একটা সময় সারা পৃথিবীতেই ‘বাঁ’ শব্দটি ছিল অশুভের ইঙ্গিত। লাতিন ভাষায় ‘বাঁ দিক’ শব্দ থেকে ইংরাজিতে ‘সিনিস্টার’ শব্দটি এসেছে যার অর্থ ‘দুষ্ট’ বা ‘অমঙ্গলজনক’। আবার ফরাসি শব্দ ‘গশ’ (gauche) মানে বাম, যা ‘উদ্ভট’, ‘অপরিচ্ছন্ন’ বা ‘অশুদ্ধ’-এর সমার্থক। বাঁ-হাতি কাজকে স্যাটানিক বা শয়তানের কাজ বলে মনে করা হত। এমনকী বাইবেল অনুসারে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপকরাই শুধু ঈশ্বরের ডান দিকে বসার সুযোগ পেতেন। অর্থাৎ বাঁ-হাতিরা যে সমাজে সম্মানজনক অবস্থায় ছিলেন না তা অনুমান করাই যায়। ইতিহাস তার সাক্ষী।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আপনার ক্লাসে যে ছেলে বা মেয়েটি বাঁ হাতে লিখত তার প্রতি একটু বাড়তি কৌতূহল হত না? যেন বারবার চোখ চলে যায় বাঁ-হাতি লিখিয়েদের দিকে। বেশ লাগে। ওরা একটু আলাদা। আমরা সবাই হয়তো দু’-একবার চেষ্টা করে দেখেছি বাঁ হাতে লিখতে পারি কি না! না, সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার, পেন কিছুতেই বাঁ হাতের বশ হয় না। অতএব যা হবার তাই– তিড়িং বিড়িং অক্ষর। অথচ কী অনায়াসে লিখে যেতে থাকে বাঁ-হাতিরা। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কি, ডান-হাতি দুনিয়ায় বাঁ-হাতিরা কেমন আছেন! এ পৃথিবীর সব কিছুই ডান-হাতিদের জন্যে গড়া। বাঁ-হাতিরা নেহাতই সংখ্যালঘু। এক উল্টো জগতের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে নিত্য আপস করে চলেন ওঁরা। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বাঁ-হাতি। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে নিজেদের সমস্যা ও অসুবিধাগুলো তুলে ধরতেই ইংল্যান্ডের ডিন ক্যাম্পবেলের উদ্যোগে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৩ আগস্ট দিনটিকে পালন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল লেফ্ট-হ্যান্ডার্স ডে’ হিসেবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন মাতৃগর্ভেই নির্ধারিত হয়ে যায় একটি শিশু বাঁ-হাতি হবে না ডান-হাতি। যারা ডান হাতে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে ‘ভাষা’-সংক্রান্ত প্রসেসিং মস্তিষ্কের বাঁ দিকের অংশে হয়। আর বাঁ-হাতিদের ক্ষেত্রে তা হয় মস্তিষ্কের উভয় দিক জুড়েই। তাই ভাষার ক্ষেত্রে বাঁ-হাতিরা ডান-হাতিদের চেয়ে বেশি দক্ষ হতেই পারেন। গবেষকরা বলেন, মস্তিষ্কের বাঁ দিক ও ডান দিকের মধ্যে সমন্বয় বাঁ-হাতিদের ক্ষেত্রে বেশি ভালো। তাই বিভিন্নরকম খেলায় বাঁ-হাতিরা একটু বেশি সুবিধেজনক জায়গায় থাকেন। একইসঙ্গে একাধিক বিষয় মাথায় রেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ করতে বাঁ-হাতিদের সুবিধে হয়। তাই হয়তো আমরা এত বেশি বাঁ-হাতি খেলোয়াড় দেখি। সাধারণভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। কিন্তু বাঁ-হাতিরা বৃদ্ধ বয়সে ডান-হাতিদের থেকে মানসিকভাবে বেশি সক্ষম থাকেন। তার কারণও মস্তিষ্কের দুই হেমিস্ফিয়ারের দ্রুত সমন্বয়। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রফেসর, মনস্তত্ত্ববিদ ড. স্ট্যানলি কোরেন তাঁর ‘দ্য লেফ্ট-হ্যান্ডার সিন্ড্রোম’ বইতে বলছেন বাঁ-হাতিরা রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শুধু তাই নয়, গড়পড়তা মানুষের চেয়ে এঁরা অনেক বেশি সৃজনশীল। হ্যাঁ, সেটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
যদিও পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ বাঁ-হাতি, তবু বিশ্বের নামজাদা মানুষদের তালিকায় বাঁ-হাতিদের বেশ আধিপত্য। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চি থেকে শুরু করে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, আলেকজান্ডার, ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স চার্লস– কে নেই সেই বাঁ-হাতির তালিকায়! হেলেন কেলার, মেরি কুরি, আইনস্টাইন, হেনরি ফোর্ড, এডউইন অলড্রিন– এঁরা সবাই বাঁ-হাতির দলে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বাঁ-হাতিদের এক অদ্ভুত পরম্পরা। রোনাল্ড রেগন, জর্জ বুশ, বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামা সকলেই বাঁ-হাতি। এমনকি ওবামা যাঁকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হলেন সেই জন ম্যাককেইনও বাঁ-হাতি। বিল ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রস পেরট এবং বব ডোলকে হারিয়ে। ঘটনাচক্রে এঁরা সবাই বাঁ-হাতি। আপনি যদি বাঁ-হাতি হন আর একটু রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তরসূরি হওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। খেলার জগতেও বাঁ-হাতিরা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়ান। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা থেকে জন ম্যাকেনরো, রাফায়েল নাদাল, রোমারিও। এই তালিকা বেশ লম্বা। তবে বাঁ-হাতিরা যে কেবল বিখ্যাতই হন তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কুখ্যাতদের তালিকা আরও দীর্ঘ। সে না হয় পরে কখনও দেওয়া যাবে।
আজ আপনার পাশে বসে কেউ বাঁ হাতে লিখলে ব্যাপারটা কখনওই আপনার অশুভ বলে মনে হয় না। কিন্তু একটা সময় সারা পৃথিবীতেই ‘বাঁ’ শব্দটি ছিল অশুভের ইঙ্গিত। লাতিন ভাষায় ‘বাঁ দিক’ শব্দ থেকে ইংরাজিতে ‘সিনিস্টার’ শব্দটি এসেছে যার অর্থ ‘দুষ্ট’ বা ‘অমঙ্গলজনক’। আবার ফরাসি শব্দ ‘গশ’ (gauche) মানে বাম, যা ‘উদ্ভট’, ‘অপরিচ্ছন্ন’ বা ‘অশুদ্ধ’-এর সমার্থক। বাঁ-হাতি কাজকে স্যাটানিক বা শয়তানের কাজ বলে মনে করা হত। এমনকী বাইবেল অনুসারে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপকরাই শুধু ঈশ্বরের ডান দিকে বসার সুযোগ পেতেন। অর্থাৎ বাঁ-হাতিরা যে সমাজে সম্মানজনক অবস্থায় ছিলেন না তা অনুমান করাই যায়। ইতিহাস তার সাক্ষী।
দিন পাল্টেছে। বাঁ-হাতিদের আজ হয়তো কেউ অমঙ্গলের ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করেন না। তবু ব্যাপারটাকে যে সবাই পুরোপুরি মেনে নিতে পারেন তা-ও নয়। ভারতীয় সংস্কারে বাঁ হাতে পুজো দেওয়া শাস্ত্রবিরোধী। বাঁ-হাতি মেয়েকে ঘরের বৌ করে আনতেও দ্বিধাগ্রস্ত ভারতীয় সমাজের এক বড় অংশ। এ দ্বিধা যে শুধু তথাকথিত অনুন্নত সমাজের মধ্যে, তা কিন্তু নয়। শিক্ষিত ও সংস্কৃতি সচেতন শহুরে মানুষের মধ্যেও ডান-হাতি পক্ষপাত যথেষ্ট রকম দেখা যায়। অনেকের ধারণা ছোট বেলায় বাঁ-হাতের অভ্যাসটা জোর করে পাল্টে দিলেই সে আর পাঁচজনের মতো হয়ে যাবে। এমনকী বাঁ-হাতি শিশুদের বাঁ হাত বেঁধে রেখে ডান হাতের অভ্যাস করান অনেক মা-বাবা।
জোর করে বাঁ-হাতি শিশুকে ডান হাতে কাজ করালে হয়তো অভিভাবকদের আপাত স্বস্তি ঘটে কিন্তু তার ফল ভুগতে হয় শিশুটিকেই। তাকে তার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাস ছেড়ে কৃত্রিমতার তালিম নিতে হয়। এতে শিশুটির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্য দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর থেকে শিশুটির বাক-শক্তি জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে, তোতলামি হতে পারে। অস্কার জয়ী সিনেমা ‘দ্য কিংস স্পিচ’ দেখিয়েছে ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্ট্যামারিং বা তোতলামির সমস্যার কারণ তাঁকে ছোটবেলায় জোর করে ডান-হাতি করে দেওয়া। এরকম শিশুরা প্রচণ্ড রাগী ও জেদি হয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নেতিবাদিতা এবং একাকিত্বের ভাব তার সুস্থ জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও বিভিন্নরকম স্নায়বিক সমস্যা, অ্যালার্জি, কিছু কিছু খাবার এবং ওষুধের প্রতিক্রিয়া– এরকম হরেক সমস্যার জন্ম দিতে পারে জোর করে বাঁ-হাতের অভ্যাস বদল। শুধু তাই নয়, চোখ, কান, মস্তিষ্ক ও হাতের সমন্বয়ের সমস্যা দেখা দেওয়াও খুব স্বাভাবিক। ফলে শিশুদের সহজাত গুণগুলি প্রকাশে বাধা পায়। আসলে আমরা ব্যতিক্রমটুকু মেনে নিতে পারি না। জৈবিক গঠনের ওপর যে জবরদস্তি চলে না, সেটা আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই।
