
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় বারবার করে এসেছে মিষ্টির প্রসঙ্গ। শুধু অলস, অকেজো ‘প্রপস’ হিসেবে নয়, কখনও নিবিড় বাঙালিয়ানায়, কখনও সিনেমার দিক নির্ধারণ করেছে। সেই মিষ্টি কখনও দোকানের, কখনও ময়রাকে অর্ডার দিয়ে বানানো, কখনও-বা বঙ্গের বাইরেরও। ১৯৯২ সালে অস্কারের খবর নিশ্চিতভাবে জানার পর সত্যজিৎকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এমন গর্বের মুহূর্ত কী খেয়ে উদযাপন করতে ইচ্ছে হচ্ছে? সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘নলেন গুড়ের সন্দেশ।’
‘তোপসে, সন্দেশটা খেয়ে নে, ট্রেন লেট যাচ্ছে…’, মিষ্টির বাক্সটা নিজের স্যাটেলাইটের হাতে তুলে দিতে দিতে নির্দেশ ফেলুদার। কোন ফিল্মের দৃশ্য? বাঙালিকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, একশো-র মধ্যে দু’শো জনই হয়তো সঠিক উত্তর দেবেন। কিন্তু প্রশ্নটা যদি ঘুরিয়ে করা হয়: ‘আচ্ছা, ওই মিষ্টির বাক্সটা কোন দোকানের ছিল?’ তা হলে হয়তো ধন্ধে পড়বেন অনেকেই। অথচ সমাধান যে ছবিতেই জ্বলজ্বলিং! হে পাঠক, ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) ইউটিউবে চালিয়ে এই দৃশ্যটি পজ্ করলে দেখবেন– সাদা রঙের কাগজের বাক্সের উপর ব্লকে ছাপা নীলরঙা ছবি: একটি নির্ভেজাল বাঙালি ছেলে পরমানন্দে মিষ্টি খাচ্ছে, তলায় লেখা দোকানের নাম, ঈষৎ আবছা। তবে ভবানীপুর বা দক্ষিণ কলকাতার প্রবীণ বাসিন্দা যাঁরা, এ বাক্স দেখামাত্র তাঁদের স্বাদকোরকে নিশ্চিত চলকে উঠবে নিখাদ রসনার ঢেউ! স্বয়ং সত্যজিৎ রায় ছিলেন এই দোকানের কড়াপাক সন্দেশের বেজায় ভক্ত। ফলে প্রদোষ মিত্তির মশাইও যে সেই মিষ্টি পছন্দ করবেন এতে আর আশ্চর্য কী?

