
ফ্রানচেস্কা অরসিনি। ২০ অক্টোবর, তাঁকে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রবেশাধিকার নেই। নিয়মের গেরো? নাকি অরসিনির হিন্দিভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণা জাতীয়তাবাদীদের একমাত্রিক হিন্দি চাপানোর পথকে বন্ধুর করে তুলছিল?
ফ্রানচেস্কা অরসিনি-র নাম বা তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচয় ভারতের বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। তিনি আজীবন উত্তর ভারতের ভাষা (মূলত হিন্দি), সাহিত্য ও ছাপা-সংস্কৃতি (প্রিন্ট কালচার) নিয়ে গবেষণা করেছেন, লিখেছেন বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ, অধ্যাপনা করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এ। তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দ্য হিন্দি পাবলিক স্ফিয়ার’, ‘১৯২০-১৯৪০’ (২০০২), ‘প্রিন্ট অ্যান্ড প্লেজার’ (২০০৯), ‘ইস্ট অফ দিল্লি’ (২০২৩)। তাঁর কাছে ঔপনিবেশিক ভারতের ভাষা ও ছাপা-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকরা লাভবান হয়েছেন, প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই আর প্রবন্ধ।

গত দুই-তিন দিন এই বিদেশিনী অধ্যাপক ভারতের কিছু খবরের কাগজ আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছেন। তবে তাঁর কোনও বই বা বক্তৃতার জন্য নয়। বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও ২০ অক্টোবর তাঁকে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে বিলেত ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতে তাঁর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে নাকি গত মার্চ মাস থেকে! তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। কেন তাঁকে ‘কালো তালিকায়’ রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কোনও ধারণা নেই তাঁর। সরকারের তরফ থেকেও এখনও অবধি স্পষ্টভাবে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। কিছু মহলে আন্দাজ করা হচ্ছে যে, তিনি ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ নিয়ে গত বছর ভারতে এসে কিছু জায়গায় নিজের গবেষণা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা সেই ভিসার নিয়ম বহির্ভূত, সেই ‘অপরাধে’ তাঁর এই শাস্তি।
…………………………………….
পড়ুন: বাংলা ভাষার মুকুট আছে, পরনে বস্ত্র নেই
…………………………………….

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এ রকম আদান-প্রদান হয়ে থাকে। তবে নিয়মের নিগড় এখন বড়ই কড়া! গবেষণার জন্য আলাদা ভিসা হয় ঠিকই, কিন্তু তার জন্য সেই অন্য দেশের নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়, সেখান থেকে আমন্ত্রণ প্রয়োজন হয়। অনেক সময়েই গবেষকরা নিজেদের কাজের জন্য বারবার ফিরে যান অন্য দেশে, পড়াশোনা করেন সেখানের লাইব্রেরিতে, কথাবার্তা বলেন সেই দেশের ছাত্র-অধ্যাপকদের সঙ্গে। ‘রিসার্চ ভিসার’ জন্য যে নির্দিষ্টতা দরকার হয়, তা সবসময়ে থাকে না। ভারতের গবেষকরাও এইভাবে বিদেশে যান, নিজেদের কাজের প্রয়োজনে।
…………………………….
আরও পড়ুন: হীনম্মন্য বাঙালি সমাজে শব্দের প্রমোশন হয় মূলত ইংরেজি বা হিন্দিতে
…………………………….
অরিসিনির গোটা ঘটনায় ভারতের বেশ কিছু ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যের অধ্যাপক যারপরনাই অবাক হয়েছেন, রেগে গিয়েছেন। ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। স্বাভাবিক। খানিক শ্লেষ মিশিয়ে কয়েকজন মন্তব্য করেছেন যে, অরসিনির মতো গবেষক, যিনি হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এমন প্রামাণ্য কাজ করেছেন গত তিন দশক ধরে, তাঁকে তো আজকের ভারতে আরও অনেক সানন্দে আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল!

সমস্যাটা বোধহয় ঠিক এখানেই! হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে যারা ব্যস্ত, তাদের দায় নেই সেই ভাষার সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার, প্রয়োজন নেই তার রূপরেখা বা বিবর্তন বোঝার। তাহলে ভাষার চর্চা হবে, গা-জোয়ারি চালানো মুশকিল হবে। অরসিনি হিন্দি, উর্দু, ফারসি সাহিত্য, হিন্দির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা আরও অনেক ভাষার চলন গঠন, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দির সামাজিক পরিসর রচনা নিয়ে কথা বলেন, যেখানে ভাষা ও সংস্কৃতি কোনও জড় বস্তু বা ধারণা নয়, বরং সদা চলমান প্রক্রিয়া। এই চিন্তাভাবনা আজকের ভারতে একমাত্রিক হিন্দি জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা নিয়ে কথাবার্তায় বিশেষ অন্তরায়। তাই অরসিনির লেখা বা গবেষণার সঙ্গে পরিচয়ের প্রয়োজন নেই সেই হিন্দির প্রবক্তাদের।
……………………………………………….
হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে যারা ব্যস্ত, তাদের দায় নেই সেই ভাষার সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার, প্রয়োজন নেই তার রূপরেখা বা বিবর্তন বোঝার। তাহলে ভাষার চর্চা হবে, গা-জোয়ারি চালানো মুশকিল হবে। অরসিনি হিন্দি, উর্দু, ফারসি সাহিত্য, হিন্দির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা আরও অনেক ভাষার চলন গঠন, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দির সামাজিক পরিসর রচনা নিয়ে কথা বলেন, যেখানে ভাষা ও সংস্কৃতি কোনও জড় বস্তু বা ধারণা নয়, বরং সদা চলমান প্রক্রিয়া।
……………………………………………….
এই প্রবণতা এখন সর্বত্র। সমাজশিক্ষায় পেশাদার গবেষকের কী ভূমিকা– এই নিয়ে সবাই বেশ দু’-চার কথা বলেই থাকেন। কারও কারও মতে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন পড়ে কোনও লাভ নেই, ওতে চাকরি-বাকরি নেই, শুধু সরকারের পয়সা আর জনগণের ট্যাক্সের নয়ছয়! আর সিনেমা, রিল, পডকাস্ট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তো দিব্যি সব জানা যাচ্ছে! সেসবের জন্য আবার কিছু লোককে মাইনে-পত্তর দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষার কোনও যুক্তি নেই। অবিশ্যি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে রীতিমতো ‘এক্সপেরিমেন্ট’ চলছে, তার ফল আর কয়েক দশকেই পাওয়া যাবে, আশা করা যায়! মোদ্দা কথা হল, সাহিত্য বোঝার জন্য বা ইতিহাস জানার জন্য বিশেষজ্ঞের দরকার নেই, ও এমনিই জানা যায়। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদ্ভুত প্রাদেশিক চিন্তাভাবনা। বিদেশিরা আবার ভারত নিয়ে কী কথা বলবে? আমাদের থেকে ওঁরা বেশি জানে? ওঁরা সবসময়ে ভারতের খারাপই দেখে, কোনও ভালো কথা বলে না!

তবে এই ‘সংকট’ শুধু ভারতের নয়, বিশ্ব জুড়েই এখন এই আবহাওয়া। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যাগুরুবাদ যে কোনও জাতি-রাষ্ট্রের ‘ইতিহাস’ নিয়ে সচেতন। সেখানে প্রয়োজন হয় একমাত্রিকতার। ‘বিভিন্নতা’ নয়, শুধুই ‘বিভেদ’ নিয়ে এদের মাথাব্যথা। অরসিনিকে দিল্লি এয়ারপোর্টে বাধা না দিলে এত সব কথা উঠত না। খানিক অজান্তেই উনি খবরের শিরোনামে চলে এসেছেন। কিন্তু আজ ওঁকে আটকেছে, আগামিকাল অন্য কাউকে আটকাবে। তাই কথাগুলো এ সময় আউড়ে নেওয়া ভালো।
…………………………………..
এই লেখকের অন্যান্য লেখা পড়ুন এই লিংক থেকে: কৌস্তুভ মণি সেনগুপ্তর সমস্ত লেখা
…………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved