ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রায়শই চোখে পড়ে একটা রিল। কোঁকড়া চুলের এক সুদর্শন যুবক হাতে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, তাতে লেখা: মেক মি লাফ ফর টোয়েন্টি ডলার্স। বিভিন্ন শ্রেণি-বয়স-জাতির মানুষ আসছেন, কেউ হাসাতে পারছেন, কেউ পারছেন না; কিন্তু প্রত্যেকে এই অভিনব ক্যাম্পেনটি উপভোগ করছেন– এটুকু নিশ্চিত। যে ভদ্রলোক প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁর নাম সাইফ শাওয়াফ, সিরিয়ান-কানাডিয়ান কমিক আর্টিস্ট।
ঘটনাটা ‘হেমলক সোসাইটি’-র আনন্দ করের সৌজন্যে অনেকেরই জানা, তবু আরেকবার বলি। বহু বছর আগে, গোল্ডেন গেট ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন মধ্য-ত্রিশের এক যুবক। তদন্ত শুরু হয়, তাঁর বাড়িতেও অফিসাররা চলে যান তল্লাশি করতে। ভদ্রলোকের ডেস্ক থেকে পাওয়া যায় একটি নোট, তাতে লেখা: ‘আজ গোল্ডেন গেট ব্রিজে যাব। পুরো ব্রিজটা পায়ে হেঁটে পেরোব। যদি, অন্তত একজন মানুষও আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, তাহলে আমি আর লাফাব না।’ সেদিন যদি অন্তত একজন মানুষও খেয়ালবশে লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসতেন, বেঁচে যেত একটি প্রাণ।
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রায়শই চোখে পড়ে একটা রিল। কোঁকড়া চুলের এক সুদর্শন যুবক হাতে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, তাতে লেখা: মেক মি লাফ ফর টোয়েন্টি ডলার্স। বিভিন্ন শ্রেণি-বয়স-জাতির মানুষ আসছেন, কেউ হাসাতে পারছেন, কেউ পারছেন না; কিন্তু প্রত্যেকে এই অভিনব ক্যাম্পেনটি উপভোগ করছেন– এটুকু নিশ্চিত। যে ভদ্রলোক প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁর নাম সাইফ শাওয়াফ, সিরিয়ান-কানাডিয়ান কমিক আর্টিস্ট। ‘মেক মি লাফ’ ক্যাম্পেন তাঁর নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত না হলেও, পৃথিবী জুড়ে তিনিই মোটামুটি এই ক্যাম্পেনটির মুখ হয়ে উঠেছেন। এর পাশাপাশি তাঁর আরেকটি ক্যাম্পেন আছে: মেক মি ইমপ্রেসড ফর থাউজ্যান্ড ডলার্স। গান, র্যাপ, জিমন্যাস্টিকস, মিমিক্রি বা অন্য যে কোনও প্রতিভার একটি নমুনা রাখতে হবে হোস্টের সামনে, তিনি অভিভূত হলে এবং সোশাল মিডিয়ায় দর্শকদের পর্যাপ্ত ভোট মিললেই পকেটে কড়কড়ে হাজার ডলার। আজকাল রিল-ভিউজ-সাবস্ক্রাইবার-অর্থপ্রাপ্তি– এই সমস্ত পরিভাষা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায়, কোনও উদ্যোগই আমাদের আর আলাদা করে নাড়া দেয় না। সত্যিই তো, দিন শেষে প্রত্যেকেই চান তাঁর ‘কনটেন্ট’-টি অভিনব হোক, বাজারের আর-পাঁচটা বিষয়ের থেকে একটু আলাদা হয়ে দাঁড়াক। কাজেই, প্রতিটি ক্যাম্পেনকেই তাই আপাতভাবে একটু চটকদারই লাগে। এখানেই সাইফের ক্যাম্পেন সামান্য আলাদা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: দরাদরির দিন ফুরলো, বন্ধুবিচ্ছেদ হলুদ ট্যাক্সি ও মিটারের
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সাইফের ক্যাম্পেনে আসেন পথচারীরাই, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্ল্যাকার্ড চোখে পড়লে তাঁরা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে জোক বলেন, অথবা কিছু একটা পারফর্ম করে দেখান। মূলত সকলে আসেন নিছক মজার জন্যই, টাকাটা বোনাস, অনেকে টাকাটা পান, অনেকে পান না। কিন্তু বহু মানুষের জীবনও বদলে গিয়েছে এই ক্যাম্পেনে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ র্যাপার স্পর্শ শাহ যেমন। অস্টিওজেনেসিস ইমপারফেক্টা, বা ব্রিটল বোন ডিসঅর্ডারে ভোগা এই বছর-কুড়ির যুবককে যাতায়াত করতে হয় হুইলচেয়ারে। সেই স্পর্শ যখন ‘মেক মি ইমপ্রেসড’ ক্যাম্পেনে এসে র্যাপ করলেন, তখন আশপাশের প্রত্যেকটা মানুষ বিস্ময়াবিষ্ট– এমনও হয়! প্রচুর মানুষের ভোট পেয়ে স্পর্শ সেই পর্বের বিজেতা হয়েছিলেন। অথবা, এক উঠতি জিমন্যাস্ট কিশোরীর কথা ভাবা যাক। বাবা-মা-র সঙ্গে সুপারমার্কেটে ঘুরতে এসে সে আচমকাই দেখতে পায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফকে। যায়, বহুবার কসরত করেও যখন ঠিকঠাক একটা মুভ হল না, তখন তার প্রায় চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম! সেই সময়ে কাঁধে ভরসার হাত রেখেছিলেন সাইফ, বলেছিলেন: ‘টাকাটা বড় কথা নয় সিস, কোনটা ইম্প্রেসিভ জানো? তুমি একের পর এক চেষ্টা করে গেলে, হাল ছাড়লে না। এবং, তোমার সঙ্গে আমার সামনের বছর এই সময়ে, ঠিক এই জায়গাতেই দেখা হবে। কেমন? তখন এই টাকাটা নিয়েই ছেড়ো।’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের সমবেত হাততালি। ছোট্ট মেয়েটি প্রতিজ্ঞা করে গেল সে সামনের বছর আরও তৈরি হয়ে ফিরে আসবে। ওই পর্বেই আরেকটি সমবয়সি মেয়ে আসে, সে-ও জিমন্যাস্ট। তার কোনও ভুলচুক হয়নি, সব ক’টা মুভ সে ঠিকঠাকই পারফর্ম করে। শেষে বহু লোকের প্রশংসার মাঝে যখন মেয়েটি বিহ্বল, মেট্রো সিটির আলোয় দেখা যায় তার চোখ চিকচিক করছে। সাইফকে মেয়েটি বলে, গত কয়েক মাসে তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। পরিবারের তিনজনকে সে হারিয়েছে চিরতরে, আজকের দিনটাও নানা কারণে বিপর্যস্ত অবস্থায় কাটল। এমতাবস্থায়, এই প্রশংসাটুকু, এই ভ্যালিডেশনটুকু; সর্বোপরি, এই আশ্বাসটুকু তার কাছে কতটা দামি, সে সম্ভবত বলে বোঝাতে পারবে না। সাইফ জিজ্ঞাসা করেন, যদি পাও, টাকাটা নিয়ে কী করবে? মেয়েটি দু’-সেকেন্ড চুপ করে থাকে, তারপর উত্তর দেয়– আমার যেসব কাছের মানুষ চলে গেছেন, তাঁদের কারওর কবরের ওপর রেখে আসব। আপাতযুক্তিহীন উত্তর, তবু এর অভিঘাত নাড়া দিয়ে যায় সাইফকে, আমাদেরও।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: দরাদরির দিন ফুরলো, বন্ধুবিচ্ছেদ হলুদ ট্যাক্সি ও মিটারের
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অজস্র উদাহরণ আছে এমন, অজস্র। মেক মি লাফ ক্যাম্পেনে এসেও অনেকে এমন সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন; বলেছেন সারাদিনে এই সামান্য কুড়ি ডলার-প্রাপ্তি কীভাবে তাঁদের নিস্তরঙ্গ, প্রাণহীন জীবনে একঝলক অনুপ্রেরণা এনে দিয়েছে। সাইফ নিজে দীর্ঘদিন অ্যাংজাইটিতে ভুগেছিলেন, ডিপ্রেশনেও। তাঁর যে সাক্ষাৎকারগুলি ইউটিউবে পাওয়া যায়, সেখানে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের দিনগুলো নিয়ে তিনি অকপটভাবে কথাবার্তা বলেছেন। সেজন্যই তাঁর এই ক্যাম্পেনটিকে নিছক রিচ-পিয়াসী বলতে বাধে। হ্যাঁ, রিচ-ভিউজ-ফলোয়ার কি আর আসে না এগুলো থেকে? আসে। ঠিক যেভাবে বিজেতাদের পকেটে ঢোকে ডলার। তবু, এই ভিডিওগুলো থেকে রিচ-ভিউজের থেকে অনেক বেশি কিছু নিয়ে ফেরেন সাইফ। অনেকগুলো মানুষের আরেকটু লড়ে যাওয়ার আশ্বাস নিয়ে ফেরেন, অনেকগুলো মানুষকে একটু উষ্ণ পিঠচাপড়ানি দিয়ে ফেরেন। ঠিক তেমনই, বিজেতারাও নেহাতই কুড়ি ডলার জেতেন কি? আসলে এই ক্যাম্পেন থেকে তাঁরাও নিয়ে যান বিশ ডলারের ঢের বেশি, সে প্রাপ্তিকে পৃথিবীর কোনও মুদ্রায়, কোনও এককে মাপা যায় না। বিপর্যস্ত সময়ে অনেকগুলো অচেনা মানুষ তাঁদের ক্রাফট, হাস্যরসকে স্বীকৃতি দেন; এই আপাতবেরঙিন, যুদ্ধবিধ্বস্ত, মারী-পীড়িত পৃথিবীকে একটু হলেও আলোকময় লাগে। কয়েক হাজার ডলার একত্রিত করলেও কি এই অনুভূতির দাম পাওয়া যায়?
জয় গোস্বামী লিখেছিলেন, ‘পথে চলেছে জনস্রোত। বিরাট বিপুল জনস্রোত। পথ নয়, ব্রিজ। তলায় অপার শূন্য। রেলিং বা কার্নিশ কিছু নেই
কখন কার ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে হবে সে কথা পাশের লোক জানে?’
কে বলতে পারে, কেউ হয়তো সত্যিই ঝাঁপ দেওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে দাঁড়িয়েছিল একটা লোক, হাতে প্ল্যাকার্ড: মেক মি লাফ ফর টোয়েন্টি ডলার্স। সে লোকটা বিলক্ষণ জানে, বিষাদের জংধরা ছুরি কতটা গভীর অবধি গেঁথে যায়। কে বলতে পারে, শুধু সেই লোকটা হেসেছিল বলে কেউ হয়তো আত্মহত্যা স্থগিত রেখে দিয়েছে?