যে কাঁচিটা আপনি বাড়িতে ব্যবহার করেন সেটা একবার বাঁ হাতে চালিয়ে দেখুন তো। কিছুই কাটতে পারবেন না। কারণ কাঁচিটা ডান-হাতি মানুষদের জন্যই ডিজাইন করা। অর্থাৎ একজন বাঁ-হাতি মানুষকে সামান্য একটা কাঁচি চালাতে কত কসরত করতে হয় একবার ভাবুন। শুধু কাঁচি নয়, এ দুনিয়ার সব কিছুই ডান-হাতি মানুষদের ব্যবহারের কথা ভেবে তৈরি। আজকাল অনেক জায়গায় চেয়ারের সঙ্গে জোড়া থাকে একটি ডেস্ক, যার ওপর খাতা রেখে আপনি স্বচ্ছন্দে লিখতে পারেন। খেয়াল করবেন, সেগুলো বেশিরভাগই চেয়ারের ডান দিকের হাতলের সঙ্গে জোড়া এবং তা বাঁ-দিক পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। বাঁ-হাতিরা এমন ডেস্কে বসে লিখতে গেলে ভারি সমস্যায় পড়েন। হাত রাখার জায়গা পান না। আবার খাতায় লেখার সময় কালি শুকোনোর আগেই হাতের ঘষা লেগে লেখা ঝাপসা হয়ে যাওয়ার সমস্যা হয় অনেক বাঁ-হাতির। আর যদি কোনও স্পাইরাল বাইন্ডিং করা খাতা হয়, তবে তো লিখতে গেলে তার হাত প্রতিবার স্পাইরাল স্প্রিং-এ ঘষা খায়। বোতলের ছিপি, পেনসিল শার্পনার, স্কেল, হাতঘড়ি, সবজির খোসা ছাড়ানোর পিলার– সবই ডান হাতে ব্যবহারের জন্য। তাই বাঁ-হাতি সংখ্যালঘুদের সব ব্যাপারে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই চালাতে হয়। সে লড়াই নিজেদের সঙ্গে লড়াই। স্বয়ং বিল গেটস বাঁ-হাতি হওয়া সত্ত্বেও বাঁ-হাতি কম্পিউটার কী-বোর্ড বা মাউস পেতে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সমস্ত বাদ্যযন্ত্রও তো ডান-হাতিদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। ক্যামেরা থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার, হকি স্টিক থেকে হারমোনিয়াম সব কিছুতেই বাঁ-হাতিদের আপস করতে হয়। সুখের কথা, এখন বাঁ-হাতিদের ব্যবহারোপযোগী বহু জিনিস তৈরি হচ্ছে। যদিও সেগুলো কতটা সহজলভ্য তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ সেই বাজারটা যে বড্ড ছোট। বাঁ-হাতি ভুক্তভোগীরা এখন সংগঠিত হয়ে নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই খুঁজছেন। ১৯৯০-এ ডিন ক্যাম্পবেল ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন ‘লেফ্ট হ্যান্ডার্স ক্লাব’। বিভিন্ন দেশেই গড়ে উঠেছে এরকম সংগঠন। ভারতেও আছে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর লেফ্ট হ্যান্ডেড পিপল’ এবং ‘লেফ্ট হ্যান্ডার্স ক্লাব’-এর মতো বেশ কিছু সংস্থা।
পৃথিবীর প্রথম ‘বাঁ-হাতি মিউজিয়াম’ গড়ে তুলেছে গোয়ার ‘লেফ্ট হ্যান্ডার্স ক্লাব’। সেখানে দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত বাঁ-হাতি মানুষের মূর্তি সাজিয়ে রাখা আছে। গান্ধিজি থেকে মাদার টেরিজা, অমিতাভ বচ্চন থেকে মাইকেল জ্যাকসন, আশা ভোঁসলে থেকে জুলিয়া রবার্টস, রতন টাটা থেকে স্টিভ জোবস– সবাইকে পাবেন এই মিউজিয়াম গ্যালারিতে। কিন্তু বাঁ-হাতিরা তো শুধু মিউজিয়ামের দর্শনীয় বিষয় নন। তাঁরা বাস্তব চরিত্র। তাঁদের সমস্যাগুলোর প্রতি আমাদের আরও সংবেদনশীল হতে হবে। বাঁ-হাতি শিশুরা যাতে বাঁ-হাতি হয়েই বড় হতে পারে– আসুন সেই সচেতনতার প্রসারে হাত লাগাই। বাঁ-হাতিদের রোজকার দিনযাপনকে কেমন করে আরও সহজ করে তোলা যায় সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা জরুরি। আমাদের দরকারি সব জিনিসপত্রের ডিজাইনের কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন হয়তো বাঁ-হাতি বন্ধুদের অনেক বড় সমস্যার সুরাহা করে দেবে। বাঁ-হাতি বন্ধুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে আগেই বাড়িয়ে দিন আপনার বাঁ-হাতটি। আসুন, ‘বাম-বান্ধব’ সমাজ গড়ে তোলার আয়োজন শুরু করি; দেখাই সত্যিকারের ‘বাঁয়ে হাত কা খেল’!