তামিলনাড়ুর ভাডামুঙ্গম ভেল্লোডে পাখিরালয় থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরোড জেলা। এই জেলার মোট ৭টি গ্রামের বাসিন্দারা দীপাবলি পালন করেন কোনও রকম বাজি না ফাটিয়েই। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির ঠিকানা হয়ে ওঠে এই পাখিরালয়। ভিনদেশি পাখিদের আনাগোনা শুরু হয় এই অক্টোবর-নভেম্বরের মাঝামাঝি। তারপর অন্তত দু’-তিন মাস ওই পাখিরালয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটায় তারা। মূলত বংশবৃদ্ধির জন্যই তাদের আগমন। তাই সেই কাজে পাখিদের যেন এতটুকু অসুবিধা না হয়, সে খেয়াল রাখেন পাখিরালয় কর্তৃপক্ষ।
নিঃশব্দর বিপরীত শব্দ কী? সশব্দ? তা ঠিক, কিন্তু এই পুজোর বাজারে কেউ যদি উত্তরে বলে দীপাবলি, তার ভুল ধরার কোনও মানে নেই। বঙ্গে এ ক’দিন ধরে যা শব্দের দাপট! সে ডিজে বাজিয়ে বিসর্জন হোক, কিংবা শব্দবাজির। ব্যাপারটা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শব্দ ছাড়া কালীপুজো কিংবা দীপাবলি– ভাবাই যায় না! উৎসবের আনন্দ আলো আর শব্দে যেন ভাগ হয়ে গিয়েছে। এরই পিছু পিছু এসে দাঁড়িয়েছে দূষণ। ওয়েদার অ্যাপ খুলুন, দেখাবে– আবহাওয়া ভারি অ্যালার্মিং! কার তাতে কী! এ-ও তো আমাদের ঐতিহ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা দূষণ না করলে ইতিহাস যেন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে! ব্যাপারটা খানিকটা দোল বা হোলির মতোই। কেউ পছন্দ করুক না করুক, ‘বুরা না মানো’ বললেই কেল্লাফতে! যত খুশি রং মাখাও। কালীপুজোতেও মাঝরাস্তায় নিষিদ্ধ শব্দবাজি নিয়ে ওত পেতে অপেক্ষা করে কেউ কেউ। গাড়ি এলেই দুম ফটাস! গালমন্দ করতে করতে কাঁপা হাতে বাইক নিয়ে এগিয়ে যাবেন চালক। উল্লাসে ফেটে পড়বে ছেলে-ছোকরার দল! বৃদ্ধাবাসের সামনেই দাপট দেখাতে হবে, যৌবনের রক্ত টগবগ করছে বলে কথা! আড়ালে আরও, আরও, আরও গুটিয়ে যাবে কয়েকটি চারপেয়ে। লেজে বেঁধে দেওয়া কালীপটকা। এ দৃশ্য তো সকলেরই চেনা। ভয়, আতঙ্কে গোটা রাতটা কাটাতে হবে। কেউ কেউ মারাও যাবেন। সেসব টেরও পাবে না কেউ।
শব্দবাজির দৌরাত্ম্য রুখতে প্রশাসন বিভিন্ন ব্যবস্থা করেছে। তাতে লাভের লাভ হয়নি। কারণ সরষের মধ্যেই ভূত। সেক্ষেত্রে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। তাই প্রশাসনের ভরসা করতে চাননি দেশের কয়েকটি গ্রামের মানুষজন। এঁরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দীপাবলিতে নিঃশব্দ থাকবে গ্রাম। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই মেনে আসছেন তাঁরা। নেপথ্যে রয়েছে একদল অবলা। পরিযায়ী পাখি। যারা দেশে আসে নিশ্চিন্তে সময় কাটানোর জন্য। পাছে শব্দে সেই শান্তির ব্যাঘাত ঘটে, তাই এইসব গ্রামে দীপাবলি নিঃশব্দ। আলোর উৎসবে গোটা গ্রাম আলো দিয়ে সাজানোই তাঁদের প্রথম পছন্দ।