যদুবাবুর বাজারের উল্টোদিকে, দেবেন্দ্র ঘোষ রোড লাগোয়া বাড়িটিতে এই মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে গত ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে। সিমেন্টের নিপুণ গাঁথনিতে গড়া বাংলা হরফ দশ হাত দূরে দাঁড়িয়েও পরিষ্কার পড়া যায়– ‘গিরীশচন্দ্র দে এণ্ড কোং’। পুরনো বানান। সাবেক ছাঁদ। হালে কলি ফেরানো হলেও দোকানের অভ্যন্তরীণ সজ্জারও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। শুধু বদলে গিয়েছে তাদের ট্রেডমার্ক বাক্সটি। বর্তমানে বাজারচলতি ফুডগ্রেড কাগজে গড়পড়তা ফুলছাপ ছবি দেওয়া বাক্সই এঁরা ব্যবহার করছেন। সেই ব্লকে ছাপা আশ্চর্য ছবি উধাও হয়েছে বহুদিন। আশার কথা, ২০২৫-এর শেষে এসেও স্বাদে-গুণে অবিকৃত রয়ে গিয়েছে এঁদের সৃষ্টি: মনোমুগ্ধকর কড়াপাক সন্দেশ! নতুন গুড় ও ছানার আশ্চর্য মিলমিশে তৈরি এই ম্যাজিকটি এলাকায় ‘গিরীশের তালশাঁস’ নামেই বিখ্যাত। ভবানীপুরের এই মিষ্টান্ন বিপণিটিকে নির্দ্বিধায় উত্তর কলকাতার রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে অবস্থিত গিরীশ-নকুড়ের সার্থক ‘উত্তর’-থুড়ি-‘দক্ষিণ’সূরি বলা চলে। এককালে পিতলের বড় থালায় ভরে এখানকার গরম কড়াপাক সন্দেশ নিয়মিত সরবরাহ করা হত কয়েক মিনিটের দূরত্বে থাকা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ‘বাংলার বাঘ’ নাকি জলখাবারে পেল্লায় এক গেলাস দুধের সঙ্গে খেতেন ওই থালা ভর্তি মিষ্টি! বাঙালি মেধার সঙ্গে ছানার সন্দেশের একটা রহস্যময় আঁতাঁত রয়েছে। এ বিষয়ে যম দত্ত সবিস্তারে লিখেছিলেন তাঁর বইয়ে। সে তত্ত্ব অনুযায়ী: ছানার মিষ্টির যত দাম বেড়েছে, ততই মিষ্টিবিমুখ হয়ে পড়ে বাঙালির মগজ এবং প্রতিভার জৌলুস গিয়েছে কমে। তাই বোধহয় মগজাস্ত্রে বলীয়ান ফেলুদা-র প্রিয় ‘গিরীশের সন্দেশ’ ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪)-র ফ্রেমে রয়ে গিয়েছে ‘কলকাত্তাইয়া’ বাঙালিয়ানার অব্যক্ত অভিজ্ঞান হয়ে। শুধুই সোনার কেল্লা নয়, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিষ্টির যোগাযোগ একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আহা, রায় পরিবারের পারিবারিক পত্রিকার নামও যে ‘সন্দেশ’! সেকথা ভুললে তো অপরাধ হবে! চলুন তবে, ‘‘মিষ্টি দু’টো বাক্য বলে’’ সত্যজিৎ-সৃষ্টিতে মিষ্টিযোগ খোঁজার সুস্বাদু-সফরে বেরিয়ে পড়া যাক।

চিনিবাস ময়রা ঘণ্টা বাজিয়ে, বাঁক কাঁধে নিয়ে হাজির হলেই, গ্রামে ভারি আনন্দের লহর বয়ে যায়। হাঁড়িতে ভরা সরভাজা, চন্দ্রপুলী ও আরও হরেক রকমের মিষ্টির টানে, ভিড় জমায় কচিকাঁচার দল। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে বিস্তর প্রভেদ, তা টের পায় অপু আর তার দিদি দুর্গা। তারা গরিব। ফলে চিনিবাস ময়রা যখন শুধোয়, ‘নেবে না?’ তখন কষ্ট হলেও মাথা নেড়ে, ‘না’ বলে দুর্গা। চিনিবাস তখন পুকুরপাড়ের পথ ধরে। পিছনে পিছনে দৌড়য় অপু, দুর্গা আর তাদের বাড়ির ‘ভুলো’ কুকুরটি। মিষ্টির হাঁড়ি যেন তাদের দৈনন্দিন দারিদ্রের মাঝে এক আলাদিনের চেরাগ– দুর্লভ আনন্দের উপকরণ। নাই বা পেল তারা কিনতে, অন্য কেউ তো কিনবে– সেইটা দেখতে পারাও তাদের কাছে আনন্দের; আর তাতে করে যদি দু’-একটা মিষ্টি চেখে দেখার সুযোগ মেলে, তবে তো সোনায় সোহাগা!
ময়রার পিছু পিছু চলেছে দুই ভাইবোন এবং কুকুরটি। তাদের যাওয়ার উল্টোছায়া পড়েছে পুকুরের জলে, তিরতির করে কাঁপতে থাকা আশা-র ছবি যেন! এই দৃশ্যের শুটিংয়েও মিষ্টির একটি জরুরি ভূমিকা ছিল। সত্যজিৎ রায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, একাধিক রিটেকের পরেও সিনটি নাকি যথাযথ হচ্ছিল না। অপু-দুর্গা ঠিকমতো দৌড়লেও সারমেয়টি ছিল অলস প্রকৃতির। যতই তাকে সাধাসাধি করা হোক না কেন, সে ওঠে আর না। শেষমেশ মিষ্টির ঘুষ দিয়ে তবেই তাকে শট দেওয়ানো গেল। অপুর হাতের মুঠোয় লুকোনো মিষ্টির গন্ধে গন্ধে সে তড়িঘড়ি হেঁটে গেল ক্যামেরার ফ্রেমে থাকা পথ ধরে। তাই মিষ্টি এখানে নিছক কাহিনির অনুঘটক হয়েই থেমে থাকেনি, বরং হয়ে উঠেছে ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫)-র দৃশ্য গ্রহণের অন্যতম কৌশল। অপু-ত্রয়ীর দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’ (১৯৫৭)-তেও অদ্ভুতভাবে এসেছিল মিষ্টির অনুষঙ্গ। অসুস্থ হরিহর যখন ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে যে সে কী খেয়েছে, তখন বেনারসের অলিগলিতে ছুটে বেড়ানো দুরন্ত অপু ঈষৎ সলজ্জভাবে হিন্দিতে বলে, ‘এক লাড্ডু।’ বাসস্থানের রদবদলে মিষ্টিরও স্বাদবদল ঘটে যায়।
সিনেমায় বা সাহিত্যে ‘ম্যাকগাফিন’ (MacGuffin) নামক বস্তুটির গুরুত্ব সুবিদিত। এটি আদতে এমনই এক বস্তু বা তথ্য (বা ঘটনা) যা দর্শক বা পাঠকের কাছে আপাততুচ্ছ, কিন্তু কাহিনির কুশীলবদের কাছে জিনিসটি কমবেশি জরুরি। ঘটনাপ্রবাহের মোড় ঘুরিয়ে দিতে নানাবিধ ‘ম্যাকগাফিন’-এর জুড়ি নেই। আলফ্রেড হিচককের ভাষায়, ‘The thing that the spies are after but the audience doesn’t care (about).’ সত্যজিতের ছবিতে এহেন ম্যাকগাফিনের ভূমিকায় খোদ ‘মিষ্টি’ অবতীর্ণ হয়েছে একাধিকবার। ‘দেবী’ (১৯৬০) ছবিতে দয়াময়ী তার স্বামী উমাপ্রসাদকে কলকাতায় নিয়মিত চিঠি পাঠায়। চিঠি ডাকে ফেলার কাজটি সবার অলক্ষ্যে সারার জন্য একটি মনোরম ব্যবস্থা দয়াময়ী বের করেছিল। ভাসুর তারাপ্রসাদের শিশুপুত্রটি তার ভারী ন্যাওটা। একদিন সে খেলছিল আপনমনে, দয়াময়ী চুপিচুপি তাকে ডেকে এনে মুখে নারকেল নাড়ু গুঁজে দিতেই খোকার সে কী আহ্লাদ! তখন দয়াময়ী তার হাতে চিঠিটি ধরিয়ে বলেন সেটি ভৃত্য জয়রামকে দিয়ে আসতে। শিশুটিও একগাল হেসে তার কাকিমার দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে পড়ে। আবারও অনুঘটকের ভূমিকায় মিষ্টি– এক সহজ উৎকোচ!

