উন্নতি বনাম উচ্ছেদের এই বিতর্ক ক্যামেরাবন্দি করতে এসে বাংলার আমাজনে খুঁজে পেলাম মোহকরানিকে, যাকে এই রাজ্যের তথা এই দেশের গ্রেটা থুর্নবার্গ বলা যেতেই পারে। সুইডিশ ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়, প্রকৃতি, পাহাড় ও বন্যপ্রাণীদের আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান মোহক। আরেকটা পৃথিবী গড়তে চায় মোহক গ্রেটার মতোই, যেখানে বিশ্বায়ন আমাদের জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে মুনাফার জন্য ছিনিমিনি খেলবে না।
আমার ব্রেনের বাঁ-দিকে একটা কুয়াশামাখা স্টেশন বাসা বেঁধেছে। রোজ রাত্রে তাকে পুরুলিয়ার পাহাড় হাতছানি দেয়। কনকনে ঠান্ডায় পুরুলিয়ায় পৌঁছে জিপে করে অযোধ্যা পাহাড়ে যাচ্ছি। নামটা শুনলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে– এই পাহাড় ঘিরে থাকবে এক গভীর অরণ্য। যেমন রাত্রের আকাশে ঝলমলে তারা থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রত্যাশা করলেই সবসময় যে তা মিটবে, এমনটা না-ও হতে পারে।
মহাকাশে এমন এক জায়গা আছে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন ৭০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, যেটি একটি বিশাল ফাঁকা অঞ্চল। জায়গাটার নাম বুয়েটস শূন্য। সেখানে যত তারা, ছায়াপথ থাকার কথা তত নেই এবং এক অকল্পনীয় শূন্যতা রাজত্ব করে সেখানে। অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে এগোতে এগোতে মনে হচ্ছিল, বোধহয় বুয়েটস শূন্যে এসে পড়েছি। পাহাড় লাগোয়া গ্রামগুলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যতটা সবুজ থাকার কথা ততটা সবুজ নয়। মাইলের পর মাইল কয়েকটি নিঃসঙ্গ গাছ কুয়াশা মেখে নিয়ে নিজেদের লোকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। এই গাছগুলোর গায়ে যেন ১২ মাসের শীত জমে আছে। সবুজের বদলে আছে একটা বিশ্রী ছাই রং। কংক্রিটের জঙ্গল আস্তে আস্তে গজিয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে কংক্রিটই যে রাজত্ব করবে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। বিবর্ণ, রুক্ষ, খরা-পীড়িত এক নির্মম ল্যান্ডস্কেপ। যেন সালভাদোর দালি নিখুঁতভাবে একটি যুদ্ধক্ষেত্র এঁকেছেন। ভাবি, কী ঘটেছে এখানে? বা কী ঘটছে?
