মেলার মধ্যে কেউ পেয়েছেন অযাচিত জনপ্রিয়তা, জনসমুদ্রে কেউ ছেড়ে গিয়েছেন সংসারের বোঝা কোনও বৃদ্ধ আপনজনকে। কেউ-বা আবার চোখের সামনে লক্ষ মানুষের পায়ের চাপে পিষ্ট হতে দেখেছেন তাঁর প্রিয়জনকে। বুকফাটা কান্নার নোনাজল মিশেছে পবিত্র সঙ্গমে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেমন ক্রিস্টাল তৈরি হয়েছিল সেদিন প্রয়াগরাজের জলে? ড. এমোতো কি বলতে পারবেন! গঙ্গা-যমুনার স্মৃতিতে কি থেকে যাবে সেই সব নোনাজলের হিসেব!
এক ছিল গাছ। মস্ত এক দিঘির ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। একলা। মাঝে মাঝে এক পাখি এসে বসত তার ডালে। গল্প হত, গান শোনাত পাখি। তারপর কেন যেন পাখি আর এল না! দিন যায়, রাত যায়। পাখির পথ চেয়ে থাকে সে গাছ। পাখি আর আসে না। নিঃসঙ্গ গাছ একদিন আবিষ্কার করে আর এক গাছকে। তার খুব কাছেই। তার পায়ের নিচেই ডুব দিয়েছে দিঘির জল। এত কাছেই ছিল, অথচ খেয়াল করেনি সে! মিতেন পাতায় তার সঙ্গে। মিতেন আসলে তার নিজেরই ছায়া। জল স্থির থাকলেই তার সঙ্গে দেখা হয়। গাছ উজাড় করে দেয় মনের কথা তার ছায়ার কাছে। কান পেতে শোনে ডুবছায়া জল। বলেও বুঝি-বা। কিন্তু জল কি মনে রাখে গাছের সব কথা? কে জানে!
তবে শুধু গাছ কেন, মানুষেরও তো এমনটা হয়। আলসে দুপুরে জলের ধারে বসে উদাস হয় মন। জলের কাছে এলে সহজ হয়ে যায় মনের পাকদণ্ডী। অশান্ত মন স্রোতে ভেসে যায়। পড়ে থাকে স্থিতধী মন, থিতিয়ে পড়া নরম পলির মতো। কথা রাখে জল। গোপনীয়তার সৌজন্য তার দু’কূল জুড়ে। কিন্তু আবারও সেই প্রশ্ন জাগে, জল কি মনে রাখে সব কথা! ‘পা-ডোবানো অলস জল, এখন আমায় মনে পড়ে?/ কোথায় চলে গিয়েছিলাম ঝুরি-নামানো সন্ধ্যাবেলা/ খুব মনে নেই আকাশ-বাতাস ঠিক কতটা বাংলাদেশের/ কতটা তার মিথ্যে ছিল বুকের ভিতর বানিয়ে-তোলা…’।
জলের নাকি স্মৃতি আছে। এমন এক অদ্ভুত তত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিলেন ফরাসি ইমিউনোলজিস্ট জ্যাক বেনভেনিস্ত, আটের দশকে। রোগ প্রতিরোধী বা ইমিউন কোষের অ্যালার্জি-প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁর গবেষণা। তিনি দেখেন, অতীতে যদি কোনও ইমিউন কোষ কোনও অ্যালার্জেন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী উপাদানযুক্ত জলের সংস্পর্শে এসে থাকে, তাহলে পরেও সেই কোষগুলি জলের সংস্পর্শে এলে সাড়া দেয় বা সক্রিয় হয়ে যায়– সেই জলে অ্যালার্জেন না থাকলেও। ‘নেচার’ পত্রিকায় তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা জলের মধ্যে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তথ্য পাঠাতে পারি। জৈব মলিকিউলগুলো জলে বিশেষ রেডিও তরঙ্গ তৈরি করে। এই রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমেই তারা তথ্যের আদান প্রদান করে’।
নাহ্! তাঁর এ দাবি মেনে নেয়নি বিজ্ঞানী-সমাজ। জীবদ্দশায় তাঁর কপালে জুটেছে কেবলই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। অথচ বেনভেনিস্তের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই নোবেলজয়ী ফরাসি বিজ্ঞানী লুক মঁতানিয়ের প্রমাণ করে দিলেন বেনভেনিস্তের দাবিটি ঠিকই ছিল। মঁতানিয়ের এইচআইভি ভাইরাসের আবিষ্কর্তা। তিনি দেখালেন ভাইরাস জলের সংস্পর্শে এলে জলে তার ছাপ রেখে যায়। ভাইরাসযুক্ত জলকে চূড়ান্তরকম তরলীকরণ করা হয় যাতে জলে ওই ভাইরাসের চিহ্নমাত্র না থাকে। তারপর ওই জলের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক সিগন্যাল পাঠানো হয়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে, প্যারিস থেকে ইতালিতে, মঁতানিয়ের সহকর্মীদের কাছে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, পর্দায় জলের তরঙ্গের ছবির মধ্যে ফুটে উঠছে সেই ভাইরাসের ছাপ। তার মানে জলে আর ভাইরাস না থাকলেও জলের স্মৃতিতে ধরা আছে ভাইরাসের ছবি!
শুধু ভাইরাস নয়, ব্যাকটিরিয়া বা কোষের অস্তিত্ব নির্ণয় কিংবা আকার পুনঃনির্মাণ করার ক্ষেত্রে, এক কথায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জলের স্মৃতি কি তাহলে এক উপযোগী পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে? পারে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ভিতটাই দাঁড়িয়ে আছে জলের স্মৃতির তত্ত্বের ওপর। সুস্থ মানুষের বিশেষ কোনও মলিকিউল জল বা অ্যালকোহলে অতিমাত্রায় দ্রবীভূত করে অসুস্থ মানুষের দেহে দেওয়া হয়। সুস্থ মানুষের উপসর্গ জলের স্মৃতিতে ধরা থাকে। সেই স্মৃতি কাজে লাগিয়েই অসুস্থ মানুষের নিরাময় হয়।
জাপানি সংস্কৃতির পরতে পরতে মিশে আছে ভালো থাকার সহজপাঠ। জীবনকে সহজভাবে যাপন করা বেশ কঠিন বলেই হয়তো অনেক জাপানি লেখক এই সহজপাঠ রচনা করছেন, যা পাঠকদের নিজেকে নিয়ে দু’দণ্ড ভাবতে শেখাচ্ছে। বলা ভালো, আত্মদর্শন করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। আদপে যাকে আমরা জাপানি জীবনদর্শন বলি, তা হয়তো দেশকালের গণ্ডির বাইরে চিরন্তন জীবনবোধ। জাপানি লেখক ড. মাসারু এমোতোর লেখা ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অফ ওয়াটার’ এমনই এক জীবনশৈলীর কথা বলে যেখানে মানব মনের প্রতিফলন ঘটে জলে। ড. এমোতো মনে করেন জলের চেতনা আছে এবং জল মানুষের অনুভূতি বা চিন্তার প্রত্যুত্তরে সচেতনভাবে সাড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘জল সব মনে রাখে। এমনকী মানুষের ভাবনা এবং বলা কথাও।’ অর্থাৎ কি না এ মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান জলের স্মৃতিতে ধরা আছে। তাই জলের পাঠশালায় আমরা চিরন্তন পড়ুয়া।
ড. এমোতো তাঁর বইতে জলের ক্রিস্টাল-এর অনেক ছবি দিয়েছেন– যার মধ্যে ছন্দোময় এবং সুদৃশ্য ক্রিস্টালগুলো নাকি তৈরি হয়েছে মানুষের ইতিবাচক ভাবনা এবং সুন্দর কথার প্রেক্ষিতে; আর বেখাপ্পা-বেয়াড়া আকারের ক্রিস্টালগুলো মানুষের নেতিবাচক চিন্তার প্রতিফলনে। ড. এমোতোর এই তত্ত্বের কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তা না থাক, এই তত্ত্ব যদি মানুষকে এক ইতিবাচক জীবনবোধের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তবে ক্ষতি কি! তাঁর মতে, মানুষ তার সুস্থ চিন্তার মধ্যে দিয়ে জলের গুণগত মান বাড়াতে পারে। আর তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের ভালো থাকা। ভারতীয় দর্শনে জল জীবনের প্রবহমানতার প্রতীক। সেও তো ভাল থাকারই গল্প বলে।
সদ্য শেষ হল দেশের সবচেয়ে বড় জল-মহোৎসব। এলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে ক্যালেন্ডারের হিসেব মেনে হয় কুম্ভ। এবারের কুম্ভ ‘মহা’ আখ্যা পেয়েছে। তার গায়ে চেপেছে ‘১৪৪ বছরে একবার’-এর দুর্লভতা। এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। তবে এমন মহাকাণ্ডের রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে দ্বিমত নেই। কুম্ভ নামের এই জলস্তম্ভ যে গড়পড়তা ভারতবাসীর বিশ্বাসের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু ভারতই বা বলি কেন, মহাকুম্ভে ডুব দিয়েছেন বহু বিদেশি, বিদেশিনীও। ভক্তি, বিশ্বাস, হুজুগ, কৌতূহল– কারণ যা-ই হোক। যা ছিল একদিন সর্বত্যাগী সাধকদের নিরালম্ব মিলনমেলা, কালে-দিনে তা-ই হয়ে উঠল সর্বজনের উৎসবক্ষেত্র। গুটিকের গুহ্যসাধন মার্গে কোটিকের ঢল। বিপণনের দক্ষতায় এবারের কুম্ভমেলা রেকর্ড গড়ার দোরগোড়ায়। সেকথা থাক। ফিরে আসি জলে।
কোটি কোটি মানুষের পাপ ধোওয়ার ঠেকা নিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে সঙ্গমের জলের। পুণ্যস্নানের বর্জিত ক্লেদ, জলের দূষণের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বহু বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সঙ্গমের জল স্নানের অযোগ্য, সেকথা ল্যাবরেটরি টেস্টিং-এ প্রমাণিত হলেও তা সরকারি শীলমোহর পায়নি। সেটাই স্বাভাবিক। সংসদে আমাদের নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিরা জোর গলায় বলেছেন কুম্ভের জল দূষিত নয়। ‘ন হন্যতে’-র সেই কথাগুলো মনে পড়ে যায়। কাঠের টেবিলে খাওয়া! ঠাকুরমার বিধানে সে ভারি ম্লেচ্ছ কাজ। তবে অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করা গেল। তাঁকে বোঝানো হল, ‘বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই’। এলি-তেলি মেলা তো নয়, মহাকুম্ভ বলে কথা, সে জলেও ‘দোষ নেই’!
মহাকুম্ভের জল কি মনে রাখবে তার এই কলুষায়নের ইতিহাস? মনে কি রাখবে, এত কোটি মানুষের পাপের খতিয়ান, প্রার্থনার আকুতি কিংবা আবেগের আতিশয্য? মেলার মধ্যে কেউ পেয়েছেন অযাচিত জনপ্রিয়তা, জনসমুদ্রে কেউ ছেড়ে গিয়েছেন সংসারের বোঝা কোনও বৃদ্ধ আপনজনকে। কেউ-বা আবার চোখের সামনে লক্ষ মানুষের পায়ের চাপে পিষ্ট হতে দেখেছেন তাঁর প্রিয়জনকে। বুকফাটা কান্নার নোনাজল মিশেছে পবিত্র সঙ্গমে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেমন ক্রিস্টাল তৈরি হয়েছিল সেদিন প্রয়াগরাজের জলে? ড. এমোতো কি বলতে পারবেন! গঙ্গা-যমুনার স্মৃতিতে কি থেকে যাবে সেই সব নোনাজলের হিসেব!
‘মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল’, তা যে কেবলই গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নেমে যায়। হয়তো-বা লজ্জায় মুখ লুকোয় আমাদের সীমাহীন লোভের সামনে। ‘অনেক নদীর জল উবে গেল…’। জল কি কোনওদিন ভেবেছিল, তাকেও কর্পোরেটদের দাসত্ব করতে হবে! নামমাত্র পয়সার বিনিময়ে মাটির তলার জল দেদার তুলে বোতলবন্দি করে বেচার অনুমতি দেয় যে রাষ্ট্র, তার কাছে কি কোনও কৈফিয়ত চাইবে না জল! বিশুদ্ধ জলের এক নতুন ‘বিজ্ঞানসম্মত’ সংজ্ঞা তৈরি করে দিয়েছে কর্পোরেটরা। বোতলবন্দি জলই পানযোগ্য জল। বিপরীতে, মহাকুম্ভ, জলের বিশুদ্ধতার অন্য এক সংজ্ঞার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল তাবৎ মানুষকে। সে বিশুদ্ধতা বোধহয় ‘ধর্মসম্মত’। কুম্ভপ্লাবনে ভেসে গেল বিজ্ঞানমনষ্ক ভারতের অহং। জল, তোমার স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখো এক যুক্তিবাদী ভারতের ছবি। যা শাশ্বত, যা চিরন্তন। চমৎকার সব ক্রিস্টাল ফুটে উঠুক তোমার বুকে। সুখময় হোক তোমার স্মৃতি। খুশি থেকো তুমি। হৃদি ভেসে যাক, অলকানন্দা জলে…।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….