বলছি তামিলনাড়ুর ভাডামুঙ্গম ভেল্লোডে পাখিরালয়( Vellode Bird Sanctuary) সম্পর্কে। সেখান থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরোড জেলা। এই জেলার মোট ৭টি গ্রামের বাসিন্দারা দীপাবলি পালন করেন এভাবেই। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির ঠিকানা হয়ে ওঠে এই পাখিরালয়। ভিনদেশি পাখিদের আনাগোনা শুরু হয় এই অক্টোবর-নভেম্বরের মাঝামাঝি। তারপর অন্তত দু’-তিন মাস ওই পাখিরালয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটায় তারা। মূলত বংশবৃদ্ধির জন্যই তাদের আগমন। তাই সেই কাজে পাখিদের যেন এতটুকু অসুবিধা না হয়, সে খেয়াল রাখেন পাখিরালয় কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে পাখিদের ভালোমন্দের কথা ভাবেন স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দারাও।
৭টি গ্রাম মিলিয়ে কমবেশি ৯০০ জনের বাস ওই অঞ্চলে। শুধু শব্দবাজি নয়, এঁরা কোনও বাজিই পোড়ান না। কারণ বাজি পোড়ালেই দূষণের আশঙ্কা থাকে। যা রীতিমতো সমস্যার কারণ হতে পারে ওই ভিনদেশি পাখিদের জন্য। এই নিয়ম আজকের নয়। বিগত দু’-দশক ধরে আলোর উৎসব স্রেফ আলো জ্বালিয়েই উদযাপন করে আসছেন তাঁরা। কথায় আছে– অতিথি দেবো ভব। আমাদের দেশে অনেকেই এমনটা মেনে চলেন। ঠিকমতো অতিথি-আপ্যায়ন ভারতীয় সংস্কারের অংশ। এক্ষেত্রেও তেমনটাই মেনে চলা হয়। হোক না পাখি, তবু সে তো অতিথি হয়েই এসেছে। তাই তার এতটুকু ক্ষতি করতে নারাজ এখানকার বাসিন্দারা।
ভাবতে অবাক লাগে, এমন নজির দেখা মেলে এই দেশেই। যেখানে দীপাবলির পর রাজধানীর দূষণের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়, সেই দেশে নিঃশব্দ দীপাবলি মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখার মতো শব্দবন্ধ। তবু কেউ তো পেরেছে। বলা ভালো, বহুদিন আগেই পেরেছিল। খুব যে কঠিন, তা নয়। বদল প্রয়োজন স্রেফ মানসিকতার। শুধু দীপাবলি নয়, আরও অনেক উৎসবেই অবলা পশুদের উপর অত্যাচার চলে। দোলের সময় কুকুরের গায়ে রং লাগিয়ে নিজেকে মহান কিছু ভেবে বসেন অনেকে। আবার বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি ওড়ানোর এমন ধুম জমে, তাতে কত পাখির ডানা কাটা পড়ল সেই হুঁশ থাকে না। এভাবেই আরও কত কিছু রয়েছে। সবকিছু সবাই হিসাবের মধ্যেও ধরেন না। ওদের আদালত নেই, ওদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই, তাই অত্যাচার সহ্য করাই ওদের ধর্ম। এমনটাই যেন ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এগিয়ে আসেন, ওদের হয়ে লড়াই করেন, তাতে কটাক্ষ ছাড়া কিছুই জোটে না। তাই কখনও সমাধান হয়, কখনও হয় না। আড়ালে থেকে যায় দক্ষিণের এই গ্রামগুলি। নিঃশব্দে কারও নিষেধ ছাড়াই প্রকৃতিকে আগলে রাখছেন এঁরা। নিঃশব্দ দীপাবলিই এঁদের কাছে স্বাভাবিক।
কারণ দুম ফটাসের চেয়ে ঢের ভালো ভোরবেলা পাখির ডাক।