রোগা হওয়ার এই যে প্রবণতা, মানসিক চাপ আমাদের কোন পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে? আমরা সবাই রোগা হতে চাই, আমাদের রোগা হতে চাওয়াকে কোথাও ‘জোর’ করা হয়। আমরা ‘বডি শেমিং’-এর প্রতিবাদ করি। কিন্তু মনে মনে রয়েছে সকলের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানোর উদগ্র বাসনা। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, যে কোনও অনলাইন পোর্টাল খুললেই মিলবে রোগা হওয়ার আদর্শ রেসিপি। ‘হেলদি ডায়েট’ আর শারীরিক কসরত নিয়ে ভূরি ভূরি জ্ঞান।
‘তুই আর খাস না। এরপর ফেটে যাবি। শুধু চিয়া সিডস খা, চিয়া সিডস।’
‘কী রে তুই এত মুটিয়ে গেলি কী করে?’
‘এ বাবা, তোকে না ভীষণ মোটা লাগছে। এই জামাটা পরে একদম মানাচ্ছে না।’
‘এত মোটা হয়ে গেলে কী করে মা? বাড়িতে সারাদিন শুয়ে-বসে আরামে থাকো নিশ্চয়ই!’
‘কী রে হাতি! রাস্তাঘাটে কাউকে ধাক্কা মেরে তাকে সোজা ওপরে পাঠিয়ে দিস না আবার!’
‘তুমি যা মোটা হয়েছ, পাতি হেঁটে কিছু হবে না। জিমে যাও জিমে। আর ভাত-রুটি একদম ছেড়ে দাও।’
এই সমাজের হলটা কী বলুন তো? দেখা হলে কেউ আর কুশল বিনিময় করে না। শুধু চেহারা নিয়ে জ্ঞান দেয়। মোটা হলেও বিপদ, রোগা হলেও। আবার মোটা থেকে রোগা হলে আরও বিপদ। তখন এই জ্ঞানদানকারীরাই মুষড়ে পড়বে আপনার শরীর-চিন্তায়। কী জানি গোপন কোনও রোগ-টোগ হল না কি!
আপনাদের চাহিদাটা ঠিক খোলসা করে বলুন তো! রোগা হওয়ার কোনও সহজ উপায় আছে কি? শুধু যে মোটাদেরই জ্বালা, এমনটা নয়। রোগাদেরও একই কপাল। ‘তুই যা রোগা, দেখিস আবার হাওয়া দিলে উড়ে যাস না!’ লম্বা হলে তকমা জুটবে ‘তালগাছ’, বেঁটে হলে ‘দেড় ফুটিয়া’। তেল তো খুব একটা সস্তাও নয় যে, ‘যাই একটু পরের চরকায় তেল দিয়ে আসি!’– এমনটা মনে হতে পারে। আপনার সামনের মানুষটা মোটা, রোগা, লম্বা, বেঁটে– যা-ই হোক না কেন, তার চেহারা নিয়ে একটা তির্যক মতামত দিতেই হবে? আপনি যাকে বলছেন, জানেন তার মেডিকেল হিস্ট্রি? কোনও হরমোনাল ডিজঅর্ডার আছে কি না, কিংবা বিশেষ মেডিকেশনে এমনটা হয়েছে কি না! আপনাকে যদি কেউ এমনভাবে বলে, সহ্য করতে পারবেন তো? কারওর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করে, তাকে ছোট দেখিয়ে কী সুখ পান বলুন তো? সেডিস্টিক প্লেজার পাওয়া যায় বুঝি? ধিক্কার জানাই এ-সকল মানুষকে! নিজেরা সুস্থভাবে বাঁচুন, অপরকে বাঁচতে দিন। দয়া করে কারওর মনোবল ভেঙে দেবেন না। খুব কাছের মানুষকেও এমনভাবে বলা যায় না, বিশ্বাস করুন। আপনি যেভাবে বলেন, সেটাকে মোটেই ‘কনসার্নড’ হওয়া বলে না। আপনি জেনে-বুঝে, ইচ্ছা করে, কিংবা খিল্লি ওড়াবেন বলেই বলেন। ‘এ মোটা’ কখনও উদ্বেগ থেকে আসে না। আর মোটা মানুষরাই বেশি খায়, এটাই বা কে বলল?
মানুষের গুণগুলো দেখার চেষ্টা করুন। প্রশংসা করতে শিখুন। সংবেদনশীল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন। মোটা কিংবা রোগা যে যা-ই হোক, সুস্থ থাকাটা জরুরি। ‘বডি পজিটিভিটি’-র নামে যেমন ওবেসিটি প্রোমোট করার প্রয়োজন নেই, তেমনই চেহারা নিয়ে অস্বস্তিকর কথা বলারও অধিকার আপনার নেই। মোটা মানেই অসুস্থ, আর রোগা কিংবা ‘জিম করা বডি’ মানেই সে রোগমুক্ত– এমন বুদ্ধির গোড়ায় শান দিন।
অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লাকে মনে আছে? হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল! স্বাস্থ্য সচেতন। জিমে গিয়ে রীতিমতো শরীরচর্চা করতেন। তাহলে হঠাৎ কী এমন হয়েছিল? চিকিৎসকদের একাংশ বলেছিলেন, অতিরিক্ত শারীরিক কসরতই অসময়ে মৃত্যু ডেকে এনেছিল তাঁর। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শরীরচর্চাও ক্ষতিকর। ক্রমাগত মাস্ল বজায় রাখা কিংবা ‘শেপ’-এ থাকার চেষ্টায় মানসিক চাপ তৈরি হয়, তার প্রভাব পড়ে শরীরের ওপর। ২০২২-এ হিন্দি টেলিভিশন জগতের পরিচিত মুখ ৪১ বছর বয়সি দীপেশ ভান মারা যান। কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। জানা গিয়েছে, যথেষ্ট শরীর-সচেতন ছিলেন তিনি। মদ কিংবা সিগারেট তিনি খেতেন না। শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর– এমন সব কিছু তিনি কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতেন। তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মীরাও হতবাক। তাঁর এক সহকর্মী-বন্ধু জানান– দীপেশকে বাড়তি মেদ ঝরাতে তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন। খাবারদাবারেও বলেন নিয়ন্ত্রণ আনতে। সেই পরামর্শ দীপেশকে কোথাও যেন ট্রিগার করে। জিমে গিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে এক্সারসাইজ করতেন। ট্রেডমিলে মাত্রাতিরিক্ত দৌড়তেন। করতেন কড়া ডায়েট। এমনকী রাতে খাবার খাওয়াও পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সারাক্ষণ যেন নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ। বারণ করা সত্ত্বেও কান দেননি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে বেঙ্গালুরুর একজন মহিলার কথা, যিনি জিমে ওয়েট লিফটিং-এর সময় মাথা ঘুরে পড়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মস্তিষ্কের অ্যানিউরিজ্ম ফেটে যাওয়ার কারণে সেরিব্রাল রক্তক্ষরণের ফলে এই বিপর্যয়। চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করছেন অতিরিক্ত এবং দীর্ঘক্ষণ ওয়েট লিফটিং না করতে। এতে কী হয়, রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে মাত্রাছাড়া হয়ে যায় যখন, তখন ঘটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। আর তখনই মারা যায় একটা মানুষ। সম্প্রতি অতিরিক্ত জিম এবং কড়া ডায়েটের জেরে ফাঁকা বাড়িতে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে শোনা যায় মডেল-অভিনেত্রী সায়ন্তনী গুহঠাকুরতাকে। দুম করে পড়ে যাওয়ায় পায়ের পাতার হাড় তাঁর ভেঙে গিয়েছে। পরে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন ছবির প্রয়োজনে রোগা হওয়ার কারণেই মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চা করছিলেন তিনি। অল্প সময়ে দ্রুত সফলতা পেতে গিয়েই তাঁর এই অবস্থা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লাকে মনে আছে? হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল! স্বাস্থ্য সচেতন। জিমে গিয়ে রীতিমতো শরীরচর্চা করতেন। তাহলে হঠাৎ কী এমন হয়েছিল? চিকিৎসকদের একাংশ বলেছিলেন, অতিরিক্ত শারীরিক কসরতই অসময়ে মৃত্যু ডেকে এনেছিল তাঁর। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শরীরচর্চাও ক্ষতিকর। ক্রমাগত মাস্ল বজায় রাখা কিংবা ‘শেপ’-এ থাকার চেষ্টায় মানসিক চাপ তৈরি হয়, তার প্রভাব পড়ে শরীরের ওপর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রোগা হওয়ার এই যে প্রবণতা, মানসিক চাপ আমাদের কোন পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে? আমরা সবাই রোগা হতে চাই, আমাদের রোগা হতে চাওয়াকে কোথাও ‘জোর’ করা হয়। আমরা ‘বডি শেমিং’-এর প্রতিবাদ করি। কিন্তু মনে মনে রয়েছে সকলের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানোর উদগ্র বাসনা। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, যে কোনও অনলাইন পোর্টাল খুললেই মিলবে রোগা হওয়ার আদর্শ রেসিপি। ‘হেলদি ডায়েট’ আর শারীরিক কসরত নিয়ে ভূরি ভূরি জ্ঞান। শুধু মনে মনে একটা প্রতিযোগিতা লড়িয়ে দেওয়া– কে কার চেয়ে আরও কতটা সুন্দর দেখাতে পারে। কতটা বডি হাগিং জামা পরলে কড়া কসরত করা শরীরের সব রেখা হতে পারে স্পষ্ট। কিন্তু কেউ ভেবেছেন কি, অতিরিক্ত আঁটসাঁট পোশাকও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর! তুলনামূলক ঢোলা পোশাকে যদি কমফর্টেব্ল হন তো সেটাই পরুন। কে কী বলল, কী যায়-আসে বলুন তো? আজ যারা আপনার চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করছে, তারা কেউ আপনার নিজের নয়। নিজের মানুষ কিন্তু সুস্থ থাকতে বলে, বডি শেমিং করে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রিংকা চক্রবর্তী-র লেখা: মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মানুষ আজকাল শুধু প্রোটিন সাপ্লিমেন্টের ওপর বেঁচে আছে। সুষম আহার খেতে ভুলে যাচ্ছে। এই যে একটা ‘পলিশড’ হওয়ার চেষ্টা ক্রমাগত, তা কি অচিরেই বিপদ ডেকে আনছে না? কেউ বলছে ওটস খাও, সমীক্ষা বলছে, অতিরিক্ত ওটস খেলেও ওজন বাড়তে পারে। কী ডায়েট ফলো করবেন– কিটো, পালেও, না কি এইসবের পালে হাওয়া দেবে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং? আচ্ছা, ফাস্টিং-পর্বে অতক্ষণ যে খালি পেটে থাকবেন, সেটা প্রেশার ফল করবে না তো ? সবাই বলছে পালং শাকের জুস খাও। কিন্তু আজকাল যে শাকপাতায় রাসায়নিক মেশাচ্ছে! কাঁচা শাকের পাকা রসেও তো কীসব সতর্কতা জারি হয়েছে! তাহলে? নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কখনও– পরের কথায় গা ভাসাব, না কি সুষম আহার আর পরিমিত শরীরচর্চা করে সুস্থ থাকব? সবেরই একটা মাত্রাবোধ থাকা জরুরি। করারও, বলারও। তাই জ্ঞান দেওয়া এবং নেওয়ার ক্ষেত্রেও নিজেকে প্রশ্ন করাটা খুব প্রয়োজন। উত্তর না পেলে প্রশ্ন করাটা থামাবেন না।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………