ব্যাকবেঞ্চার্সদের ক্রু নিয়ে আবার পুরুলিয়া এসেছি। ড্যাম? ড্যামড? (Dam? Damned?) তথ্যচিত্রের রেকি ও শুটিং করব। জানতে এসেছি, তুর্গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (TPSP) নিয়ে এত বিতর্ক কীসের? বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, তথ্যচিত্র বানাতে গেলে দক্ষ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হতে হবে। তাই গ্রাউন্ড জিরো থেকে ফিল্মটা করতে চাইছিলাম। সত্যিই কি ২০০০ বিঘের শাল পিয়ালের জঙ্গল, গ্রাম– সব ড্যামের জলে ডুবে যাবে? এভাবেই গড়ে তোলা হবে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র? আদিবাসীরা বলছেন কম করে ৩ লক্ষ বৃক্ষ নিধনের বিষফল হবে টিপিএসপি। অথচ সরকার জানাচ্ছে, মোট ৬,১৮৬-টি গাছ কেটে এই প্রোজেক্ট দিনের আলো দেখবে! মানে তিনটি গাছ প্রতি বিঘেতে বিসর্জন দিতে হবে এবং সমপরিমাণ গাছ আবার লাগানোর পরিকল্পনা আছে। আদিবাসীদের সন্দেহের কারণ, দেড় দশক আগে বানানো পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (PPSP) নির্মাণ করতে অন্তত ৩,৫০,০০০ বৃক্ষ নিধন হয়েছিল। সাধারণ মানুষের কপালে না জুটেছিল চাকরি (সামান্য কয়েকজনের চাকরি হয়েছিল) না ফ্রি-বিদ্যুৎ! এবারেও আদিবাসীরা ধরে নিয়েছেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই এই তীব্র বিরোধিতা।
তথ্যচিত্রের, ফিচার ফিল্মের মতো স্ক্রিপ্ট থাকতেই হবে এমন ব্যাপার নয়। একটি যে বেসিক খসড়া থাকে না, তা নয়, কিছু পরিকল্পনাও থাকে তবে লোকেশনে শুট করতে গিয়ে দেখেছি ৬০-৯০% নতুন কিছু পেয়েছি, যা দিয়ে মূল থিম গড়ে ওঠে।
হালকা শীত থাকলেও, পাহাড়ে উঠেও গরম লাগছিল। প্রথম স্টপ উসুলডুঙরি, ছোটদের স্কুল। বাচ্চারা লাঞ্চ খেতে বসেছে। রান্না বোধহয় দেরিতে হয়েছে আজ। গরম ভাত আর বাঁধাকপির তরকারি। ব্যস, আর কিছু না! শুনলাম, অধিকাংশ দিনই এই খাবার বা সামান্য ডাল-ভাত জোটে বাচ্চাদের কপালে। কয়েক ঘণ্টা আগেই আমরা আৰ্লি লাঞ্চ সেরেছি রিসর্টে। প্রোডাকশন ম্যানেজার বললেন, লাঞ্চের বিল হয়েছে ৩,৫০০-৪,০০০ টাকার মতো। ভয়ংকর অপরাধী লাগছিল, বড্ড ঘেন্না করছিলাম নিজেকে। পাশেই ফাঁকা মাঠে মোরগ-লড়াই চলছে। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেকে কাফকার মেটামরফোসিসের গ্রেগর সামসা। তফাত একটাই: আমরা গুবরেপোকা নই। আমরা দেশি মোরগে পরিণত হয়ে লড়ছি একে ওপরের বিরুদ্ধে। এই লড়াই দেখতে হাজির হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত সভ্যতার উন্নত জীবরা। হাততালি দিয়ে লড়াই উপভোগ করছে তারা।
নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম ভুর্ষাবেড়া। লালমাটির রাস্তা যেন রং ধার করেছে ম্যাজিক আওয়ারের ডুবতে যাওয়া সূর্যের কাছে। শুটিং-এর শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময় রোদটা স্বর্গ থেকে পাঠিয়ে দেন ঈশ্বর। গ্রামে ঢোকার মুখে দেখি অনেক মহিলা মাথায় মাটির কলসিতে (এরা বলে মাটকি) জল সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছেন। বুঝতে পারলাম অনেক দূরে গিয়ে জল সংগ্রহ করতে হয়। এত ঝরনা, নদী, পুকুর, ড্যাম– তাও জলের অভাব? কিন্তু কেন? গত ১১ বছর ধরে পুরুলিয়া যাতায়াত করছি। নানা ফিল্মের শুটিং করেছি। এই দৃশ্যও মনে আছে নদীর বালি খুঁড়ে মহিলারা জল সংগ্রহ করছেন তাঁদের পরিবারের জন্য।
ঝুপ করে পাহাড়ের পিছনে সূর্যটা হারিয়ে গেল। ভুর্ষাবেড়া ভুসো কালির মতো হঠাৎ আলোহীন হয়ে গেল। নিকষ কালো চাদর মুড়ি দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে মনে হল। কুকুরের ডাক শেষ হওয়া মাত্র এক আলপিন নিস্তব্ধতা এই গ্রামে। মনে পড়ল, এই জেলায় চার-চারটে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। তাও না আছে জল, না আছে বিদ্যুৎ। প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল ২০০৮-এ । আরও তিনটি বানাতে চান সরকার। প্রান্তজনরা বঞ্চিত। এ আর নতুন কথা কী!
সুলেমান হেমব্রমের বাড়িতে পৌঁছতেই দেখলাম হ্যারিকেনের আলোয় ভুট্টা ক্ষেতের পাশে একটি ১১-১২ বছরের বাচ্চা মেয়ে পড়তে বসেছে। পাশে একটি ড্রয়িং খাতা, তাতে একটি বাচ্চা হাতির ছবি এঁকেছে মেয়েটি। কারেন্ট আসেনি। ভুর্ষাবেড়াকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। কোনও কোনও রাতের আকাশে ঝলমলে তারাদের পাশে দাড়িয়ে থাকতে ভালোবাসে নিঃসঙ্গ চাঁদ। আজ সেই রাত।
নাসার (NASA) জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূষণমুক্ত এই পরিবেশে আকাশের তারা দেখলে খুশি হতেন। মনে হচ্ছিল, তারাগুলি মাটিতে নেমে আসতে চাইছে। বিষণ্ণতা মাখা চোখ নিয়ে ৪০-৪৫ বছরের চাষি সুলেমান আলাপ করিয়ে দিল তাঁর মেয়ের সঙ্গে। নাম মোহকরানি হেমব্রম। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসারে উঁকি মারে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। কারণ তুর্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রজেক্ট হলে সুলেমানের চাষের জমির সলিল সমাধি ঘটবে।
মোহক হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আংকেল, তোমার ড্রোন দিয়ে আমার বন্ধুকে খুঁজে এনে দিতে পারবে? আমার বন্ধু একটি বাচ্চা হাতি।’ মারাংবুড়ুর ভক্ত সাঁওতালরা হাতিকে দেবতা মনে করে। ভক্তি করে, ভালোবাসে অন্তর থেকে। হাতিটা খুঁজতে গিয়ে আজ আর সুলেমান মিথ্যে বলতে পারেনি মোহককে। মোহক হাতিটির নাম রেখেছিল রাজু। শেষ যে জঙ্গলে রাজুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে মোহক দেখে জঙ্গল নেই, আছে জল। শুধুই জল– যার নাম পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (PPSP)। জলের তলায় চলে গেছে সেই গভীর জঙ্গল যেখানে রাজু তার পরিবারের সঙ্গে থাকত! এই জঙ্গলের ৩,৫০,০০০ গাছ কেটে এই ড্যাম বানানো হয়েছিল। এই আঘাত মোহকের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই আঘাত মোহককে বদলে দিয়েছিল পুরোপুরি।
মোহকের মতো এই পাহাড়ি অঞ্চলে মূলত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। অচিরেই বাবা ও মেয়ের আলাপ হল অন্য গ্রামবাসী, স্কুলশিক্ষক ও বেশ কিছু সমাজকর্মীর সঙ্গে। সকলে একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ (PBABM)। এই মঞ্চের বক্তব্য স্পষ্ট:
বন অধিকার আইন ২০০৬ (Forest Rights Act: FRA) লঙ্ঘন করে গ্রামসভার অনুমতি না নিয়ে টিপিএসপি ২৩৪ হেক্টর/২০০০ বিঘা বনভূমি বেআইনিভাবে অধিগ্রহণ করেছে। তিনটি প্রজেক্টের প্রথম এটি। এর ফলে ডুবে যাবে বহু গ্রাম যেমন তেলিয়াভাষা, বারুওয়াজেরা। পরিবেশ ধ্বংস হবে, পশু-পাখি অকালে প্রাণ হারাবে এবং জীবিকা নির্বাহে ব্যাপক ক্ষতি হবে। পাহাড় অর্থাৎ মারাংবুরু তাদের দেবতা। পাহাড় কেটে, ঝরনা বেঁধে, জঙ্গল সাফ করে টিপিএসপি কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। এই উন্নতিতে তাঁদের কি লাভ হবে? পিপিএসপি নির্মাণ করে তাদের জীবন বদলায়নি। উল্টে বেড়েছে এদের অস্তিত্ব সংকট।
FRA ২০০৬ আইনের মূল উদ্দেশ্য হল, বনভূমি ও বন সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা, যাতে তাদের জীবিকা, বাসস্থান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। যখন রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার গ্রামসভার অনুমতি না নিয়ে ৫০০০ কোটি টাকা ঋণ নিল জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-(জাইকা)র কাছে তখন এই মঞ্চ নিজের প্রচেষ্টায় ১৮টি গ্রামসভা প্রতিষ্ঠা করল। ১০০০ মেগাওয়াটের এই প্রকল্পের জন্য খুব অল্প সুদে ৩০ বছরের জন্য জাপান ঋণ দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। সরকারের গ্রামসভার ৫০% সদস্যদের অনুমতি থাকলে টিপিএসপি নিয়ে এত জলঘোলা হত না।
আদিবাসীদের অভিযোগ, তাদেরকে একটা ইংরেজি ফর্মে সই করিয়ে নিয়েছেন সরকারি আধিকারিকরা। কীসের জন্য এই সই দরকার, তা সরকার আদিবাসীদের জানায়নি এবং এই সইগুলি সরকার টিপিএসপি নির্মাণ করার সম্মতি বলে চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
উন্নতি বনাম উচ্ছেদের এই বিতর্ক ক্যামেরাবন্দি করতে এসে বাংলার আমাজনে খুঁজে পেলাম মোহকরানিকে, যাকে এই রাজ্যের তথা এই দেশের গ্রেটা থুর্নবার্গ বলা যেতেই পারে। সুইডিশ ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়, প্রকৃতি, পাহাড় ও বন্যপ্রাণীদের আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান মোহক। আরেকটা পৃথিবী গড়তে চান মোহক, গ্রেটার মতোই, যেখানে বিশ্বায়ন আমাদের জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে মুনাফার জন্য ছিনিমিনি খেলবে না।
রাত বাড়ছে। খবর এল, পাশের গ্রামে হাতির আক্রমণে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। পরিবেশবিদ সৌরভ প্রকৃতিবাদী আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, অযোধ্যা দলমা পাহাড়ের অংশ। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলিফ্যান্ট করিডোর। এখানে অন্তত ১২টি হাতির পাল আছে। পিপিএসপি ও টিপিএসপি প্রোজেক্টের ফলে হাতির পাল পথ হারিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ছে। খাবার পাচ্ছে না। হাতির সংঘর্ষে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে এই অঞ্চলে। তবু আদিবাসীরা হাতিদের ঘৃণা করে না। হাতিকে পুজো করে, খাবার দেয় যথাসাধ্য।
প্রায় ৫০০০ হেক্টর দুর্গম এবং অতি ঘন বনাঞ্চল ঘিরে রাখে অযোধ্যা পাহাড়কে। ইতিমধ্যেই প্যাঙ্গোলিন, চিতা, শিয়াল, বুনো ভালুক, ধনেশ পাখি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। নিঃসঙ্গ, অসহায় ও নির্বাক এই পাহাড়ের কোলে বসে বাচ্চাদের নিয়ে পরিবেশ রক্ষা করতে থিয়েটার করে মোহক। সুলেমান নাটকে মাঝে মধ্যে অভিনয় করে। ইতোমধ্যে সরকার গাছ কাটতে এলে মোহক বাচ্চাদের সঙ্গে মিছিল করে, বড়দের সঙ্গে এর তীব্র প্রতিবাদ করে।
টিপিএসপি প্রকল্পে প্রথম থেকে গাছ কাটার বিরোধিতায় করেছে মোহকের মঞ্চ। এই মঞ্চ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। আদালত গাছ কাটার ওপরে কিছুদিনের জন্য স্থগিতাদেশ দেয়। প্রকল্পের কাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পরে আদালত মোহকদের পাশে দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ করে পিবিএবিএম। টিপিএসপি বাতিল করতে পিবিএবিএম-এর প্রতিনিধিত্ব করে মোহক চিঠি দেন জেলাশাসক ও বন দফতরে। মোহকের এই জার্নি আমাদের ক্যামেরা ফলো করে। অনেক জায়গায় পুলিশ বাধা দিয়েছে। ছবি তুলতে পারিনি আমরা। কিন্তু বুঝেছি দু’টি জিনিস–
১. ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। তাই এই তথ্যচিত্রে তথ্য কম, জীবন বেশি।
২. অর্থনীতি এমন একটি বোমা আবিষ্কার করেছে, যা পৃথিবীর সব পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী: দারিদ্র মানুষের জীবনের অনেককিছু মেলাতে দেবে না। একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে– নীতিহীন অর্থনীতিই এখন ট্রেন্ড। ‘মাইট ইজ রাইট’ আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বিশ্বায়ন তার প্রজাদের শাসন করে চলেছে।
দারিদ্রের বৃত্তে প্রজারা (পড়ুন সহজ সরল আদিবাসীরা) লাট্টুর মতো ঘুরেই চলেছে। জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে, জঙ্গলকে ভালোবেসে পাতা ও মহুয়া ফল কুড়িয়ে বেশ কাটছিল আদিবাসীদের। রাষ্ট্র, পুঁজি আর কর্পোরেটরা আসার আগে জীববৈচিত্র সংরক্ষিতও ছিল। তারপর গল্পটা বদলাতে লাগল। আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল তাঁদের প্রকৃতি, প্রাণ এবং সংস্কৃতি। গল্পটা বদলাতে চায় মোহকরানি। না-হলে তাদের মা অর্থাৎ পাহাড়, জঙ্গল, বন্যপ্রাণী এবং সমগ্র প্রকৃতি হাইজ্যাক করে নেবে বিশ্বায়ন। প্রযুক্তির বিশ্বায়ন ঘটে, ঘটে না মানবিকতার।
এই পাহাড়ে ৯৩টি গ্রামের জন্য তিনটি স্কুল আর দু’টি হেলথ সেন্টার। এটা উন্নতি নয়, অনেকে এটাকে জেনোসাইড বলেন। ম্যান মেড। প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর যাতে শুনতে না পাওয়া যায় বা তাদের অস্তিত্ব সংকট ঘটানোর এক নিখুঁত ডিজাইন! ওরা ভুলে গেছে নেটিভ আমেরিকানদের সেই বিখ্যাত প্রবাদ:
‘When the last tree is cut, the last fish is caught, and the last river is polluted, you will realize that you cannot eat money.’
ভুট্টা খেতের পাশে ছোট্ট ফাঁকা জমিতে বাবা ও মেয়ে প্রতিদিন ১-২ চারা গাছ লাগায়। মোহক জানে ও থাকবে না। কিন্তু এই চারা গাছগুলি একদিন ছড়িয়ে পড়বে, দখল করে নেবে ২,০০০ বিঘারও বেশি জমি। সেদিন আবার অরণ্য ফিরবে, বন্যপ্রাণ ফিরবে, কেউ গৃহহীন হবে না।
ক্যামেরা চলছে না। সব রূপকথা লেন্সে তুলে রাখা যায় না। মুগ্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে দেখতে হয় এইসব অচেনা অজানা রূপকথা।