অমূল্য গিয়েছে নিজের জন্য পাত্রী দেখতে। হবু শ্বশুরমশাই তাকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে বৈঠকখানায় বসালেন। এ-কথা সে-কথার পর নিজের কন্যাকে বললেন, ‘রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি’ গানটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাইকে গেয়ে শোনাতে। অমূল্য তখন মিষ্টিতে মনোনিবেশ করেছে। পাশে পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য চেয়ারে আসীন। হারমোনিয়াম বেজে উঠেছে, এমন সময় ঘটল অঘটন। পাত্রীর দস্যি বান্ধবী মৃন্ময়ী জানলা দিয়ে উঁকি মেরে এতক্ষণ সব কাণ্ডকারখানা দেখছিল। হঠাৎ করেই তার পোষা কাঠবিড়ালি ‘চরকি’ জানলা গলে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। ব্যস, মৃন্ময়ীও অমনি একছুটে হাজির অন্দরমহলে! হুলুস্থুল, হইচই! অমূল্য খেল এক মোক্ষম বিষম, অর্ধভুক্ত মিষ্টি মুখ থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশে বসা বৃদ্ধের টাকে। বৃদ্ধ কোনওমতে কাঁপা কাঁপা হাতে মাথা থেকে সেসব ঝাড়তে লাগলেন। ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১)-র এই ‘সিচ্যুয়েশনাল কমেডি’ বা ‘গ্যাগ’ যাতে যথাযথভাবে হয়, তার জন্য যেন হলিউডি ‘সেট-আপ অ্যান্ড পে-অফ’ কায়দায় মিষ্টিভর্তি রেকাবিটি পরিচালক চিত্রনাট্যে আগে থেকেই গেঁথে অমূল্যর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গোলমাল বাধলে পর, যাতে সেই মিষ্টিভর্তি রেকাবিই আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে।
বাঙালি অন্যের সংস্কৃতি সহজেই আপন করে নিতে জানে। কেক খেয়ে বড়দিনে যিশুপুজো উদযাপন বহুকাল ধরেই বাঙালির শীতের প্রধান উৎসব। এই কেক-ই এক চূড়ান্ত সমস্যার সমাধান ঘটিয়েছিল ‘অভিযান’ ছবিতে। রগচটা রাজপুত নরসিং পেশায় ট্যাক্সিচালক, নতুন জায়গায় এসে এককালীন ‘ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড’ জোসেফের সঙ্গে হঠাৎই মোলাকাত হয়ে যায় তার। জোসেফ নরসিংকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। জোসেফের বোন নীলি-র বানানো কেক পরিবেশন করতে গিয়ে জোসেফের মা হঠাৎই বলেন, তাঁদের জাতের কথা। এককালে তারা অন্ত্যজ ছিল; এবং ক্রিশ্চান হওয়ার পরই যে তারা ‘জাতে উঠতে’ পেরেছে, একথা বিনীতভাবে নরসিং-কে বলেন তিনি। মুহূর্তে ছায়া পড়ে জোসেফ আর তার বোন নীলির মুখে। কেউ যেন সজোরে চড় মেরেছে তাদের। অথচ জড়ো হওয়া দ্বিধা সরিয়ে রেখে নরসিং যখন সবেগে কেকের একটা বড় অংশ মুখে পোরে, তখন এক আশ্চর্য আনন্দ এবং স্বীকৃতির আবেশ খেলে যায়। হাসি ফুটে ওঠে জোসেফের মুখে। ছোট ছোট মুহূর্তে বারবার সত্যজিতের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে ‘মিষ্টি’। এমনকী, গুলাবী-ও তার পছন্দের পুরুষ নরসিং-এর সঙ্গে কথোপকথনের প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে তুলেছিল নিজের হাতে বানানো মিষ্টি খাইয়ে।
ইতিহাসে কুখ্যাত ‘উমিচাঁদ’ তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বিপুল খরচাখরচ করলেও, নিমন্ত্রিতদের খাবার পরিবেশন নাকি মোটেও যথাযথ হয়নি। সুতানুটির বাবুরা খেতে বসে মণ্ডা না পাওয়ায়, গৃহকর্তার উদ্দেশ্যে কষে গালমন্দ করেছিলেন। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং ‘বিরিঞ্চিবাবা’। এই ‘মহাপুরুষ’ আদতে ছিলেন গভীর জলের মাছ। আঁতকে ওঠার মতো রঙ-চড়ানো কথাবার্তা তিনি টুকরো সত্যি ও খণ্ড ইতিহাসের ককটেল দিয়ে এমনভাবে শোনাতেন যে, পোড়-খাওয়া লোকেদেরও তাক লেগে যাওয়ার জোগাড়। এত মিষ্টি থাকতে হঠাৎ ‘মণ্ডা’-র কথা কেন? কারণ আছে বইকি। মনোহরা, মণ্ডা, জিলিপি এগুলি ছিল সে যুগের অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। ‘বাবু-কালচার’-এর এক বিখ্যাত গানে এমন দু’টি চরণ মেলে: “খাওয়াইব গণ্ডা গণ্ডা/ মনোহরা দেদো মণ্ডা।” গানের কথাতে উল্লিখিত এই মিষ্টি একাধারে বিত্তের এবং অন্যদিকে অভিজাত খাদ্যরুচির দ্যোতনা বহন করে। ‘মহাপুরুষ’ (১৯৬৫) ছবির ক্রেডিটস শুরুই অবিশ্যি আরেক প্রকার মিষ্টি দিয়ে। শিমুলতলা স্টেশনে রেলগাড়ির কামরায় দাঁড়িয়ে বিরিঞ্চিবাবা সমবেত ভক্তদের দিকে প্রসাদী বাতাসা ছুড়ে দিচ্ছেন। শেষ বাতাসাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই ছুড়লেন স্টেশনমাস্টারের উদ্দেশ্যে, ধরনটা যেন: ‘কই হে, এবারে গাড়ি ছেড়ে দিতে বল।’

‘মহাপুরুষ’-এ ভীম নাগের মিষ্টির বাক্সও দেখা গিয়েছে ধনী মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বাটপাড়িয়া-র হাতে। ছবির নায়িকা বুঁচকি-র গণেশমামা তলে তলে সাঁট করেছিলেন ভণ্ড বাবাজির সঙ্গে। এক সন্ধ্যায় দেবদর্শনের জন্য আকুল শেঠজিকে ঢাউস মিষ্টির বাক্স ও নানা উপহার সামগ্রী নিয়ে আসতে দেখে, গণেশমামা আর নিজেকে সামলাতে পারেন না। মিষ্টির বাক্সের গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ইয়ে ক্যায়া হ্যায়? নলেন গুড়-কা… ?’ শেঠজি বিগলিত হয়ে একগাল হেসে সম্মতি জানান, তারপরেই পাক্কা ব্যাবসাদারের মতো আদায়-উশুল বুঝে নিতে চেয়ে প্রশ্ন, ‘দেবদর্শন হোবে তো?’ ছবির শেষে যখন ভণ্ড মহাপুরুষের জারিজুরি ধরা পড়ে গিয়েছে, তখন অন্ধকার বাড়ির হুলুস্থুলে দেখা যায়, নিজের আনা উপহার-সামগ্রী ফেরত নিতে নিতে শেঠজি গোগ্রাসে একটার পর একটা মুখে পুরছেন ভীম নাগের মিষ্টি! তিনি ঝানু ব্যবসায়ী, আর তাকেই কি না এক ব্যাটা বাবাজি ‘ওজনে ঠকিয়ে’ দিলে! যতটা উদ্ধার করা যায় তাই সই। শুধুমাত্র মিষ্টি খাওয়ার মধ্যে দিয়ে এতখানি ন্যারেটিভ অবলীলাক্রমে পর্দায় তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

‘মণ্ডামিঠাই হাঁড়ি হাঁড়ি…মিহিদানা, পুলিপিঠে…যত সেরা মিষ্টি…এলো বৃষ্টি’ গান থামতেই হাতে-তালি এবং আকাশ থেকে নামতে লাগল একের পর এক হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি। গুপী বাঘার জাদুতে হাল্লা রাজার অভুক্ত সেনারা যুদ্ধ ফেলে মিষ্টি খেতে টেনে দৌড় দিল। রাজস্থান এবং স্টুডিও মিলিয়ে শুট করা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৯) ছবির এই দৃশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল রাজস্থানের আঞ্চলিক ক্ষীরের মিষ্টি। বুভুক্ষু সেনাদের দেখা গিয়েছিল হামলে পড়ে মিষ্টি খেতে।

হাল্লার রাজা যখন ওষুধের ঘোর কেটে গিয়ে ‘ছুটি, ছুটি’ বলে দৌড়ে এসে, এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন– সেখানে কিন্তু ‘বুভুক্ষু’ ভাবের চেয়ে দেখা গিয়েছিল ‘পরিতৃপ্তি’-র আমেজ। ঠিক যেমনটা গুপী বাঘার ক্ষেত্রেও হয়েছিল, প্রথমবার হাতে তালি দিয়ে খাবার আনার সময়।

দৃশ্যটির শুটিং হয়েছিল রামপুরহাটের কাছে। সত্যজিৎ চেয়েছিলেন পর্দায় দর্শক গুপীবাঘাকে পেল্লায় আকারের রাজভোগ খেতে দেখুক। সেইমতো ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিপত্তি বাধল। হালুইকররা জানালেন যে, অতবড় মিষ্টি বানাতে গেলে ছানার গোল্লা রসে পড়ে ভেঙে যাবে। তখন রামপুরহাটের ‘মিষ্টিমুখ’ দোকানের কর্ণধার বলে দিলেন সমাধানসূত্র। ময়দার বলের ওপর ছানার কোটিং দিয়ে তৈরি হল বিরাট আকারের রাজভোগ।

শুটিংয়ের সময় তপেন চট্টোপাধ্যায় এবং রবি ঘোষকে সত্যজিৎ বললেন শটের সময় বুঝে-শুনে মিষ্টির ‘ওপর ওপর খেতে’। কিন্তু কামু মুখোপাধ্যায়কে দেখে শিশুসুলভ দুষ্টুমি চাগাড় দিল সত্যজিতের মনে– বললেন, ‘কামু, তুমি এই মিষ্টি একটা গোটা খেতে পারবে?’ সপ্রতিভ উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, মানিকদা।’ এরপর একটা গোটা রাজভোগ সটান মুখে চালান করে দিলেন অভিনেতা। সবিস্ময়ে সত্যজিৎ যখন জানতে চাইলেন মিষ্টিটা কেমন লাগল, তখন নিরীহ মুখেই কামু বললেন, ‘খুব বড় সাইজ করেছে তো মানিকদা, রসটা ভেতর অবধি পৌঁছয়নি।’ এরপর যে এক মারাত্মক হাসির রোল উঠেছিল, তা আর বলে দিতে হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজস্থানের ক্ষীরের মিষ্টিও নাকি একাই দু’-হাঁড়ি সাবড়ে দিয়েছিলেন কামু ওরফে কামাখ্যা মুখোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’ বইটিতে লিখেছিলেন– আপ্যায়নের পরিসরে বহুদিন হল বাঙালি তার হুঁকোবরদার জাতটি ছেড়ে ময়রার দোকানের ‘বাসি সন্দেশ চটকে চটকে মাখতে’ বসেছে। তাই বুঝি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে মিষ্টির এক অবিচ্ছেদ্য যোগ! এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সদ্য চাকরি পাওয়ার পর মিষ্টি নিয়ে ঈষৎ কুণ্ঠাভরেই দেখা করতে আসে ‘হিন্দুস্থান পিটার্স কোম্পানি’র বড়সাহেব শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জির সঙ্গে। আর্থিক সংগতির নিরিখে দুর্বল, অথচ মূল্যবোধে ধনী এই ছেলেটির উচ্চবিত্তের বৈঠকখানায় আনা মিষ্টি, যেন নিছক ম্যাকগাফিন হয়ে থাকে না; তার চেয়েও অনেক গভীর দ্যোতনায় পরিণত হয় ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১)-র চিত্রনাট্যের আশ্চর্য বুননে।
‘ক্যাল এইচ টু ফর্টি সেভেন’ রোল নম্বরের ছাত্র সোমনাথ ব্যানার্জি সকলকে যুগপৎ অবাক এবং হতাশ করে সেকেন্ড ডিভিশনে গ্র্যাজুয়েট হয়। বাড়িতে তার করিৎকর্মা দাদা এ ব্যাপারে ঈষৎ টিপ্পনী কাটে এবং পরীক্ষা পাশের মিষ্টি বিস্বাদ হয়ে যায় সোমনাথের কাছে। ‘জন-অরণ্য’ (১৯৭৫) ছবিতে ধরা পড়ে অগণিত চাকরিপ্রার্থীর ভিড়ে সম্ভাবনাময় সোমনাথের ‘ব্যবসাদার’ হয়ে ওঠার গল্প। তার সহপাঠী সুকুমার হয় ট্যাক্সিচালক। অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করার পর অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তার জন্য মিষ্টি নিয়ে যায় সোমনাথ। সুকুমারের বাবা সেই মুহূর্তেই কাজ থেকে ফিরেছেন বাড়িতে। রাস্তা খুঁড়ে রাখা এবং খানাখন্দের ওপর নিজের রাগ প্রকাশ করতে তিনি একটি অশ্রাব্য গালাগাল ব্যবহার করেন, আর ঠিক সেই সময়ই সোমনাথ গিয়ে তাকে প্রণাম করায় তিনি ঈষৎ অপ্রস্তুত। এবার টিপ্পনী কাটে সুকুমার, তার পরমুহূর্তেই বন্ধুর আনা মিষ্টির একটা মুখে পুরে দেয়। একই মিষ্টি নানাভাবে এ ছবিতে বয়ে এনেছে তীর্যক খোঁচা অথবা গভীর বিষাদের অনুষঙ্গ।

কাশী হল রাবড়ি, মালাই এবং হরেকরকম মিষ্টির পীঠস্থান। তাই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ছবিতে ফেলুদা যখন বিকাশ সিংহকে হাতেনাতে ধরতে চলেছেন, তখন বিকাশবাবু ঠঠেরি বাজারের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান, ‘শ্রী রাম ভাণ্ডার’-এ মিষ্টি কিনতে ব্যস্ত।

প্রবীণ মিষ্টি বিক্রেতাকে দেখা যায় যত্ন সহকারে আঙুলের আলতো চাপে রূপোলি তবক দেওয়া মিহিদানার চৌকো সন্দেশ বাক্সে ভরতে। সাদা কার্ডবোর্ডের উপর লাল ব্লকে ছাপা দোকানের নাম। বছর ১২ আগে নিছক কৌতূহলের বশে প্রতিবেদক কাশীতে রাম ভাণ্ডার গিয়ে খোঁজ করে দেখেন যে, সেখানেও এমন পরিমিত ডিজাইনের বাক্স গা ঢাকা দিয়েছে বহু বছর আগেই।

আপাতত রঙচঙা গতে বাঁধা ডিজাইনই এর শিরোভূষণ। দোকানও আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। যাই হোক, মিষ্টির দোকানিকেই সাক্ষী রেখে, ‘হামলোগ ওয়াপস্ আয়েঙ্গে’ বলে বিকাশবাবুকে নিয়ে দোকান ছেড়েছিলেন ফেলু মিত্তির।

রিভলভার ঠেকিয়ে বিকাশ সিংহকে মানমন্দিরে পর্যুদস্ত করার পর, প্রদোষ মিত্র কি কথা রাখতে আদৌ আর দোকানে ফেরত গিয়েছিলেন? ছবির শেষে দৃশ্যে এর প্রমাণ মেলে। বিজয়া দশমীর দিন অম্বিকা ঘোষালের ঘরে, পাশে রাখা টেবিলে সাদা বাক্সের মধ্যে থেকে উঁকি দেয় সেই মিষ্টি!

ফেলুদা যে মিষ্টির ভক্ত তার আরও প্রমাণ মেলে যখন সে তোপসেকে ফোন করে তাদের ছদ্মবেশের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে বলে, ‘সঙ্গে কিছু মিষ্টি আনবি, সারাদিন খাওয়া হয়নি আমার।’ দ্বারভাঙা ঘাটে সাধুবেশী লালমোহন ও তপেশ দু’জনেই অবিশ্যি অন্য একজন বাবাজিকে ফেলু ভেবে ভুল করে, ঝোলায় ঢাকা মিষ্টির হাঁড়ি এগিয়ে দিয়েছিল।

‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪) ছবিতে পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সন্দীপ তার বন্ধু নিখিলেশের স্ত্রী বিমলার হাতে তৈরি মিষ্টি খেতে অস্বীকার করেনি। সেই জের শেষ পর্যন্ত যে কতদূর গড়িয়েছিল, তা যাঁরা ছবিটি দেখেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন। তেমনই ৩৫ বছর পর দেশে ফেরা মনমোহন মিত্র যখন তাঁর ভাগনি অনিলার বাড়ি এসে উপস্থিত হন, তখন সংস্কৃতির ধারা মেনে ঠিকই জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা ভীম নাগ, তারপর… গাঙ্গুরাম, এসব দোকান আছে এখনও?’ বহুদিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পাছে অনামী দোকান থেকে মিষ্টি এনে অতিথি হিসেবে সমালোচনার মুখে পড়েন– তাই ও পাট তিনি রাখেননি বলে ভাগনিকে বলেন ভূপর্যটক মনোমোহন। কাজেই সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ (১৯৯১)-এও বহাল ছিল মিষ্টিসূত্র।

একই মিষ্টির বাক্স নানা উপলক্ষ, নানা অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে সত্যজিতের ছবিতে। কখনও বাক্যালাপ, কখনও টানাপোড়েন, আবার কখনও নিছক সৌজন্যের স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে মিষ্টি। সত্যজিতের নিজের জীবনেও এই উপকরণ ছিল পুরোমাত্রায়। নকুড়ের মিষ্টি ছাড়াও যাদব চন্দ্র দাসের দই ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। ১৯৯২ সালে অস্কারের জীবনকৃতি সম্মান যে তিনি পাচ্ছেন, এ খবরটি নিশ্চিতভাবে জানার পর যখন সত্যজিৎকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যে এমন একটা গর্বের মুহূর্ত কী খেয়ে তাঁর উদযাপন করতে ইচ্ছে হচ্ছে? তখন দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্যজিৎ বলেন, ‘নলেন গুড়ের সন্দেশ’।
শুধুমাত্র ছায়াছবিতে মিষ্টির বর্ণনা বা ব্যবহারে সীমাবদ্ধ থেকেছেন সত্যজিৎ, এমনটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। সত্যজিতের প্রয়াণের অনেক পরে তাঁর আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে ‘ডায়মণ্ডা’ মিষ্টি তৈরি করেছিল কলকাতার নামকরা সংস্থা ‘বাঞ্ছারাম’। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ উপন্যাসে মিষ্টিটির সবিস্তার উল্লেখ ছিল। যাই হোক, সে মিষ্টির বাজারজাত রূপ সত্যজিৎ দেখে যেতে পারেননি। যদিও গুপী-বাঘার চূড়ান্ত সাফল্যের দরুন সে আমলে দীর্ঘদিন মিষ্টির শোকেস আলো করেছিল ‘গুপী-বাঘা’ সন্দেশ।

লেখার শুরুতেই সোনার কেল্লার অনুষঙ্গ এসেছিল, তাই এক্কেবারে শেষে এসেও রাজস্থানের টান এড়ানো ভারী মুশকিল। তদুপরি, হালে আরাবল্লী পর্বতমালা নিয়েও যে পরিমাণ টানাপোড়েন চলছে, তাতে করে প্রেক্ষাপট হিসেবে রাজস্থানের অগ্রাধিকার প্রাপ্য। যাইহোক, ‘উট বনাম ট্রেন’ পর্ব চুকিয়ে জটায়ু যখন ব্যথায় কাবু, তখন পড়ন্ত বিকেল। এমন সময় সিল্যুয়েট হয়ে আবির্ভাব ফেলুদার, হাতে খাবারের বাক্স। তোপসে এবং লালমোহনবাবুর মধ্যে ‘খাস আরাবল্লীর ডাকাতদের খাদ্য’ বলে যে দ্রব্যটি বিতরিত হল, তা যে একপ্রকার মিষ্টিই তা অনুমান করে বলা যায়, তবে নিশ্চিত হওয়ার জো নেই। কাজেই আপাতত একে আমরা জটায়ুর অ্যালিটারেশন পদ্ধতি মেনে– ‘মিস্টিরিয়াস মিষ্টি’ বলেই চিনে রাখলুম! কারণ, আমাদেরই তো মাইন্ড, চেঞ্জ করতে বাধাটা কোথায়?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved