গায়ত্রীদির উদ্যোগে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনফারেন্স হল কলকাতায়। বিষয় ছিল– এই পোস্ট-কলোনিয়াল যুগে কলোনিয়াল আমলের স্থাপত্যের আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না! সেই নিয়ে কথা বলতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অধ্যাপকের দল এলেন। তাঁরা উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও ঔপনিবেশিক স্থাপত্য নিয়ে বহু গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বললেন। কনফারেন্স উতরে যাওয়ার পর একদিন গায়ত্রীদির সঙ্গে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরচ্ছি– উনি বললেন, ‘কলোনিয়াল স্ট্রাকচারের তাৎপর্য নিয়ে এরা কথা বলছে, অনেক থিয়োরি বেরচ্ছে; কিন্তু আমি ওদের বলেছি– আরে বাপু ওই বড়-বড় গাড়িবারান্দাওয়ালা স্ট্রাকচারগুলো আছে বলে আমাদের শহরের রিকশাওয়ালা, মজুররা তার তলায় রাতে ঘুমোয় সারা বছর। ওগুলো ওদের মাথার ওপরের ছাদ।’
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে সিগাল বুকস-এ কাজ করার সময়। সেটা শূন্য দশক। তাঁর সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন একটা স্বাভাবিক জড়তা, আড়ষ্টতা ছিল আমার। একজন ওই মাপের সুপণ্ডিত, বাগ্মী মানুষের সামনে খুব সহজেই নিজের ক্ষুদ্রতা ও অগভীরতা প্রকাশ পায়। এতে মন গুটিয়ে ফেলতে চায় নিজেকে। প্রথমে আমারও খানিক তেমন হয়েছিল। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল তত দেখলুম যে ব্যক্তি হিসেবে তিনি অতীব তেজস্বী ও মেধাবী হলেও তাঁর মধ্যে একটি নীরব স্নেহশীলতা রয়েছে– যা বরাভয় প্রদান করে। ক্রমশ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে, আলোচনা করতে করতে তাঁর ভাবনার অনেকগুলো দিক আবিষ্কার করলুম, যা তাঁকে বুঝতে সাহায্য করল। শুধু সাহায্যই করল না, আমার চিন্তাকেও স্পষ্টভাবে প্রভাবিত করল।
……………………………..
আমরা সমাজসেবা করি বাড়ির কিছু পুরনো জিনিস দিয়ে, বা খাবারদাবার কিনে দিয়ে। এইসব জিনিস আমরা কোনও সংস্থার মাধ্যমে গাঁয়ে-গঞ্জে অভাবী পরিবারে পাঠিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলি। মনে করি, এই তো করেছি জনকল্যাণ। এই তো সমাজকে দেওয়া হল! কার কাছে সে জিনিস গেল, কোথায় গেল, তাও জানতে চাই না। আমরা যে আমাদের কর্তব্য করেছি, এতেই আমরা সুখী। কিন্তু আমাদের ওই অতিক্ষুদ্র দান কতদিনের জন্যে?
………………………………
একবার গাড়িতে করে চলেছি। গায়ত্রীদি নিজের বাবার কথা বলছেন, যাঁকে তিনি খুব বেশিদিন পাননি, অথচ যাঁর প্রভাব তাঁর জীবনে খুব গভীরভাবে পড়েছিল। কথায় কথায় উঠে এল গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষদের সাহায্যের কথা। তিনি বললেন, ‘খেতে দেওয়া সহজ কথা। পাউরুটি আর জেলি দাও, চুকে গেল। কিন্তু সমস্যাটা কী জানো– একবার দেবে, দু’বার দেবে, তারপর আর দিতে পারবে না। বরং শিক্ষা দাও ওদের। ওদের ঠিক করে শিক্ষা দিলে ওরা নিজেরাই নিজের পাউরুটি আর জেলি জোগাড় করে নিতে পারবে। আমার কাছে ওটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ!’ সেই তরুণ বয়সে কথাটা আমাকে খুবই আলোড়িত করেছিল। এটা নিয়ে পরে বহুবার ভেবে দেখেছি– আমরা সমাজসেবা করি বাড়ির কিছু পুরনো জিনিস দিয়ে, বা খাবারদাবার কিনে দিয়ে। এইসব জিনিস আমরা কোনও সংস্থার মাধ্যমে গাঁয়ে-গঞ্জে অভাবী পরিবারে পাঠিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলি। মনে করি, এই তো করেছি জনকল্যাণ। এই তো সমাজকে দেওয়া হল! কার কাছে সে জিনিস গেল, কোথায় গেল, তাও জানতে চাই না। আমরা যে আমাদের কর্তব্য করেছি, এতেই আমরা সুখী। কিন্তু আমাদের ওই অতিক্ষুদ্র দান কতদিনের জন্যে? একদিন, দু’দিন– তার বেশি তো নয়! অথচ যদি শিক্ষার বিস্তার করা যায়, যদি ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো যায়– তাহলে একটা প্রজন্ম শিক্ষালাভ করে সারাজীবন নিজের উপার্জন নিজেই করতে পারবে।
সেবার গায়ত্রীদির উদ্যোগে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনফারেন্স হল কলকাতায়। বিষয় ছিল– এই পোস্ট-কলোনিয়াল যুগে কলোনিয়াল আমলের স্থাপত্যের আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না! সেই নিয়ে কথা বলতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অধ্যাপকের দল এলেন। তাঁরা উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও ঔপনিবেশিক স্থাপত্য নিয়ে বহু গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বললেন। এর মধ্যে কোনও-কোনও দিন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলুম। কিন্তু যেহেতু এই কনফারেন্স কো-অর্ডিনেট করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর, তাই ছুটোছুটি করতে হচ্ছিল তখন। তিনদিনের কনফারেন্স ঠিকঠাক উতরে যাওয়ার পর একদিন গায়ত্রীদির সঙ্গে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরচ্ছি– উনি বললেন, ‘কলোনিয়াল স্ট্রাকচারের তাৎপর্য নিয়ে এরা কথা বলছে, অনেক থিয়োরি বেরচ্ছে; কিন্তু আমি ওদের বলেছি– আরে বাপু ওই বড়-বড় গাড়িবারান্দাওয়ালা স্ট্রাকচারগুলো আছে বলে আমাদের শহরের রিকশাওয়ালা, মজুররা তার তলায় রাতে ঘুমোয় সারা বছর। ওগুলো ওদের মাথার ওপরের ছাদ। ওগুলো সরিয়ে নিলে ওরা শোবে কোথায় বলতে পারো? বুঝতেই পারছ, ওরা তো এইভাবে ভাববে না।’ এই হল গায়ত্রীদি– উচ্চকোটির একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান, অথচ কী মারাত্মক প্র্যাকটিক্যাল!
একবার অফিস থেকে ফিরেছি। রাত আটটা বেজে গেছে। গায়ত্রীদির ফোন– ‘কী করছ? একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবে? আমার ইন্টারনেট ডঙ্গলটা কাজ করছে না।’ সেই সময়ে গায়ত্রীদির ল্যাপটপের জন্যে আমি একটি ইন্টারনেট কোম্পানির ডঙ্গল জোগাড় করে দিতুম। ল্যাপটপের সঙ্গে কানেক্ট করা মাত্রই সেটা চলা উচিত, কিন্তু এই ডঙ্গল নাকি চলছে না। কী হল রে বাবা! গায়ত্রীদি বললেন, ‘গাড়ি পাঠাচ্ছি, চলে এসো!’ চলে গেলুম। এইবার ওঁর ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখি উনি ল্যাপটপ খুলে বহু চেষ্টা করেও ডঙ্গল কানেক্ট করতে পারেননি। এইবার আমি তো গিয়ে বসলুম। উনি আমার পাশেই বসে উদ্বিগ্ন স্বরে বলছেন– ‘কী হল দ্যাখো তো! কেন হচ্ছে না!’ আমি ভেবেছিলুম, নিশ্চয়ই কোনও সহজ বিষয় উনি ওভারলুক করছেন, তাই চলছে না। আমি চট করে কাজটা করে দেব। কিন্তু আমিও নানা চেষ্টা-চরিত্র করে কিছুতেই সেটা চালাতে পারলুম না। প্রায় আধঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও যখন দেখলুম যে ওটা চালাতে পারছি না, তখন হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক পরিচিত বন্ধুর কথা– যে এসব টেকনিক্যাল বিষয়ে পারদর্শী। বললুম, ‘গায়ত্রীদি, আমার এক বন্ধু রয়েছে যে এইসব বিষয় খুব ভালো জানে। তাকে বলব?’ উনি বললেন, ‘কেন? আমরাই করব!’ বললুম, ‘কিন্তু যদি না করতে পারি? ওকে ডাকলেই তো হয়!’ গায়ত্রীদি জোর দিয়ে বললেন, ‘ও এমন কী পারবে, যা আমরা পারব না!’
কথাটা বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠল। গায়ত্রীদি ঠিক কী কারণে ওই উচ্চতায় গিয়েছেন, তার একটা সামান্য ঝলক পেলুম হয়তো। অদম্য প্রাণশক্তি ও জেদ রয়েছে তাঁর। কাজ তিনি করেই ছাড়বেন। নিজের চেষ্টায়। যতদূর সম্ভব। ওঁর কথা শুনে আবার কাজ শুরু করলুম। উনি আমার সঙ্গে বসে স্টেপ বাই স্টেপ পুরোটা করলেন। তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলুম ডঙ্গলের পিছনে অতিক্ষুদ্র ফন্টে একটা পাসওয়ার্ড দেওয়া– এইটা আমাদের চোখে পড়েনি বলেই এত বিপত্তি। পাসওয়ার্ড দেওয়ামাত্রই ইন্টারনেট চালু হল। গায়ত্রীদির মুখে তখন দিগ্বিজয়ের হাসি– ‘দেখলে, বলেছিলাম আমরাই পারব!’ এটা আজও আমার জীবনে একটা শিক্ষার মতোই রয়ে গেছে। ওঁর এই কথা আমার কানে বাজে– ‘ও এমন কী পারবে, যা আমরা পারব না!’
এই গল্পটা কিছুদিন আগে সমাজমাধ্যমে লিখেছিলাম। আবারও গল্পটি এখানে বলতে ইচ্ছে করল। একবার গায়ত্রীদির আসা উপলক্ষে অফিসে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা পূর্ণ উদ্যমে দ্বিপ্রাহরিক আহারে নিমজ্জিত। আমার সামনে ছিল আমের আচার। আমি আমার এক অবাঙালি সহকর্মীকে বললুম, ‘এটা খা। This is good. This is authentic আমের আচার।’ হঠাৎ আমার পিছন থেকে একটা তেজি দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনতে পেলুম, ‘Souvik, there’s nothing called authentic because the past is always changing!’ আঁতকে উঠে কিছুক্ষণ গায়ত্রীদির দিকে ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে রইলুম। একটা আমের আচার যে এই ভাবে আমায় বিপদে ফেলবে ভাবিনি! গায়ত্রীদি ততক্ষণে হালকা মেধাবী হাসি হেসে, ‘কাজ নেই কাজ নেই মা, কাজ নেই মোর ঘরকন্নায়’ গেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন। এদিকে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কথাটার মানেই তো বুঝতে পারলুম না। অতীত কী করে পাল্টে যায়? যা হয়ে গেছে, তা কী করে পাল্টাবে? মাথার মধ্যে খুঁজতে শুরু করলুম। দিন তিনেকের মাথায় কী একটা দরকারে হরপ্পা নিয়ে পড়তে গিয়ে, দুম করে বোমা ফাটল। হরপ্পা আবিষ্কারের আগে বৈদিক যুগ ছিল ভারতীয় ইতিহাসের সূচনাবিন্দু। হরপ্পা আবিষ্কার ভারতের অতীতটা পাল্টে দিল। অতীতও তাহলে পাল্টায়! আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম। ভাবতে লাগলুম, মাটির তলা থেকে, সংস্কৃতির তলা থেকে, সময়ের তলা থেকে কোন সত্য কবে উঠে এসে কোন জাতির, কোন বিশ্বাসের, কোন সংস্কৃতির অতীত পাল্টে দেবে কে জানে! কানে তখনও বাজছে গায়ত্রীদির কন্ঠস্বর, ‘Souvik, there’s nothing called authentic, because the past is always changing!’
পণ্ডিত এবং অধ্যাপক অনেকেই রয়েছেন, কিন্তু গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক স্বতন্ত্র। তিনি অগ্নিময়ী অথচ একই সঙ্গে স্নেহপ্রবণ। আমার নিজের ধারণা পাণ্ডিত্যের ভান তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। খুব আবছা জানি, অথচ ভাব দেখাচ্ছি যেন অনেক কিছু বুঝেছি– এইটি তিনি ভালোভাবে নিতেন না। যার ফলে তখন আমরা অন্য গায়ত্রীকে দেখেছি। কয়েকদিন আগেই তিনি নন্দনের একটি লেকচারে বলে উঠলেন ‘It is a case of heterological tautology’, তখন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলুম গোটা নন্দনের শ্রোতা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সবটাই যেন শ্রোতাদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই গায়ত্রীদি একবার অফিসে এসে বললেন, ‘সৌভিক, এটা দ্যাখো!’ দেখলুম ওঁর একটা সাক্ষাৎকারের ভিডিও। সম্ভবত ইজরায়েল বা জর্ডানের টেলিভিশনে ব্রডকাস্ট করা হয়েছিল। এখন আর মনে নেই। পুরোটা দেখলুম। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরকম লাগল?’ বললুম, ‘আমি তো বিষয়টাই বুঝতে পারলুম না। Liberalization and the growth of poverty index in the post colonial era– এর মধ্যে সোশিয়ালিস্ট স্ট্রাকচারে ক্যাপিটালিস্ট টেনডেনসির বিষয়টাও কিছুই বুঝিনি!’ গায়ত্রীদি বললেন, ‘কেন, না-বোঝার কী আছে?’ এই বলে তিনি আমাকে জলের মতো করে পুরোটা বোঝালেন! একটিও জারগন ব্যবহার না করে! এইটা তিনি পারেন।
আজ বহু বছর কেটে গেছে, কিন্তু এইসব স্মৃতি আমার কাছে আজও উজ্জ্বল, আজও দীপ্তিময়!