আবেগে ব্যাকুল হয়ে লেখা ছুটিয়ে গেলেই যে ভাষার উপর অধিকার জন্মায় না, জানতেন অশোক মুখোপাধ্যায়। সেই অধিকার অর্জনের জন্য হন্যে হতেন। তবু সেই অধিকারের সগর্ব দাবি কোনও দিন করেননি। বরং নিজেকে আড়ালে রেখে সেই অধিকার যাতে সাধারণের মধ্যে, সাধারণের মতো করে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার চেষ্টা করতেন। তারই তো ফসল সমার্থ শব্দকোষ, বানান অভিধান, ব্যাকরণ অভিধান।
বাংলা ভাষার প্রায় অদ্বিতীয় থিসরাস ‘সমার্থ শব্দকোষ’-এর প্রণেতা অশোক মুখোপাধ্যায় (১৯৩৮-২০২৩) প্রয়াত হলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায় এলই না। ফেসবুকে কিছু চর্চা হল অবশ্য। বোঝা গেল, তাঁর মৃত্যু যত শূন্যতা তৈরি করল ব্যক্তিগতের হৃদয়পুরে, তত বিখ্যাত তিনি ছিলেন না বাংলা ভাষার এই উদ্যাপিত রাজধানীতে।
এই রাজধানীতে বাংলা ভাষা এখনও মোদের গর্ব, মোদের আশা। তবু সে আমাদের খুব নিষ্ঠাবান চর্চার বিষয় হয়ে নেই আর। নানাবিধ সমাজমাধ্যমে আমরা অনেকেই আজকাল প্রচুর বাংলা লিখি। আমাদের ছুটলে লেখা থামায় কে। লেখার বানান এবং রীতি কোনও বিষয়েই আমরা একটুও থমকাই না, দু’দণ্ড ভাবি না যে এই বানানটা এমন করে লিখব কেন, প্রকাশের ভাষাটা একটু অন্য হলে ভাল হত কি!
অশোক মুখোপাধ্যায়রা ভাবতেন। আবেগে ব্যাকুল হয়ে লেখা ছুটিয়ে গেলেই যে ভাষার উপর অধিকার জন্মায় না, জানতেন। সেই অধিকার অর্জনের জন্য হন্যে হতেন। তবু সেই অধিকারের সগর্ব দাবি কোনও দিন করেননি। বরং নিজেকে আড়ালে রেখে সেই অধিকার যাতে সাধারণের মধ্যে, সাধারণের মতো করে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার চেষ্টা করতেন। তারই তো ফসল সমার্থ শব্দকোষ, বানান অভিধান, ব্যাকরণ অভিধান। সে কারণেই, তাঁর অভিধানগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয় হলেও তাঁকে নিয়ে তাঁর অনুরাগী বিবেক গুহ কিছুদিন আগে যে বই প্রকাশ করলেন, তার কথা জনসমক্ষে প্রায় এলই না।
অশোক মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ তাই বঙ্গসংস্কৃতির সমষ্টিতে কোনও ছাপই হয়তো ফেলল না। কিন্তু এই প্রয়াণ সত্যিই বাংলা ভাষাচর্চার একটি ধারাকে থমকে দিল। অথচ, বাংলা ভাষাচর্চা তাঁর পেশাগত দায়বদ্ধতা ছিল না। ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, পরে হয়েছিলেন প্রকাশক, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ। সেসব দায়িত্ব থেকে অবসর পেয়েছেন বহু বছর। তবু থেমে ছিলেন না। খুব বড় করে একটা কাজে হাত দিয়েছিলেন। বাংলা লিখনরীতির একটি সহায়ক সম্পাদনার কাজে। শেষ হলে সে কাজ হয়তো বাংলা ভাষার ‘শিকাগো ম্যানুয়্যাল’ হত। তাঁর মৃত্যু কাজটিকে অসমাপ্ত রেখে গেল। এ নিশ্চয়ই আমাদের গভীর ক্ষতি। সে ক্ষতির দায় আমাদেরই।
আরও পড়ুন: ‘সমার্থশব্দকোষ’ ব্যবহারের জন্য ভাষার পূর্বজ্ঞান জরুরি, বলেছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়
দায়টা এখানে যে, এমন বিশাল মহাকাব্যিক কর্মকাণ্ডও এ দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগেরই মুখ চেয়ে বসে থাকে। কারণ এ কাজের উপযোগিতার কোনও বাণিজ্যিক মূল্য নেই। আমাদের ভাষা সম্পর্কে আমরা বিস্ময়কর জয়গানে মুখর, আশ্চর্য আবেগাকুল, কিন্তু সে ভাষারই বানান-টানান, রীতি-টিতি নিয়ে আমরা অদ্ভুত উদাসীন। বাংলা প্রকাশনার দুশো বছরেরও বেশি সময়পর্বে দু’-একটি সরকারি এবং একটি-দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ-ই লিখন-সম্পাদন-মুদ্রণে কোনও হাউস-স্টাইলের ধার ধারে না। বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, সাহিত্য সংসদ– আঙুলের হয়তো আর দু’-একটি কড়েই গণনা সমাপ্ত হবে, নিশ্চিত করে বলা যায়।
সুতরাং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, পুলিনবিহারী সেন, অশোক মুখোপাধ্যায় এই ব্যক্তি-বনস্পতিরাই আমাদের ভরসা। এঁদের আয়ুষ্কাল নিরবধি নয়, সুতরাং এঁদের ভরসাও সামান্যই। সরকারি উদ্যোগেও ভাষা আর অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা বিদ্যাচর্চায় গবেষণার বিষয় হিসেবে ভাষাচর্চার অংশ খুব কম। কারণ ওইসব গবেষণার সঙ্গে পদোন্নতি এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে যে, ভাষাচর্চার বিপুল শ্রম এবং সময় স্বীকার করতে চান না অনেকেই। তাই, ওই একজন-দু’জনই ভরসা ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি এক আশ্চর্য অহৈতুকী ভালবাসার বশে অশোক মুখোপাধ্যায় ওই দু’-তিনজনের একজন হতে চেয়েছিলেন। কাজ করে চলেছিলেন বাংলা ভাষার লিখন-সহায়ক তৈরির দিকে। তারই একটু আলোচনার শেষে ‘যা পেরেছি, তা-ই পারি’ নামের একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘এই যে কতগুলো উদাহরণ বিক্ষিপ্তভাবে নিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছিলাম, তাদের সম্পূর্ণতা দেওয়া গেলে একটা বড়োসড়ো বই হতে পারে। যেমন নাকি কেমব্রিজ ম্যানুয়্যাল, শিকাগো ম্যানুয়্যাল। বাংলাতে এই ধরনের একটা বইয়ের খুব প্রয়োজন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ইজ এ পার্ট অব দ্য ইউনিভারসিটি অব কেমব্রিজ, যার কাজ হল বিদ্যার প্রসার ঘটানো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হয়নি। আর তা থেকেই সিদ্ধান্ত করা যায় তারা উৎসাহিত হবে না। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিও হবে বলে মনে হয় না। ওদের প্রেফারেন্সের তালিকায় এ জিনিস নেই। ফলে কোনো একজন দুজনকেই করতে হবে এ কাজ। তাঁকে করে দেখাতে হবে যে তিনি এ কাজ পারেন। উল্টোটাও হতে পারে, তাঁর কাজ দেখে মনে হতে পারে যে, কাজটা করেই তিনি প্রমাণ করলেন যে ও কাজটা তিনি পারেন না।’
আমরা পারব কি? যদি পারি, তাহলে অশোকবাবু মরেও প্রমাণ করতে পারবেন যে তিনি মরেননি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved