Robbar

আমের পাচারে নয়, প্রচারে থাকুন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 19, 2024 6:35 pm
  • Updated:May 19, 2024 6:35 pm  

ধরুন, আপনি আম খেতে খুব ভালোবাসেন। এবার এক সুন্দর বিকেলবেলা, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, আপনি বাড়ির দাওয়ায় বসে, লালেঝোলে হয়ে আম খাচ্ছেন। এমন সময় আপনার বন্ধু এসে আপনাকে বলল, পাড়ায় নাকি এক নিচু জাত চেয়ারে বসতে গিয়ে ‘ধরা’ পড়েছে। তাকে গণপিটুনি দেওয়া হবে কারণ তার চেয়ারে বসার ‘অধিকার’ নেই। আপনি যাবেন?

সৌমিত দেব

কোনও একটি জিনিস সঙ্গত কারণেই লোকের নজর এড়িয়ে, অবৈধভাবে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার নাম ‘পাচার’। এখন আমরা মানুষ। অ্যাড্রিনালিন রাশ আমাদের রক্তে। ‘প্রস্রাব করিবেন না’ লেখা দেওয়ালের সামনেই মূত্রবিসর্জন করে, গোটা ঘটনাটির ছবি তোলাকে আমরা ভয়ানক বাহাদুরি বলেই মনে করেছি আজীবনকাল। তাই ‘পাচার’ নামক লোভনীয় প্রক্রিয়াটি যে ছোট থেকেই আমাদের আকৃষ্ট ও লালায়িত করে তুলবে, সে আর নতুন কথা কী! সঙ্গে হাওয়ায় ও গোয়েন্দা গপ্পে ভেসে আসা বিভিন্ন মিথিকাল গল্প! তবে এই গল্পগুলো শোনা যেত কারণ পাচারকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে যেত। ইদানীংকালে যেমন মুম্বইয়ের রেলপুলিশ কিছু আম পাচারকারীকে পাকড়াও করেছে! আজ্ঞে হ্যাঁ, আম! সোনার বিস্কুট, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত এসব কিছু নয়, আম! পাচার হচ্ছিল। দূরপাল্লার রেলগাড়িতে করে। রেলওয়ে পুলিশ সেই আম বাজেয়াপ্ত করার পর সাধারণের মধ্যে তা নিলাম করে দেয়। এখন আমরা বাঙালি। তাই পাচারের বদলে আসুন আম নিয়ে কথা বলা যাক।

Emirates SkyCargo flies more than 6-million mangoes out of India ...
সূত্র: ইন্টারনেট

আম বাঙালি-জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাকা হোক বা কাঁচা আম খাওয়ার একটা না একটা পদ্ধতি বাঙালি নিজের মতো করে ঠিক আবিষ্কার করে নেয়। আমসি, আমসত্ত্ব, আমপোড়া শরবত, আমের চাটনি, আম দিয়ে ডাল ইত্যাদি প্রভৃতি ও অন্যান্য! সঙ্গে ভ্যারাইটি? ফ্রম হিমসাগর টু গোলাপ খাস, ফ্রম ল্যাংড়া টু সিঁদুরটোকা, চারটে উইকিপিডিয়া কম পড়ে যাবে। টেকনিকও কি আর কম রয়েছে? খোসা না ছাড়িয়েই শুধু চুষে চুষে একটা গোটা আম খেয়ে ফেলার যে শৈল্পিক নিপুণতা, তা কি সহজে মেলে? নাকি আঁটিটাকে চেটে চেটে একেবারে মরুভূমির মতো ছিবড়ে করে ফেলার ধৈর্য থাকে সকলের?

Mango jam in UP: Why the king of fruits lost its charm this season - India Today

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

রুচি ও শিক্ষার রীতিমতো প্রদর্শন তর্কাতর্কি চলে আমকে কেন্দ্র করে। নাক উঁচু বাঙালি মনে করে হিমসাগরের চেয়ে ভালো আম হয় না। বিপ্লবী বাঙালি মনে করে আম মানেই ল্যাংড়া। ভিন্নরুচির বাঙালি জানে একবার শান্তিনিকেতন গিয়ে কোপাই নদীর ধারে বসে যে অজানা আমটি সে খেয়েছিল তার চেয়ে ভালো আম আর কিচ্ছু নেই। আর প্রকৃত আমাড়ু আম দেখেই বলে দেয়, যে গাছে এই আম হয়েছিল সেই গাছের পাতা হাওয়া দিলে কোনদিকে দোলে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

রুচি ও শিক্ষার রীতিমতো প্রদর্শন তর্কাতর্কি চলে আমকে কেন্দ্র করে। নাক উঁচু বাঙালি মনে করে হিমসাগরের চেয়ে ভালো আম হয় না। বিপ্লবী বাঙালি মনে করে আম মানেই ল্যাংড়া। ভিন্নরুচির বাঙালি জানে একবার শান্তিনিকেতন গিয়ে কোপাই নদীর ধারে বসে যে অজানা আমটি সে খেয়েছিল তার চেয়ে ভালো আম আর কিচ্ছু নেই। আর প্রকৃত আমাড়ু আম দেখেই বলে দেয়, যে গাছে এই আম হয়েছিল সেই গাছের পাতা হাওয়া দিলে কোনদিকে দোলে। এমনকী, ঝড় এলে যখন সকলে ঘরে ঢুকে পড়ে তখনও বাঙালি বেরোয় আম কুড়োতে। হ্যাঁ, ইদানীংকালের শহুরে বাঙালির কাছে হয়তো এ জিনিস বিভিন্ন পাচারের গল্পের মতোই মিথিকাল, কিন্তু সত্যি বলছি এসব হত। শহরতলি আর পাড়াগাঁয়ে এখনও হয়! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালির আমের প্রতি এই ভালোবাসা কেন? কী সেই কারণ, যাতে পকেটে টান থাকলেও ফ্রিজে আলফানজো থাকে? কেন এনআরআই বাঙালি দেশে ফিরলে আম নিয়ে যেতে চায়?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন: গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

উত্তর হল, জানি না। কী হবে জেনে? জানলে কি আর এক দলিত দম্পতিকে তাদের শিশুকন্যার সামনেই মাঝরাস্তায় বিবস্ত্র করার ঘটনা মিথ্যা হয়ে যাবে? নাকি ঊর্ধ্বমুখী জিনিসের দাম হঠাৎ করে কমে যাবে! ধরা যাক, আমি জানি বাঙালি আম খেতে ভালোবাসে কেন। কী হবে তাতে? বিশ্ব শান্তি কমিটি এসে আমাকে বলবে– যে আপনি এটা জানেন বলেই আজ থেকে নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ। যে পরিযায়ী শ্রমিকরা হাজার মাইল পথ হেঁটে বাড়িতে ফিরেছিল তাদের প্রত্যেকের ডেটা আমরা খুঁজে বের করছি। হবে কি এসব? হবে না তো! তাহলে এত জেনেই বা কী হবে। তাছাড়া আমের মতো একটা স্বর্গীয় জিনিস ভালো লাগবে না-ই বা কেন। ওই স্বাদ, ওই গন্ধ, মায় অক্ষয়কুমার থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই আম খেতে ভালোবাসে, সেখানে বাঙালির আর দোষ কী!

আম নিয়ে যত অজানা তথ্য

শুধু কি তাই, আমের কি আর কোনও গুণ নেই! অবশ্যই আছে! যারা আম খেতে ভালোবাসে, তারা কোনও দিনও এক থালা আম হাতের সামনে পেলে কোনও তুচ্ছ কারণকে নিজের ভাবাবেগে আঘাত করতে দেবে? হাত ভর্তি আম মুছে কোনও দিন সে হেটস্পিচ টাইপ করবে? চেনে না, জানে না, এমন লোকের বাপবাপান্ত করতে উদ্যত হবে, সেই লোক তার পছন্দের সিনেমাকে খারাপ বলেছে বলে? ধরুন, আপনি আম খেতে খুব ভালোবাসেন। এবার এক সুন্দর বিকেলবেলা, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, আপনি বাড়ির দাওয়ায় বসে, লালেঝোলে হয়ে আম খাচ্ছেন। এমন সময় আপনার বন্ধু এসে আপনাকে বলল, পাড়ায় নাকি এক নিচু জাত চেয়ারে বসতে গিয়ে ‘ধরা’ পড়েছে। তাকে গণপিটুনি দেওয়া হবে কারণ তার চেয়ারে বসার ‘অধিকার’ নেই। আপনি যাবেন? কোনও দিন যাবেন না। আরে আম খাওয়া ছেড়ে কখনও যাওয়া যায় নাকি!

The famous food scenes of Goopy Gyne Bagha Byne
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমায় বাঘার আম খাওয়ার দৃশ্য

অবশ্য যদি চলে যান, যদি আপনার গণপিটুনি দেওয়ার লোভ আম খাওয়ার লোভকে হারিয়ে দেয়, তাহলে একটাই কথা বলার। মুম্বইয়ের আম-পাচারকারীরা ট্রেনে করে আম পাচার করছিল ডেলিভারির খরচ বাঁচাতে। কোনও এক যাত্রী বা কর্মীকে হাত করে তারা ভারী আমের পেটি তুলে দিত ট্রেনে। তারপর আমের পেটি সেই কর্মী বা যাত্রীর বদান্যতায়, বাকি যাত্রীদের জিনিসপত্রের মতোই নিখরচায় ট্রেনে চড়ে ডেলিভারি স্থলে পৌঁছে যেত। এইবার কালের নিয়মে ধরা খাওয়ার আগে, চাকরি যাওয়ার আগে, তাদেরও নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল উফ্ কী দারুণ সিস্টেমটাই চলছে। কী ভালোই না লাগছিল তাদের। কারণ আমরা মানুষ। অ্যাড্রিনালিন রাশ আমাদের রক্তে। এ ধরনের কাজ আমাদের ভালোই লাগে, কিন্তু আমরা ভুলে যাই ধরা খাওয়ার কথা। গল্পের কথা। বন্ধুর ডাকে আপনি যদি আম খাওয়া মাঝপথে থামিয়ে গণপিটুনি দিতে যান তাহলেও কয়েকদিন পর গল্প হবে। এই নোংরামোটা নিয়ে। আর যদি না গিয়ে বন্ধুকেও হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলেন– ‘তুইও যাস না, এনে আম খা’, তারপর পুলিশে ফোন করে জানিয়ে দেন পাড়ায় এমন একটা জিনিস হচ্ছে, তাহলেও গল্প হবে। তবে সেটা মিথিকাল গল্প।

সেই ছেলেবেলায় ঝড় এলে আপনি যখন আম কুড়োতে বের হতেন, তেমন একটা গল্প…