Robbar

এত বড় ফিরে আসা সাহিত্যের রূপকথায় বেশি নেই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 28, 2024 8:07 pm
  • Updated:December 28, 2024 8:07 pm  

এই ভারতেই এক যে আছেন রুশদি পাঠক। তিনি হঠাৎ উঠলেন খেপে, সুকুমার রায়ের গোঁফ চুরি যাওয়া বড়বাবুর মতো, রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস তাঁর চাই, এখুনি চাই, অবশ্য চাই। এই পাঠক এই বঙ্গের মানুষ। বইয়ের জন্য এমন হন্যে খ্যাপামির মানুষ বঙ্গের বাসিন্দা ছাড়া আর কোথাকারই বা হবেন? নোবেল প্রাইজ পাওয়ার থেকেও কি রুশদির কাছে এটা বড় পাওয়া নয় যে, তিনি জানলেন তাঁর জন্মভূমি ভারত কোনও দিন নিষিদ্ধ করেনি তাঁর শয়তানের কবিতা। এবং তাঁর এই গ্রন্থের কাছে খুলে গেল সমগ্র ভারত জোড়া ব্যাপক বাণিজ্য আকস্মিক সৌভাগ্যে! 

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রত্যাবর্তন। এবং ‘প্রত্যাবর্তন’ মানেই কেমন যেন এক চিলতে রোদ্দুর। ঘরের ছেলে বা মেয়ে, ঘরে ফিরল। ফিরে, সংসারের পুরোনো উত্তাপ। কিন্তু কোনও কোনও ফিরে আসা তেমন নয়। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবিতে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি ফিরে আসা। তাকে নিয়ে কত সন্দেহ, কল্পনা, সংশয়, ভ্রান্ত ভয়! ভারত জুড়ে এই ফিরে আসা হয়তো তেমনই। অনেকের মনে একটা ‘কিন্তু কিন্তু’ ভাব জাগতে পারে। বিশেষ করে, যদি হয় অশিক্ষিত কিংবা ধর্মান্ধ মন। কার বা কীসের এমন প্রত্যাবর্তন ঘটল ভারত জুড়ে যার সম্ভাব্য অভিঘাত?

4K Restoration of Satyajit Ray's Agantuk to be premiered at Toronto  International Film Festival
‘আগন্তুক’ ছবির একটি দৃশ্যে উৎপল দত্ত ও মমতাশঙ্কর

২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনে সে ল্যান্ড করেছে দিল্লিতে। উঠেছে খান মার্কেটের ‘বাহরি সন্স’- এ। ২৬ তারিখ সে ল্যান্ড করেছে কলকাতায়। সে যেমন ফেমাস তেমন ইনফেমাস। কেউ কেউ তাকে ‘এক নম্বরের শয়তান’ বলে। আবার কেউ কেউ ছাদের উপর থেকে চেঁচিয়ে বলে, ফিরে এসো, বিশুদ্ধ প্রতিভার দ্যুতি তুমি।

Delhi's Iconic Bahrisons Is Expanding Its Footprint In The Business Of  Books - Forbes India
বাহারি সন্স। দিল্লির প্রখ্যাত বইয়ের দোকান। পুরনো ছবি

৩৬ বছর আগে ভারতে এসেছিলে তুমি। তরুণ সাউ, যার কাছে আজীবন ইংরেজি বই ধারে কিনে চলেছি আমি, এবং এভারেস্টের থেকে উঁচু সেই ঋণ কোনও দিন শোধ হবে না জেনেও তরুণ নতুন বই হাতে পেলেই ছুটে আসে ব্ল্যাকহোলের কাছে, সেই তরুণ আমার হাতে তুলে দিয়েছিল তোমার প্রথম সংস্করণটি। আমি বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সলমন রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। বুক আজও ধড়ফড় করে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরার সেই তুমুল মুহূর্তটা ভাবলে।

The Satanic Verses by Salman Rushdie - Penguin Books Australia

কিছুদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বোধহয় কারও কানে মাছের মতো কণ্ঠহীন ফিসফিস করেছিলেন, সলমন রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস বিপজ্জনক! এদেশে ব্যান হওয়া উচিত। কয়েক দিনের মধ্যেই বইটা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এবং রটে গেল– বইটা আর ভারতে ঢুকতে পারবে না। ইতিমধ্যে অবশ্য ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় শাসক আয়াতল্লা রুহল্লা খোমেনি ফতোয়া জারি করেছেন, রুশদির মাথা কেটে নামিয়ে দেওয়া হোক। কেননা তিনি স্যাটানিক ভার্সেস– এ ধর্ম ও নবীর অপমান করেছেন।

Satanic Verses: India forced to lift decades-long ban on Salman Rushdie's  book due to bizarre legal loophole | The Independent
সূত্র: ইন্টারনেট

বাকি ঘটনা তো ইতিহাস! স্যাটানিক ভার্সেস যদি কারও সঙ্গে শয়তানি করে থাকে, তো তার সৃষ্টিকর্তা সলমন রুশদির সঙ্গে। এই একটি বই লেখার জন্য তাঁকে মেনে নিতে হল কত বছরের নির্বাসন। তাঁর বিয়ে ভাঙল। সংসার ঘুচল। তাঁকে অজ্ঞাত গুহাবাসী হতে হল। তাঁকে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় চলে যেতে হল। এবং সেখানেই সেখানেই ঘটল তাঁর ওপর ছুরি চালানো হামলা। ক্রিস্টোফার মার্লোর মতো তাঁরও চোখ উপড়ে নেওয়া হল। এবং শেষ পর্যন্ত একটি চোখ অবলম্বন করে এবং তাঁর নতুন স্ত্রী ও প্রেমের প্রণোদনায় তিনিও চালালেন ছুরি। লিখলেন ‘নাইফ’!

Knife: Meditations After an Attempted Murder by Salman Rushdie | Goodreads

একে প্রত্যাবর্তন বলব না তো কাকে বলব? সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ফিরে আসা ক’টা আছে?

এর থেকেও বড় প্রত্যাবর্তন আছে একই সঙ্গে সাহিত্যের ইতিহাসে এবং রুশদির জীবনে। কী করে ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য ফিরে আসা, এবার সেই গল্পে। এই ভারতেই এক যে আছেন রুশদি পাঠক। তিনি হঠাৎ উঠলেন খেপে, সুকুমার রায়ের গোঁফ চুরি যাওয়া বড়বাবুর মতো, রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস তাঁর চাই, এখুনি চাই, অবশ্য চাই। এই পাঠক এই বঙ্গের মানুষ। বইয়ের জন্য এমন হন্যে খ্যাপামির মানুষ বঙ্গের বাসিন্দা ছাড়া আর কোথাকারই বা হবেন? নাম তাঁর সন্দীপন খাঁ।

তিনি তন্নতন্ন করলেন কলকাতার বই বাজার। যত দাম লাগে দিতে রাজি। আমি পড়তে চাই সলমন রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস। কোথায় পাব তারে? সে কী শোনেন আপনি? ওই বই তো ইন্ডিয়া তে ব্যান্ড! নাম পর্যন্ত নেবেন না ওই বিপজ্জনক বইটার। ওই , আলোচনা করলে, বাড়িতে রাখলে মুন্ডু যাবে। আর অল্পের ওপর দিয়ে গেলে, ভাগ্য ভালো থাকলে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড!

বলছেন কী? আঁতকে ওঠেন সন্দীপন। তারপর আরও তেড়ে বলেন, তাহলে তো পড়তেই হবে। যেখানে থেকে পারে যে কোনও মূল্যে নিয়ে আসুন ওই বই। পাগল হয়েছেন? নিষিদ্ধ বই। ভারতে কোথাও পাওয়া যায় না। আর ওই বই বাজারে আনব? ভারত সরকার জানতে পারলে কী হবে বুঝতে পারছেন? বইটার কোনও এডিটেড সংস্করণ পর্যন্ত ইন্ডিয়ায় পাবেন না। যেমন এক সময় ‘লেডি চ্যাটারলিজ লাভার’ পাওয়া যেত। এখন অবিশ্যি সব বইটা পাওয়া যায়। ব্যান উঠে গিয়েছে। বাংলাতেও পাওয়া যাচ্ছে। খুব সেক্স। নেবেন? দূর মশাই! চাইছি রুশদি। গছাচ্ছেন লরেন্স। ঠিক আছে, বলছেন ভারতে নিষিদ্ধ রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস। ছাপার অক্ষরে দেখান আমাকে সেই নিষেধাজ্ঞা। কোর্ট অর্ডার। কলকাতার কোনও পুস্তক বিক্রেতা দেখাতে পারেননি নিষেধাজ্ঞার সরকারি ঘোষণা রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস ওপর।

DOIG- Nepali Times
ডেসমন্ড ডয়েগ। সূত্র: ইন্টারনেট

এরপর কলকাতার এই বাঙালি চলে গেলেন দিল্লি। ভারতের রাজধানীর বই মার্কেট সত্যি দারুণ। ভারতের আর কোনও শহরে আমি এমন বইসাগর দেখিনি যেমন দেখেছি দিল্লিতে। দিল্লিতে যদি কোনও দিন বাস করতেই হয়, এই একটি কারণে, কতবার ভেবেছি। সন্দীপন দিল্লিতেও পেলেন না এক কপি কবিতার শয়তান! তিনি শশী থারুরের কাছে খোঁজ করেছিলেন কি না, জানি না। শশীর এই বই নেই বা তিনি পড়েননি, আমার বিশ্বাস হয় না, কেননা তাঁকে আমার চেনার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই সময়ে যখন তিনি লিখতেন ডেসমন্ড ডয়েগ-এর ‘জুনিয়র স্টেটসম্যান’-এ। আমার তখনই মনে হত জগতে এমন বই নেই যা শশী ধারণ করেন না পঠনে, মননে, বহনে! এই বার যা ঘটল তা পৃথিবীর কোনও রূপকথায় কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না। সন্দীপন মামলা ঠুকলেন দিল্লি হাইকোর্টে। মাই লর্ড, সব বই বিক্রেতা বলছেন সলমন রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস ভারতে নিষিদ্ধ। অথচ আমাকে কেউ দেখাতে পারছেন না এই নিষেধাজ্ঞা। তথ্য জানার অধিকার আমার আছে। তাই আমি জানতে চাই, এই বই কী সত্যি নিষিদ্ধ?

সন্দীপন এই একটি প্রশ্নে কাঁপিয়ে দিলেন সারা দেশ। কেউ দিল্লি কোর্টে পেশ করতে পারেননি এই বইটির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার কোনও কপি। কোনও নমুনা। কোনও প্রমাণ। কোনও লিপিবদ্ধ আইনি নিষেধ। অতএব ৩৬ বছর বিনা কারণে নিষিদ্ধ থাকার পর খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। আদালতের ছাড়পত্র পেয়ে! এবং সেকেন্ড কামিং এই বইয়ের লেখক সলমন রুশদির। এত বড় ফিরে আসা সাহিত্যের রূপকথায় খুব বেশি আছে কি? নোবেল প্রাইজ পাওয়ার থেকেও কি রুশদির কাছে এটা বড় পাওয়া নয় যে, তিনি জানলেন তাঁর জন্মভূমি ভারত কোনও দিন নিষিদ্ধ করেনি তাঁর শয়তানের কবিতা। এবং তাঁর এই গ্রন্থের কাছে খুলে গেল সমগ্র ভারত জোড়া ব্যাপক বাণিজ্য আকস্মিক সৌভাগ্যে! এবং এই সব কিছু ঘটালেন এই বঙ্গের এক বাঙালি পাঠক!