখানা হত শহরে-মফসসলে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই পোস্টারগুলো দীর্ঘস্থায়ী হত না। পোস্টারের উত্তেজক অংশগুলো ঢেকে যেত আলকাতরার প্রলেপে। লোকচক্ষুর আড়ালে এই বিজ্ঞাপনের বিশেষাংশ কখন যে মুছে ফেলা হত, সে এক অষ্টম আশ্চর্য! তবুও এই পেশার কিছু মানুষ ছিল, যারা সমাজের তথাকথিত ‘শালীনতা’ ঢাকার কাজ করত।
‘বি-গ্রেড’ সিনেমার এই গোছের পোস্টারে যৌনতা, রগরগে দৃশ্য, খোলামেলা নারীশরীর আর উত্তেজক ট্যাগলাইন থাকত চোখে পড়ার মতো। এসব পোস্টার সাঁটানো হত ভোরের আগে, আবার অদ্ভুতভাবে কিছুদিন পরই সেগুলো গায়েব! আলকাতরা বা কালি লেপে দেওয়া হত দেওয়ালের সেই জায়গায়। সাতের দশক থেকে ২০০০-এর শুরু পর্যন্ত ভারতের বিশেষ করে শহরাঞ্চলের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহলের রাজত্ব। সস্তা বাজেটের ‘বি-গ্রেড’ সিনেমাগুলো অনেকটা শহরের প্রান্তিক, শ্রমজীবী পুরুষদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এই ছবিগুলোর প্রধান আকর্ষণ ছিল যৌনতা, সাসপেন্স আর ভয়। ‘ডান্স বার’, ‘রাত কি বাহোঁ মে’, ‘গরম রাত’, ‘হান্টার ওয়ালি’, ‘রাতের রাণী’র মতো নামেই বোঝা যায়– কী ছিল এই ছবির আসল ‘ইউএসপি’। ‘রথিনিরভেদম’-এর মতো মলায়ালাম ছবি কলকাতার বুকে মেট্রো সিনেমাতে টানা ৫০ দিন হাউসফুল ছিল। ভিড় ম্যানেজ করতে হয়েছিল পুলিশ দিয়ে!
এই ছবিগুলোর প্রধান হাতিয়ারই ছিল পোস্টার। কখনও বম্বে থেকে ছাপানো, কখনও-বা স্থানীয় শিল্পীর আঁকা পোস্টার। মহিলাদের শরীরী বিভঙ্গ, উত্তেজক ভঙ্গি, নগ্নতা কিংবা রগরগে সংলাপ যুক্ত থাকত। মূলত পুরুষ দর্শকের মনোযোগ পাওয়ার জন্য তৈরি এই পোস্টারগুলি হয়ে উঠেছিল শহরের ‘ওভার গ্রাউন্ড পর্নোগ্রাফি’।
বি-গ্রেড সিনেমাগুলির ক্ষেত্রে, যেগুলির বিষয়বস্তু মূলত যৌন উত্তেজনামূলক বা হরর-সেক্স সংমিশ্রণে তৈরি, সেগুলির পোস্টার সাধারণত রাতের বেলা শহরের ফাঁকা দেওয়াল বা রেললাইন ঘেঁষা এলাকায় লাগানো হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি লাগানো হত সরকারি নিয়ম না-মেনে। আটের দশকের শেষে এল পোস্টারে সেন্সরশিপ। অর্থাৎ ছবির পোস্টারে কী থাকবে– তা অগ্রিম দেখিয়ে নিতে হবে। পোস্টারে মহিলাদের পোশাক, ক্লিভেজের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের সতর্কতা দেখা গেল। সেন্সরে ঠিক করে দেওয়া অংশে কালো কালি লাগানোর বিধিনিষেধও এল। তবে কার্যক্ষেত্রে কালোর বদলে লাল কালি লাগানো হত প্রায়শই। উদ্দেশ্য: ছবির অংশটি যাতে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পোস্টার লাগানোর কাজে নিযুক্ত থাকতেন দিনমজুর শ্রেণির কিছু মানুষ। রাতে বের হতেন দল বেঁধে। এঁরা অনেকেই বাস করতেন শহরের প্রান্তিক অঞ্চলে। ছিলেন অভিবাসী শ্রমিকও। অনেক সময়ই এই পোস্টার লাগানোই ছিল তাঁদের একমাত্র জীবিকা। কেউ কেউ অস্থায়ী কাজের পাশাপাশিও চালাতেন পোস্টার সাঁটার কাজ। দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক বা ফুটপাতের হকার– প্রয়োজন ও সুবিধার ভিত্তিতে এই কাজ করতেন অতিরিক্ত আয়ের আশায়। পিঠে আঠা-ভর্তি বালতি, হাতে ব্রাশ বা ঝাঁটা, কাঁধে বাঁধা পোস্টারের রোল। কাজটা নির্দিষ্ট রুট ধরে হত– যেমন কলেজস্ট্রিট, শিয়ালদহ, টালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার– এমন এমন জায়গায় যেখানে সাধারণ মানুষের চলাচল বেশি, অথচ রাত হলে অন্ধকারে ঢেকে যায়। প্রতিটি পোস্টার লাগানোর জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হত দৈনিক ভিত্তিতে। নয়ের দশকে এক একজন পোস্টার লাগানো শ্রমিক পেতেন গড়ে ২০-৩০ টাকা দৈনিক, পরে তা ৫০-৭০ টাকায় পৌঁছয়। এক রাতে একশো পোস্টার লাগাতে হবে– এমনও নির্দেশ থাকত। আপত্তিকর পোস্টার পুলিশের চোখে পড়ার ভয় থাকত, তাই তাঁদের বেশি টাকা দেওয়া হত। ঝুঁকির কারণে খাবার বা সুরার ব্যবস্থাও রাখা হত। এইসব শ্রমিকের কাছে কেউ পোস্টারের ছবি নিয়ে প্রশ্ন করলে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিতেন। কাজের স্বীকৃতি ছিল না, পেশাকেও কখনও গণ্য করা হয়নি। অথচ শহরের যৌনচেতনা, গোপন আকর্ষণ এবং বেদৃশ্য ফ্যান্টাসির এই পোস্টার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এঁদের ভূমিকা অপরিসীম।
ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডডেশনও কিছু পুরনো প্রিন্ট-ভিডিও সাক্ষাৎকার ঘেঁটে দেখা যায়, অনেক পোস্টার লাগানো শ্রমিক এই কাজকে কেবল পেটের উপার্জন নয় বরং এক ধরনের শিল্প বলেই ভাবতেন। রাতের অন্ধকারে বা ভোররাতে তাঁরা পোস্টার হাতে বের হতেন তখন তাঁরা যেন হয়ে উঠতেন এক গোপন সাংস্কৃতিক বাহক। একজন প্রবীণ পোস্টার সাঁটানো শ্রমিকের কথায়, ‘ছবির নাম জানতাম না, কিন্তু কোন সিনেমার পোস্টার লোকে বেশি দেখে, সেটা বুঝতাম চোখে চোখে। কোথায় কী রঙে চোখ আটকে যায়, কোথায় দাঁড়িয়ে দুজন ফিসফিস করে দেখে– এসব দেখে বুঝে যেতাম কোন ছবি চলবে, আর কোনটা নামবে।’ এটা ছিল তাঁদের নিঃশব্দ পাঠশালা। তাঁরা জানতেন কোন অভিনেত্রীর মুখ মাঝখানে রাখতে হবে, কোন রঙে মানুষ থমকে দাঁড়ায়, আর কোন ভঙ্গিতে নায়ককে রাখলে সেই পোস্টার পাড়ার দেওয়ালে দাঁড়িয়ে থাকে এক সপ্তাহ। পোস্টার লাগানোর এই সূক্ষ্ম চর্চা ছিল তাঁদের না-বলা অভিজ্ঞতার ফল। তাঁদের ছিল না প্রচারের আলোকসজ্জা, ছিল না সিনেমা জগতের বাহারি গ্ল্যামার। কিন্তু শহরের অলিগলিতে সিনেমার গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার যে দায়, তা চুপিচুপি তুলে নিয়েছিলেন তাঁরাই। তাঁদের হাতের আঠা-ভেজা আঙুলে লেগে থাকত সিনেমার উত্তেজনা, প্রেম, রহস্য আর যৌনতাও।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ২৯২ ও ২৯৩ ধারা অনুযায়ী অশ্লীলতা প্রচার এবং জনসমক্ষে অশ্লীল উপাদান বিতরণ, প্রদর্শন বা বিক্রির জন্য শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন রাজ্যের ‘ডিফেসমেন্ট অফ প্রপার্টি অ্যাক্ট’ (Defacement of Property Act), যেমন পশ্চিমবঙ্গে ‘ওয়েস্টবেঙ্গল প্রিভেনশন অফ ডিফেসমেন্ট অফ ডিফেসমেন্ট অফ প্রপার্টি অ্যাক্ট, ১৯৭৬’ (West Bengal Prevention of Defacement of Property Act, ১৯৭৬) যা সরকার অনুমোদিত না হলে কোনও সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তির গায়ে পোস্টার লাগানোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। এই আইনের আওতায় বহুবার শহর জুড়ে অভিযান চালানো হয়েছে, বিশেষত সেইসব পোস্টার যারা যৌন আবেদনকে মূল পুঁজি করে দর্শক টানত। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া পোস্টার লাগানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবুও, ফিল্ম প্রোমোশন সংস্থাগুলি রাতে বা ভোরবেলা লোকচক্ষুর আড়ালে সেই দেওয়াল ভরিয়ে দিত একের পর এক পোস্টার। কিন্তু এসব পোস্টার যেমন হঠাৎ আসে, তেমনই দ্রুত চলে যেত। কখনও প্রশাসনের নির্দেশে, কখনও রাজনৈতিক দল বা সমাজকর্মীদের চাপেই– এসব চিত্র মোছা হত আলকাতরায়। সেই মুছে ফেলার শ্রমিকরাই হয়ে উঠতেন শহরের নীরব নিয়ন্ত্রক– যাঁরা যৌনতার আবরণ ঢেকে দিতেন আইনের পর্দায়। পোস্টার মুছে ফেলার কাজটা ছিল পৌরসভা নিযুক্ত কিছু কর্মীর, অনেক সময় অস্থায়ী শ্রমিকরাও এই কাজে লাগতেন। এঁদের অনেকেই জানতেন না, কোন সিনেমা চলেছে, কিংবা কেনই বা তাঁদের ঢাকতে বলা হচ্ছে। তাঁরা কাজ করতেন রাতের শেষে বা ভোরের আগে– যেন কেউ দেখে না। তাঁদের দেওয়া হত আলকাতরা, ঝাঁটা, চুন, খালি হাতে কালি মাখিয়ে দেওয়ার নির্দেশ। এই শ্রমিকরা ছিলেন একপ্রকার পৌরসভা নিয়োজিত ‘নৈতিক পুলিশ’।
বর্তমানে এই পেশার মানুষরা হারিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে দেওয়ালে পোস্টার সাঁটার চল প্রায় উঠে গিয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমের দৌলতে পোস্টার এখন মুঠোফোনে বন্দি। যদিও লোকাল ট্রেনে বা লাইটপোস্টের গায়ে এখনও দু’-একটা যৌনগন্ধী পোস্টার, বন্ধুত্ব পাতানোর আহ্বান, ফুল বডি মাসাজের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তবে সেগুলি খুবই সামান্য। এই শহরের পোস্টার বয়রা এখন বিলুপ্তির পথে। তাঁদের পেশা এবং সেই পেশাকে আদৌও পেশার তালিকায় ধরা যাবে কি না, সেই নিয়ে আগেও যেমন সংশয় ছিল, এখনও তাই আছে। সারা কলকাতায় এখন হাতে গুনে দু’-একটি এজেন্সি পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে। তাঁদের সঙ্গে পোস্টার সাঁটার কাজ করে অনিমিয়ত কিছু শ্রমিক। যাদের দৈনিক পারিশ্রমিক ৫০০ টাকার আশপাশে। তবে সেগুলো মূলধর্মী সিনেমার পোস্টার। এখন মুঠোফোনের দৌলতে বি-গ্রেড ছবি অনায়াসে দেখা যায়। আলাদা করে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয় না। যাঁরা রাতের অন্ধকারে শহরের শালীনতা ঢাকার কাজ করতেন তাঁরা এখন রাতের অন্ধকারে মিশে গিয়ে দিকশূন্যপুরে।
তথ্যসূত্র: গৌতম বরাট
বিশেষ ধন্যবাদ: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, কৌশিক লাহিড়ী
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved