Robbar

রাজনৈতিক বিরোধিতার থেকেও জোরাল কৃষক আন্দোলনের ঢেউ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 25, 2024 9:05 pm
  • Updated:February 25, 2024 9:05 pm  

কৃষির কর্পোরেটাইজেশনে উন্নয়নশীল কোনও দেশের আজ পর্যন্ত মঙ্গল হয়নি। বরং খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামছাড়া হয়েছে, কৃষকের জীবিকা সংকটাপন্ন হয়েছে ও কৃষিক্ষেত্রে কাজের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। আজ যেখানে দেশে বেকারত্ব লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে, কর্মসংস্থানের সম্ভবনা কমছে, সেখানে যদি কৃষিক্ষেত্রের মতো প্রধান ক্ষেত্রে কর্ম-সম্ভবনা ভবিষ্যতে আরও কমে যায় তাহলে দেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে এতে কোনও সন্দেহ নেই।

মানস ঘোষ

দেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন প্রায়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দিন ঘোষণা হবে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের। অনেকেই মনে করছেন, এই নির্বাচনে রামমন্দির-ইস্যুই প্রধান। কিন্তু বাড়া-ভাতে ছাই দিয়ে শম্ভু সীমান্তে কৃষকরা আরও একবার জমায়েত হয়েছেন, ডাক দিয়েছেন ‘দিল্লি চলো’। গত কয়েক দিনের ঘটনাক্রম বলছে, হরিয়ানা সরকার এবং দিল্লি-পুলিশের রাতের ঘুম ছুটে গেছে। কৃষকের এই আন্দোলনে হরিয়ানা সরকার প্রাণপণে আন্দোলনকারীদের বাধা দিচ্ছে, যাতে তাঁরা রাজধানীতে পৌঁছতে না পারে। কৃষকের প্রাণহানি ঘটেছে। পাঞ্জাব-হরিয়ানার খানৌরি সীমান্তে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিয়েছেন তরুণ কৃষক শুভকরণ সিং। প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ডাকে আন্দোলনকারী কৃষকরা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ পালন করলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগামী কয়েকদিনে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বহু ব্যক্তি ও সংগঠন শম্ভু সীমান্তের দিকে যাত্রা করবেন এরকম আভাস মিলছে।

সরকার পক্ষের অনেকে বলছেন, এই আন্দোলনের পিছনে নির্বাচনী-স্বার্থ কাজ করছে। ফলে গত ২০২০-’২১-এর কৃষক আন্দোলনের সময় যেমন তাঁদের ‘আন্দোলনজীবী’ তকমা জুটেছিল, হয়তো এবারেও তেমন কিছু জুটবে। বলা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে শাসককে প্যাঁচে ফেলার উদ্দেশ্যে এই বিক্ষোভ শুরু করা হয়েছে। বস্তুত, গত পাঁচ বছরে কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটাইজেশনে কেন্দ্রীয় সরকারের যেরকম উৎসাহ আমরা দেখেছি, তাতে কৃষকের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি-বিল আন্দোলনের চাপে প্রত্যাহার করলেও অনেকেরই আশঙ্কা– আবার ক্ষমতায় এলে তারা আরও ভয়ঙ্কর রূপে কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটাইজেশনের চেষ্টা করবে। কৃষকের এই আন্দোলন দেশের কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের হাত থেকে বাঁচানোর এক হার-না-মানা প্রয়াস হিসেবেই ধরতে হবে। কারণ কৃষির কর্পোরেটাইজেশনে উন্নয়নশীল কোনও দেশের আজ পর্যন্ত মঙ্গল হয়নি। বরং খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামছাড়া হয়েছে, কৃষকের জীবিকা সংকটাপন্ন হয়েছে ও কৃষিক্ষেত্রে কাজের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। আজ যেখানে দেশে বেকারত্ব লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে, কর্মসংস্থানের সম্ভবনা কমছে, সেখানে যদি কৃষিক্ষেত্রের মতো প্রধান ক্ষেত্রে কর্ম-সম্ভবনা ভবিষ্যতে আরও কমে যায়, তাহলে দেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।

What's behind the farmers' protests that are blocking highways in India | CBC News

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

২০১৯ সালে মোদি’র দল ভোট জেতার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা হবে। বাস্তবের চিত্রটা দাঁড়াল, লোকসানের মুখে পড়ে ঋণজর্জর একের পর এক কৃষককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল। এবং সরকার সেখানে নির্বিকার থাকল। তাই কৃষকের কাছে আজ দুটো রাস্তা খোলা– আত্মহত্যা অথবা আন্দোলন।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটাইজেশনের আরও একটা বিপদ আছে, তা হল– পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি। বেদব্রত পাইনের সাম্প্রতিক তথ্যচিত্র ‘দেজা ভ্যু’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কৃষির কর্পোরেটাইজেশন কীভাবে কর্মসংস্থান কমায় এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। বেদব্রত’র ছবিটি দু’টি দেশের কৃষি ও কৃষকের তুলনা করেছে। সম্পূর্ণ কর্পোরেটাইজড আমেরিকার কৃষিক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা দেখিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন কীভাবে কর্পোরেট সেদেশের কৃষি ব্যবস্থা, গ্রামীণ পরিবেশ ও কৃষককে ধ্বংস করেছে। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে এদেশের কৃষক আন্দোলন কতটা যুক্তিসঙ্গত ও দূরদর্শী, তা আলোচনা করেছেন তিনি। কৃষি-বিল তিনটি কী ভয়ানক ভবিষ্যতের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছিল, তা বোঝা যায় তথ্যচিত্রটি দেখলে!

DEJA VU - FilmFreeway
বেদব্রত পাইনের তথ্যচিত্র ‘দেজা ভ্যু’

এসব আশঙ্কার কথা আপাতত থাক, আমরা আবার ফিরে আসি আজকের পরিস্থিতিতে। এখন কৃষকের ক্ষোভের প্রত্যক্ষ কারণগুলো কী? দু’বছরের বেশি সময় টানা আন্দোলন ও অবস্থানের পর ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্র সরকার তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করে, কৃষকরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যান। কিন্তু তাঁদের ওপরে যেসব কেস দিল্লি-হরিয়ানার পুলিশ ও সরকার চাপিয়েছিল, সেগুলি প্রত্যাহার করা হয়নি। ফলে চাপে পড়ে বিলগুলি ফেরত নিলেও সরকারের সদিচ্ছা বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আইনি জটিলতায় কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের নাস্তানাবুদ করে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার মানসিকতাকে বরদাস্ত করা কৃষকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাঁরা যদিও অকুতোভয়, তবু কেসগুলি তুলে নেওয়ার দাবিতে আবার পথে নামা দরকার ছিল। সেটা তাঁরা করেছেন। এমনকী, বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলি বিধানসভায় কেন্দ্রের কৃষি-বিলের প্রয়োগ আটকাতে যেসব বিল পাশ করেছিল, সেগুলি রাজ্যপালদের সাহায্যে আটকে দেওয়ার কৌশল নিল কেন্দ্র। অবশেষে দু’বছর আগে কৃষি বিলগুলি প্রত্যাহার করার সময় কেন্দ্র সরকারের দিক থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, কৃষক মান্ডির সংখ্যা বাড়ানো হবে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে চাল-গম কেনার প্রক্রিয়াকে সরকার আরও শক্তিশালী করবে। বাস্তবে তা হয়নি। বলা হয়েছিল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের টাকার পরিমাণ বাড়ানো হবে। কারণ, এখন যে নির্ধারিত মূল্য দেওয়া হয়, তাতে জমির খাজনা, চাষের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ, বস্তার দাম, বহনমূল্য ধরা হয় না, যা চাষির পকেট থেকে যায়। সেগুলো ধরে নতুন সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করার কথা ছিল। সে কাজও কিন্তু সরকার করেনি। ২০১৯ সালে শাসক দল ভোট জেতার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা হবে। বাস্তবের চিত্রটা দাঁড়াল, লোকসানের মুখে পড়ে ঋণজর্জর একের পর এক কৃষককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল। এবং সরকার সেখানে নির্বিকার থাকল। তাই কৃষকের কাছে আজ দুটো রাস্তা খোলা– আত্মহত্যা অথবা আন্দোলন।

Farmers' Protest – Peace is Everybody's Business
ছবি ঋণ: ইন্টারনেট

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আরও পড়ুন: রায়বরেলিতে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়ালে সত্যি হবে ‘তিন প্রজন্মের মিথ’

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

গতবারের আন্দোলনে জয়যুক্ত হওয়ার পরেও তাঁরা কিন্তু ‘চেতাবনি’ দিয়েছিলেন, সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন না করা হলে তাঁরা আবার অবস্থান-বিক্ষোভের পথে হাঁটবেন। কেন্দ্রীয় সরকার কথা দিয়ে কথা না রাখার যে ঐতিহ্য, তা পালন করেছে, কৃষকরা কিন্তু প্রতারিত হলে আবার ফিরে আসার যে প্রতিশ্রুতি দেশের মানুষকে দিয়েছিলেন, তা রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে রক্ষা করছেন। অর্থাৎ এক জুমলাবাজ শাসকের প্রকৃত প্রতিপক্ষ হিসেবে তাঁরা নিজেদের দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার ও তার দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজ্য সরকারগুলি আন্দোলনকারী কৃষকের ওপর যে এতটা খড়্গহস্ত, এটাই তার প্রধান কারণ। বস্তুত দেশের রাজনীতিতে যখন শাসক দলের অন্য সব প্রতিপক্ষ হয় হতাশ অথবা ছন্নছাড়া, তখন একমাত্র কৃষকরা আত্মবিশ্বাসী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এর গুরুত্ব বিরাট। সবচেয়ে বড় কথা, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হল, তাদের সেট করা এজেন্ডায়, তাদের মাঠে তারা বিরোধীদের খেলতে বাধ্য করে। ফলে তাদের জয় শুরুতেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কৃষক আন্দোলন এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম। তাঁরা মোটেই ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডায় নেই, বরং উল্টোটা ঘটিয়েছেন। সরকার প্রাণপণে এড়িয়ে যেতে চায় এরকম বিষয়ে সরকারকে তাঁরা টেনে এনেছেন। এখানেই কৃষক আন্দোলনের রাজনৈতিক শক্তি যা জুমলাবাজ শাসকের জন্য অস্বস্তিকর ও ভীতিপ্রদ। তার প্রমাণও আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি। শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। ড্রোন থেকে নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস আর ‘স্মোক বম্ব’ ফেলা হচ্ছে। গুলি আর লাঠি চলছে। কৃষকের পিঠ রক্তাক্ত হচ্ছে। এই বেপরোয়া আক্রমণ বুঝিয়ে দিচ্ছে, কৃষক আন্দোলনকে তারা কতটা ভয় পাচ্ছে।

যাঁরা কৃষক আন্দোলনের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে চান, তাঁরা ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারেন। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের কথা মনে পড়বে, মনে পড়বে চম্পারণ, খেড়া ও বরদোলৈ-এর কথা। ভারতে কৃষক আন্দোলনের বিরাট ঐতিহ্য আছে, যার ধাক্কায় অতীতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সব শাসকের বুকে কাঁপন ধরেছে। এবারের কৃষক আন্দোলনের অভিঘাত দেশের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা অচিরেই বোঝা যাবে। তবে তা যে ইতিমধ্যেই শাসকের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে, হতোদ্যম প্রতিবাদীদের মনে সাহস আর স্ফূর্তি এনে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

কার্ডের ছবিটি শিল্পী হিরণ মিত্রের