Robbar

‘প্যারাসোশাল’ কেন বছরের সেরা শব্দ?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 19, 2025 8:31 pm
  • Updated:November 19, 2025 8:31 pm  

২০২৫ সালে কেমব্রিজ ডিকশনারি প্যারাসোশাল শব্দটিকে তাদের ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছে কারণ তারা লক্ষ করেছে এই বছর একমুখী সম্পর্ক বা প্যারাসোশাল বন্ডিংয়ের ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইনফ্লুয়েন্সার কালচার, কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গে গভীর সংযোগ এবং সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা এআই চ্যাটবটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি, এই শব্দটির ব্যবহারকে হঠাৎ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছে। কেমব্রিজ তাদের ব্লগে জানিয়েছে যে, মানুষের আচরণের এই নতুন প্রবণতা ২০২৫-এর সামাজিক আবহকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। সম্পাদক কলিন ম্যাকিনটশ বলেছেন যে, প্যারাসোশাল এই সময়ের এক ধরনের সাংস্কৃতিক ভাবধারা হয়ে উঠেছে, কারণ মানুষ অভূতপূর্বভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে অপরিচিতদের  সঙ্গে এক বন্ধন গড়ে তুলছে।

আদিত্য ঘোষ

ডিজিটাল দেওয়ালের দুই পারে দুই ব্যক্তি!

এক ব্যক্তি প্রতিদিন নিয়ম করে রিলস বানায়, গান গায়, প্রতিদিনের জীবনের খুঁটিনাটি ভিডিওয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেন। অন্য এক ব্যক্তি মুঠোফোনের দুনিয়ায় সেই রিলস, গান, ভিডিও দেখে ওই ব্যক্তি বা মহিলার সঙ্গে একটা সংযোগ গড়ে তুলেছেন। ফোনের দুই প্রান্তে থাকা দুই ব্যক্তির মধ্যে কিন্তু কোনও আদান-প্রদান নেই। শুধুমাত্র লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ছাড়া বাকি দুনিয়াটা ওই ডিজিটাল বেড়াজালে বন্দি। কিন্তু প্রতিদিন সেই ব্যক্তি বা মহিলার ভিডিও দেখতে দেখতে আমরা একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। যে সম্পর্ক প্রেম, ভালোবাসা, আত্মীয়তার নয়। কিন্তু এক ধরনের আবেগের। সেই ব্যক্তি বা মহিলা একদিন ভিডিও না-দিলে মনটা উৎসুক করে। ইচ্ছে করে খোঁজ নিতে। তিনি ঠিক আছেন তো? অথবা তার মুখটা উদাসী লাগলে মনে হয় জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ এই যে অনুভূতি, এই যে চাওয়া– এগুলোকে কী বলে? আধুনিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন এইটা আসলে এক প্রকার প্যারাসোশাল সম্পর্ক। এই ধরুন, আমি প্রতিদিন সকালে উঠে দেখি চেতেশ্বর পূজারা কোনও ছবি আপলোড করল কি না কিংবা কোনও ভিডিওতে ক্রিকেট নিয়ে কী বলল! আমার দেখতে বেশ লাগে। মনে হয়, আমি যেন ওঁর বহুদিনের পরিচিত। দু’-একটা কমেন্ট করে বক্তব্য লিখে দিই। লাইক, শেয়ার করি। আবার কেলি ব্রুক কোনও রিলস আপলোড করল কি না, সেই বিষয়েও তীক্ষ্ণ নজর রাখি। ওঁর অভিনীত সমস্ত ছবি ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছি। মনে হয়েছে, কখনও বলি অমুক সিনেমার ওই অংশকে আপনাকে দারুণ লাগছিল কিন্তু! আবার লিভারপুলের গোলরক্ষক ব্রাজিলিয়ান তারকা অ্যালিসন বেকারের সঙ্গে সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়েই আমার এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মনে হয়, আমি যেন ওঁর পরিচিত কেউ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্যারাসোশাল’ সম্পর্ক বলতে বোঝায় এমন এক ধরনের একমুখী মানসিক সংযোগ, যার জন্ম হয় মূলত স্ক্রিন ও মিডিয়ার মাধ্যমে। এখানে একজন ব্যক্তি কোনও সেলিব্রিটি, অভিনেতা, ইনফ্লুয়েন্সার, লেখক, উপস্থাপক, এমনকী, কোনও এআই-এর প্রতি এমন অনুভূতি তৈরি করেন যেন তিনি তাঁর খুব কাছের, পরিচিত বা নিজের জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। অথচ বাস্তবে সেই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত যোগাযোগ, পরিচয়  থাকে না। সম্পর্কটা পুরোপুরি দর্শকের দিক থেকেই গড়ে ওঠে। অপর পক্ষের কাছে এই বন্ধন অদৃশ্যই থেকে যায়। সোশাল মিডিয়া, ধারাবাহিক কনটেন্ট দেখা এবং অনলাইন ব্যক্তিত্বের ক্রমাগত উপস্থিতি মানুষের মনে এক ধরনের পরিচিতির ভ্রম তৈরি করে, যা ধীরে ধীরে আবেগ, ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে।

‘প্যারাসোশাল’ ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে ১৯৫৬ সালে, যখন মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক ডোনাল্ড হর্টন  এবং রিচার্ড উল তাঁদের যুগান্তকারী গবেষণাপত্র ‘Mass Communication and Para-Social Interaction’-এ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। টেলিভিশন তখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। দর্শকরা প্রতিদিন পর্দায় দেখা উপস্থাপক, অভিনেতা, খবর পাঠকদের সঙ্গে এক অদৃশ্য ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতে শুরু করেছেন। যেন তাঁরা তাঁদেরই পরিবারেরই সদস্য। যদিও কোনও দিন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ঘটেনি, তবু দর্শকদের মনে হচ্ছিল এই রঙিন দুনিয়ার মানুষগুলো তাঁদের চিনতে পারে। এই একমুখী কিন্তু আবেগপূর্ণ ঘনিষ্ঠতাকে হর্টন ও উল ‘প্যারাসোশাল রিলেশনশিপ’ নামে ব্যাখ্যা করেন। যেখানে দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও ঘনিষ্ঠতার ভ্রম তৈরি হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে এই ধারণা আরও বিস্তার পায়। রেডিও জকি, সিনেমার তারকা, ক্রীড়াবিদ, লেখক থেকে শুরু করে আজকের ইউটিউবার, ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার এমনকী, এআই চ্যাটবট– সবাইকে ঘিরেই এখন একই ধরনের একমুখী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্যারাসোশাল সম্পর্ক আধুনিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক উপাদান হয়ে উঠেছে।

২০২৫ সালে কেমব্রিজ ডিকশনারি প্যারাসোশাল শব্দটিকে তাদের ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছে কারণ তারা লক্ষ করেছে এই বছর একমুখী সম্পর্ক বা প্যারাসোশাল বন্ডিংয়ের ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইনফ্লুয়েন্সার কালচার, কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গে গভীর সংযোগ এবং সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা এআই চ্যাটবটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি, এই শব্দটির ব্যবহারকে হঠাৎ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছে। কেমব্রিজ তাদের ব্লগে জানিয়েছে যে, মানুষের আচরণের এই নতুন প্রবণতা ২০২৫-এর সামাজিক আবহকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। সম্পাদক কলিন ম্যাকিনটশ বলেছেন যে, প্যারাসোশাল এই সময়ের এক ধরনের সাংস্কৃতিক ভাবধারা হয়ে উঠেছে, কারণ মানুষ অভূতপূর্বভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে অপরিচিতদের  সঙ্গে এক বন্ধন গড়ে তুলছে। ২০২৫ সালে প্যারাসোশাল শব্দটির সার্চ হঠাৎ কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে এবং সংবাদমাধ্যমেও শব্দটি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। এই সব মিলিয়ে কেমব্রিজের কাছে প্যারাসোশাল শব্দটি শুধু ভাষাগত নয়, বরং এক গভীর সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন হিসেবেও ২০২৫ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হয়ে ওঠে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম আসলে প্যারাসোশাল অনুভূতির সবচেয়ে বড় নির্মাতা। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ফেসবুক সব প্ল্যাটফর্মই  লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, স্টে-টাইম ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ঠিক করে দেয় কোন মানুষটিকে আমাদের সামনে বারবার তুলে ধরা হবে। ফলে আমরা কোনও নির্দিষ্ট ইনফ্লুয়েন্সার বা ক্রিয়েটরকে যত বেশি দেখি, অ্যালগরিদম তাকে ততটাই বেশি করে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। এই পুনরাবৃত্তি দিনের পর দিন, ছোট ছোট ক্লিপ, লাইভ স্ট্রিম, তাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা মনে করায় যেন আমরা ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত জগতের অংশ, যদিও বাস্তবে তার সঙ্গে পরিচয় নেই। অ্যালগরিদমের এই ঘনিষ্ঠতার ইলিউশনই প্যারাসোশাল বন্ডিংকে তীব্র করে। ক্রিয়েটরের হাসি, চোখের ভাষা, ক্যামেরার দিকে সরাসরি কথা বলা– সব মিলিয়ে মনে হয়, তিনি ঠিক আমার সঙ্গে কথাই বলছেন। এর নেপথ্যে প্ল্যাটফর্মের লাভও রয়েছে, কারণ যত বেশি প্যারাসোশাল অনুভূতি তৈরি হবে, তত বেশি আমরা জড়িয়ে থাকব। স্ক্রিন টাইম বাড়বে, এনগেজমেন্ট বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপনী আয় বাড়বে। তাই বলা হয়, আধুনিক প্যারাসোশাল সম্পর্ক আর শুধু মনস্তত্ত্ব নয় এটি অ্যালগরিদম-চালিত এক ইঞ্জিনিয়ার্ড ইমোশন।

প্যারাসোশাল সম্পর্ক ভালো না খারাপ– এই বিষয়ে তর্ক হতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিমিত অবস্থায় এই একমুখী ঘনিষ্ঠতা অনেক সময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। একাকিত্ব কমায়, নিরাপত্তার বোধও দেয়। জোগায় অনুপ্রেরণাও। বাস্তব জীবনে যারা সহজে বন্ধুত্ব করতে পারেন না বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় অনুভব করেন, তাঁরা কোনও সেলিব্রিটি, ইনফ্লুয়েন্সার বা গল্পের চরিত্রের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ তৈরি করে কিছুটা মানসিক সান্ত্বনা পান। অনেক তরুণ-তরুণী তাদের প্রিয় ক্রিয়েটরের দৈনন্দিন সংগ্রাম দেখে জীবনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পায়, এমনকী, আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। কিন্তু বিপদ শুরু হয় তখনই, যখন এই প্যারাসোশাল ঘনিষ্ঠতা বাস্তব সম্পর্ককেও ছাপিয়ে যায়। অ্যালগরিদমের কারণে নির্দিষ্ট কিছু মুখ আমাদের স্ক্রিনে বারবার ফিরে আসে, এতে মনে হয় তারা যেন চেনা মানুষ। আর এখান থেকেই তৈরি হয় ভ্রান্ত ঘনিষ্ঠতা। এই ভ্রম যদি বাড়তে থাকে, তবে মানুষ বাস্তব মানুষের প্রতি আগ্রহ হারায়, সামাজিক দক্ষতা কমে যায়, পরিবার বা বন্ধুরা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে হয় এবং তৈরি হয় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। আরও বড় সমস্যা দেখা দেয় যখন এই একমুখী আবেগ অধিকারবোধে রূপ নেয়। ফ্যানরা সেলিব্রিটির ব্যক্তিগত জীবনে নিজস্ব দাবি দেখায়, যা স্টকিং, অনলাইন হ্যারাসমেন্ট বা অবসেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, সম্পর্কটি তখনই ক্ষতিকর হয় যখন এটি বাস্তব সম্পর্কের জায়গা দখল করে, প্রত্যাশা বিকৃত করে এবং সেই ব্যক্তি মনে করেন স্ক্রিনের ওই মানুষটি তাঁকেও একইভাবে গুরুত্ব দেয় না যা কখনও সত্য নয়।

তাই প্যারাসোশাল সম্পর্কের আসল মূল্যায়ন ভালো-মন্দে নয়, ভারসাম্যে। সত্যিকারের যে-জীবন, সে-জীবনের দিকে ঘুরে তাকালেই তো ভালো বোধহয়, নাকি?

…………………………

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত সমস্ত ছবিই ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত