শক্তি মাঝে মাঝেই মাইক দখল করে বাবা মা-কে সচেতন থাকতে বলে ঘোষণা করতেন, ‘বাচ্চারা হারিয়ে গেলে আমার একটুও ভাল লাগে না।’ প্যারাডক্স একেবারে! নিজের বাচ্চাকে লোকের বাড়িতে, অফিসে ফেলে আসতে যে অভ্যস্ত তার মুখে এই ঘোষণা! একবার বইমেলার গেট সাজানোর দায়িত্বে ছিলেন আমাদের বন্ধু আর্কিটেক্ট শোভনলাল বোনার্জী। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর কবিতার ছবি দিয়ে তৈরি হয়েছিল বিরাট কাটআউট। সে এক হইহই ব্যাপার। কী সুন্দর যে লাগত। বইমেলাধুলো-র প্রথম লেখা।
কলকাতার বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোদ্দো পার্বণ বইমেলা। বইমেলা শুরু হয়েছিল বোধহয় ১৯৭৬ সালে। সে কি আজকের কথা– প্রায় গতজন্মের স্মৃতির সন্ধান করতে হবে। তবে বইমেলা শুরু হওয়ার আগেও জওহরলাল নেহরু রোডের প্রায় ধার ঘেঁষে ময়দানেই চলত ‘মুক্তমেলা’। সম্ভবত তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন লেখক, প্রাবন্ধিক, মননজীবী জ্যোতির্ময় দত্ত, সঙ্গে তৎকালীন কবিরাও ছিলেন। সেই মেলায় বই বিক্রির ব্যবস্থা ছিল, কেউ ইচ্ছামতো গান করতেন, কেউ কবিতা বলতেন, কেউ কেউ গানের সঙ্গে নাচতেনও। লিটল ম্যাগাজিনের দলও যে যার ইচ্ছেমতো বসে যেত। মোটকথা, মুক্তমেলাই ছিল বইমেলার পূর্বসূরি। তারও আগে ময়দানে জমকালোভাবে হত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন। কলেজ ফেরত ছাত্রছাত্রী, আপিস ফেরত আমাদের মতো কিছু উৎসুক মানুষও গিয়ে ভিড় জমাতাম নানা দৃশ্যের দর্শক হয়ে। তবে সংসার এবং সন্তানের জন্য ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারতাম না। ঘরের বিষয়ে যাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দ্রুত দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেন।
এরপর ওঁর মুখেই ময়দানের একদিকে বইমেলা আরম্ভ হওয়ার কথা শুনলাম। কয়েকজন প্রকাশক মিলেই শুরু করেছিলন প্রথমে, তার মধ্যে বিমল ধর, দেবজ্যোতি দত্ত– এঁদের নামই শুধু মনে আছে। পরে আনন্দবাজার-এর বাদল বসু এবং আরও কেউ কেউ সংগঠনে এসেছিলেন, তখনও ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ নামকরণ হয়নি। তবে আমার, বইমেলার কর্তা কারা ছিলেন, এসব মনে রাখার কথাও না। যেটুকু মনে আছে, তার মধ্যে অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে। বইমেলা তো আমাদের দ্বিতীয় শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সে যেন আর এক রথের মেলা, রথটাই শুধু নেই। আছে সার সার বইয়ের দোকান– লম্বাটে মেলাটার দু’ধার ঘেঁষে, ভিতরে মাঝখানে একটা গোলমতো জায়গায় ছিল ইউবিআই স্টেডিয়াম ও প্রেস কর্নার। সেখান থেকে নানা ঘোষণা করা হত, প্রয়োজনে মেলা কর্মীদের ডাকা হত, কেউ হারিয়ে গেলে তার নাম ঘোষণা করে ওই অফিস ঘরের সামনে চলে আসতে বলা হত, রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড বাজানো হত– এইসব নানা কাজকর্ম হত। ওই দোকানঘরের আশপাশেই কোনও কোনও শিল্পী ছবি আঁকতে বসে যেতেন, বড় শিল্পীদের ছবির প্রিন্ট বিক্রি হত। একবার পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের চার্লি চ্যাাপলিনের প্রিন্ট প্রচুর বিক্রি হয়েছিল মনে আছে। ইতস্তত, ভাঁড়ের চা, তেলেভাজার দোকানও থাকত। একটা ফাঁকা জায়গায় শিঙাড়া, কচুরি, মিষ্টি জাতীয় খাবার দোকান আর ইন্ডিয়ান কফি হাউসের একটা স্টলও দেওয়া হত। এখনকার মতো খাদ্যমেলায় পরিণত হয়নি তখনকার বইমেলা। বইমেলার প্রবেশমূল্য একটা ছিল, আট আনা কি এক টাকা– সেটাও মনে নেই, তবে তার জন্য বিরাট লম্বা লাইন পড়ত। যাঁরা বইয়ের দোকান দিতেন বা স্টল দিতেন, আর যাঁরা বইমেলার নিমন্ত্রণপত্র পেতেন, তাঁদেরই ওই লাইনে দাঁড়াতে হত না। লেখকরা এতদিন পুজো, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া এই সময়গুলোকেই বেছে নিতেন তাঁদের নতুন বই প্রকাশের জন্য, কিন্তু বইমেলা শুরু হওয়ার পর বইপ্রকাশের সময় হিসেবে বইমেলাকেই অধিকাংশ লেখক প্রকাশক বেছে নিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রেস কর্নার থেকে নতুন বই বের হত কোনও বিশিষ্টজনের হাত দিয়ে, সেখানে নানা অনুষ্ঠানও হত ফলে ভিড় লেগেই থাকত। কৃত্তিবাস-এর স্টলে সুনীল, সন্দীপন, বেলাল, শরৎ মুখোপাধ্যায়– এঁরা সই করে পত্রিকা, বই বিক্রি করতেন। মোটামুটি মেলা বলতে যা বোঝায় নাগরদোলা, টয় ট্রেন ছাড়া সবকিছুই হাজির ছিল। কে কে ছিল ভাবতে গিয়ে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়– কাউকে আর খুঁজে পাই না দু’-একজন ছাড়া।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বইমেলায় কতদিনের হারিয়ে যাওয়া মানুষ, বন্ধুকে খুঁজে পেতাম, তাদের সঙ্গে মেলার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ঘাসের উপর বসে চা খেতাম, বাদামভাজাও। এখনকার মতো বিপুলাকৃতি না হলেও সবক’টা বইয়ের দোকান ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যেত কখনও কখনও। তখন কোনও চেনা চেনা স্টলে গিয়ে বসে পড়তাম। এই বইমেলায় খুঁজে পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শৈবাল মিত্রকে, যে আগে রাজনীতি করত, তখন তারই সঙ্গে লেখক। প্রতি বইমেলায় ওর নতুন বই উপহার পেতাম। কবি বন্ধু শংকর দে-ও থাকত সঙ্গে। থাকত কৃষ্ণা-রুচিরা। নতুন বইয়ের গন্ধ শোঁকা, সেগুলি উল্টেপাল্টে দেখা, মেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা– এগুলোর মধ্যে যেন দিশাহারা আকর্ষণ ছিল। মোটামুটি ফাঁকাই ছিল এখনকার তুলনায়, শুধু আনন্দ’র সামনে বিশিষ্ট লেখক, বিশেষত সত্যজিৎ রায়, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের বই কেনার জন্য লম্বা লাইন পড়ত। এঁরা অনেকে বই-এ নাম সই করেও দিতেন, সেটা ছিল বাড়়তি আকর্ষণ। পরবর্তী সময়ে ‘দেজ’-এর সামনেও লম্বা লাইন পড়তে দেখেছি। তবে আমরা কোনও দিনই লাইনে ছিলাম না, আমরা তো বইমেলা থেকে বেশি বই কিনতামও না, কলেজ স্ট্রিটের দোকানে ২০ শতাংশ ছাড় ছিল, বইমেলায় তো ১০ শতাংশ ছাড়, আমরা কী কী বই বেরিয়েছে সেটা দেখে রাখতাম, কিনতাম কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে।
তখন স্টল সাজানোর ওপরও পুরস্কার ঘোষণা করা হত। প্রতিক্ষণ-এর স্টল প্রায়ই এই সাজানোর জন্য সেরা পুরস্কারটি পেত। প্রতিক্ষণ-এর প্রিয়ব্রত দেব ও স্বপ্না দেব, আপ্যায়নের সুন্দর ব্যবস্থা রাখতেন। লেখকরা বিশেষত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, শক্তি আরও অনেকে বসে জমাটি আড্ডা দিতেন। দে’জ-এর স্টল যখন ছোট ছিল, ওখানেও বসেছি শংকর, শক্তি, শৈবাল, অমিতাভ দাশগুপ্ত– এদের সঙ্গে। প্রেস কর্নার থেকে নতুন বই বের হত কোনও বিশিষ্টজনের হাত দিয়ে, সেখানে নানা অনুষ্ঠানও হত ফলে ভিড় লেগেই থাকত। কৃত্তিবাস-এর স্টলে সুনীল, সন্দীপন, বেলাল, শরৎ মুখোপাধ্যায়– এঁরা সই করে পত্রিকা, বই বিক্রি করতেন। মোটামুটি মেলা বলতে যা বোঝায় নাগরদোলা, টয় ট্রেন ছাড়া সবকিছুই হাজির ছিল। কে কে ছিল ভাবতে গিয়ে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়– কাউকে আর খুঁজে পাই না দু’-একজন ছাড়া।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: যে কবিতা শোষিতের পাশে দাঁড়ায়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছোট পত্রিকার স্টলকে এখনকার মতো একঘরে করে দেওয়া হয়নি। বইয়ের স্টলের আশপাশেই তারা থাকতে। শেখর বসু, রমানাথ রায়রা দিতেন ‘এই দশক’ পত্রিকার স্টল। সেখানেও একটু দাঁড়াতে হত। অনেকে পত্রিকার ডালি বেঞ্চের ওপর সাজিয়ে লোক ডাকতেন, কিছু ছোট ছোট পত্রিকার দফতর থেকে জোর করে গছানো হত বই– অভিযোগ করতেন তাঁরা, তাঁদের উপেক্ষা করা হয় বলে। তখন নাম-করা পাঠক-টানা লেখকও ছিলেন প্রচুর– সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যাায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, শক্তি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ভাস্কর চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে। চিনতে পেরে পাঠকরা এসে তাঁদের ধরে সই করাতেন। অনেক মজার ঘটনাও ঘটত এর মধ্যে। একবার একজন এসে শক্তিপদ রাজগুরুর বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে সই করাবেনই, তিনি শুনেছেন এঁর নাম শক্তি তাই। নাছোড়বান্দা ভদ্রলোকের পদবিতে কিছু যায় আসে না। অনেক কষ্টে তাকে ফেরানো হয়েছিল। রাত ন’টায় ঘণ্টা পড়ত বইমেলা শেষ হওয়ার। তখন সম্মিলিত চিৎকারে কান পাতা দায়।
প্রতি বছর মেলার আয়তন বৃদ্ধি হয়, আর পরিবেশবিদদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে বইমেলা, ধুলোর দূষণ, রাতে আলো, মাইকের আওয়াজ গাছের ক্ষতি– আরও নানাবিধ কারণ। তথ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহযোগিতার হাত থাকায় উচ্ছেদ হতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। তবে তখন থেকেই খাবার দোকান বাড়ল, ভিড়ের জন্য ধুলো বাড়ল, ভিড়ে লোকজন, বিশেষত বাচ্চারা বেশি হারাতে শুরু করল। ধুলো ভেজানোর জন্য জল ঢালার কাজও শুরু হল। নিখোঁজদের নাম ধরে মাইকে ডাকতেন আত্মীয়রা। শক্তি আবার মাঝে মাঝেই মাইক দখল করে বাবা মা-কে সচেতন থাকতে বলে ঘোষণা করতেন, ‘বাচ্চারা হারিয়ে গেলে আমার একটুও ভাল লাগে না।’ প্যারাডক্স একেবারে! নিজের বাচ্চাকে লোকের বাড়িতে, অফিসে ফেলে আসতে যে অভ্যস্ত তার মুখে এই ঘোষণা! একবার বইমেলার গেট সাজানোর দায়িত্বে ছিলেন আমাদের বন্ধু আর্কিটেক্ট শোভনলাল বোনার্জী। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর কবিতার ছবি দিয়ে তৈরি হয়েছিল বিরাট কাটআউট। সে এক হইহই ব্যাপার। কী সুন্দর যে লাগত।
এর মধ্যে ছেলেমেয়েরা একটু একটু করে বড় হয়ে উঠে গল্পের বই পড়ার স্বাদ পেতে শুরু করেছে। অফিস থেকে বাড়ি গিয়েই ওদের নিয়ে যাই মেলায়। ওদের বাবা ওদের ছেড়ে দিয়ে বলত ঘুরে-ফিরে ঠিক এই জায়গাটায়, অর্থাৎ গোল চত্বরে এসে দাঁড়াবে। ওরাও ভারি খুশি হয়ে ওদের টাকায় পছন্দমতো বই কিনে চলে আসত। অসুবিধা একটু হতই, কিন্তু এ তো আমাদের তীর্থস্থান, ওদের চেনাতেই হবে। শক্তির আনন্দবাজারের এক বন্ধু বিক্রমন নায়ার, তিনিও ওদের নিয়ে বইমেলায় যেতেন, প্রতি বছর ওদের বইকেনার বরাদ্দ টাকাও দিতেন। তিনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ওদের শিক্ষার ভার তখন ওঁর ওপরেই ছিল।
বইমেলা ইতিমধ্যে ঠাঁইনাড়া হয়েছে ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি। তার আগে ময়দানের আগুন লাগার ঘটনাটা লিখতে হবে। ১৯৯৭ সাল, শক্তি চলে গেছে চিরতরে। আমিও বইমেলায় যাই না তেমন। একদিন হঠাৎ শুনলাম বইমেলায় আগুন ধরেছে, অনেক স্টল পুড়ে গিয়েছে, সব ওই খাবারের দোকানের কল্যাণে। অনেক স্টল পুড়ে গিয়েছিল, প্রচুর বইও। সম্ভবত একজন মারাও গিয়েছিলেন। মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই পোড়া মেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য পোড়া বই নিলাম করলেন। সুনীলের উপন্যাস চার হাজারে বিক্রি হয়েছিল, আর শক্তির মৃত্যুর পর নানা পত্রিকা থেকে জোগাড় করে নিয়ে যে কবিতার বইটি বের করেছিলাম– ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’, সেটি আমেরিকা প্রবাসী নূপুর লাহিড়ি বলে এক মহিলা তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত থেকে সর্বোচ্চ দামে ৭৫০০ টাকায় কিনে নিলেন। সেই ছবিটি ঘটনা-সহ আজকাল সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল, আমার কাছে কর্তিকা রেখে দিয়েছিলাম। পরদিন কাগজে খবর, ‘পোড়া বই ছবির নিলামে অত্যাশ্চর্য সমাপ্তি।’ ফিনিক্স পাখির মতো বইমেলা আবার জেগে উঠেছে। সুনীলের না পোড়া বইও পাঁচ হাজারে কিনে নিলেন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ। কাগজ, লিখল, ‘আগুন পোড়াতে পারেনি মানুষের ভালোবাসা’। এরপর রান্না করা খাবার নিয়ে আসতে হত, বইমেলায় আর উনুন জ্বলত না। মেলা কর্তৃপক্ষ থেকেও সরকারি সাহায্যে দেওয়া হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের।
বইমেলা সরে গেল আরও পশ্চিমে ভিক্টোরিয়ার কাছে। আমার অফিস ছিল পার্ক স্ট্রিটে। তাই সময় বাঁচল মেলায় যাওয়ার, তবে ওখানে অত জায়গা ছিল না, বইমেলার জায়গাটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। ময়দানের সবুজ গাছপালা ভরা মনোরম আবহাওয়া বড় প্রিয় ছিল, বন্ধুরা ছাড়াও একা একা ঘুরতেও খুব ভাল লাগত। কিন্তু ধুলোর দূষণ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দূষণের কারণ হতে পারে, গাছেদের ক্ষতি হচ্ছে, মানুষেরও, অতএব বইমেলা ময়দান ছেড়ে সরে এল পূর্বদিকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের ধারে ২০০৭ সালে। তখন শক্তি চলে গেছে, পুরনো বন্ধুরাও অনেকে নেই, বইমেলা যাওয়ার উৎসাহটা অনেক কমে গিয়েছে– তবু যাই, কিন্তু কেমন অচেনা লাগে, পরিবেশ বদলে গেছে। সেটা ২০০৭ সাল, বিশ্বজ্ঞান-এর প্রকাশক আমাদের পরম আত্মীয় দেবকুমার বসু কিছু প্রকাশকদের সঙ্গে সভা করার জন্য পুরী গিয়েছেন শুনলাম। কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না, পুরীতেই আকস্মিক হৃদরোগে আমাদের সমুদ্র-হৃদয় দেবুদা সমুদ্রে বিলীন হলেন। তিনি যে শুধু আমাদের আপনজন ছিলেন তা নয়, শক্তিকে ক্রমাগত তিন বছর ধরে তাগাদা দিয়ে বারবার কবিতা বদল, প্রচ্ছদ বদলের ঝক্কি সামলে, ওর প্রথম কবিতার বই ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ তিনিই প্রকাশ করেছিলেন। তাই কবিতার পাঠকরাও তাঁর কাছে ঋণী।
২০০৯ সালে বইমেলা আবার সরে গেল মিলনমেলা প্রাঙ্গণে। ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ তার অনেক আগেই বইমেলা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। ওখানে বইমেলা ২০১৬ পর্যন্ত চলেছিল। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তখন বইমেলায় ঘোরাঘুরি করে, বিপুল ভিড় সেখানে, সেই ঘরোয়া বইমেলা আর নেই। অত ভিড়ের মধ্যে ছেলেমেয়ে ছোট ছোট নাতিনাতনিকে নিয়ে ঘুরেছি, বাচ্চাদের পছন্দমতো কিছু বই কিনে দিয়েছি, কিন্তু দুঃখের কথা– এরা বই পড়তে ভালোবাসে না। বইমেলার বড় অংশ জুড়ে বিশাল ‘ফুডকোর্ট’, এরা তাতেই বেশি উৎসাহী। ২০১২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন। পরের বছর আমার ছেলে ও তার বন্ধুরা এবং বইমেলা উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে সুনীলের নামে একটি প্যাভিলিয়ন সাজাল। ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সুনীলের বেশ কিছু ছবি দিয়েছিলাম। আমার শারীরিক অবস্থা তার দু’-তিন বছর থেকেই স্থিতিশীল ছিল না, হাঁটতে গেলে লাঠি লাগে। তবুও সুনীল ও শক্তির বন্ধুত্বের দিনগুলোর কথা ভেবে অশক্ত শরীরে ছেলের হাত ধরে মেলায় গেলাম। ‘এখন খেলা বদলে গেছে’ আগে আমি ওকে হাত ধরে মেলায় ঘুরিয়েছি, এখন ও আমায় নিয়ে আসে।
২০১৬ সালের পরে বইমেলা আবার ঠাঁইনাড়া হয়ে আমাদের বাড়ির কাছে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে স্থানান্তরিত হল। সরকার থেকে ঘোষণা করা হল, বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা হল এই জায়গাটি। খুব ভালো লাগল বইমেলা বেচারিও তো বুড়ো হতে চলল সে আর কতবার জায়গা বদল করবে দৌড়ে দৌড়ে– এতদিনে তার যাযাবরবৃত্তি ঘুচল! শক্তির ওপর একটা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম, আমার মেয়েরও সেখানে বলার কথা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ গোলমালের জেরে ও বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। উদ্যোক্তারা অবশ্য যত্ন করে স্টেজে বসিয়ে শক্তির ছবি-সহ নানা উপহার দিয়েছিলেন। সেই শেষ আমার বইমেলা দর্শন। না হেঁটে বইমেলা ঘোরা যায় না, শক্তি দরকার, বিপুল উৎসাহ আর শারীরিক সামর্থ্য– এর কোনওটাই এখন আমার নেই, তবু এখনও বইমেলা আসার সময় এলেই প্রিয় সমাগমের আনন্দ পাই। কাগজে, পত্রিকায় কত লেখক, কবির বই প্রকাশের খবর দেখি, এই উপলক্ষে কত পত্রিকা বের হয়, হাতে পেলে তাই খুঁটিয়ে পড়ি– ‘মধ্যাভাবে গুড়ং দইদ্যাৎ’। বইমেলা এখন বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক বিনোদন, ছোট থেকে এখন সে বিরাট মহীরূহ– আমি আর তার নাগাল পাই না।