Robbar

নারী শরীরের পণ্যায়নের সমালোচনা করতে গিয়ে মিলা ম্যাগি যৌনশ্রমিকদের অপমানই করলেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 3, 2025 8:22 pm
  • Updated:June 5, 2025 11:14 am  
An article on milla magee and her controversial statement by Somdatta Mukherjee

নারী সংগ্রামের লড়াই তাই চিরকালই দুই রকম ক্ষমতার বিরুদ্ধে। এক পিতৃতন্ত্র, যা নারীর যৌনতাকে ভয় পায় এবং সেই কারণে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এবং দুই পুঁজিবাদ, যা নারীর যৌনতাকে পণ্য করে, কিন্তু তাকে সম্মান দিতে অস্বীকার করে। এই লড়াইয়ের পথ হল যৌন শ্রমিকদের নিশ্চিত মানবাধিকারের দাবি, নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার মর্যাদার দাবি, ‘বেশ্যা’ শব্দটি ঘৃণার অস্ত্র হিসেবে না ব্যবহার করা, এবং প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের ভাষা– দুটোকেই একসঙ্গে ধরে রাখা। 

সোমদত্তা মুখার্জি

মিলা ম্যাগি, ২০২৫ সালের মিস ইংল্যান্ড হলেন, এবং সম্প্রতি ভারতের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। তাঁর অভিযোগ, প্রতিযোগিতার আয়োজকরা তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন, যেখানে তাঁর নিজেকে ‘বেশ্যা’ মনে হয়েছে। বিউটি কনটেস্টের বিরুদ্ধে কোনও বিজয়ী প্রতিযোগী এইভাবে মুখ খোলেননি এর আগে। প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর বিরুদ্ধে মুখ খোলার এটি প্রথম দৃষ্টান্ত। এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীর সামাজিক অবস্থান এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

No photo description available.
‘মিস ইংল্যান্ড’ মিলা ম্যাগি

মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স, ভিক্টোরিয়া’স সিক্রেট– সবই মূলত নারীর সৌন্দর্য ও যৌনতাকে পণ্যে পরিণত করে, মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার করে। এই পুঁজিবাদী শোষণের প্রতীককে মানুষের কাছে বিক্রি করা হয় নারীর সৌন্দর্য ও প্রতিভা প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে, ‘বিউটি উইথ এ পারপাস’ শিরোনামের আড়ে। মিলা ম্যাগি (Milla Magee) নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, এই প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ধাপ চূড়ান্ত অপমানজনক। ২৪ ঘণ্টা ধরে মেকআপ পরে থাকতে হয়, ধনী পুরুষদের সামনে হাঁটতে হয় শুধু তাদের মনোরঞ্জনের জন্য। এবং সেই পুরুষদের টেবিলে গিয়ে সঙ্গ দিতে হয়। তিনি আরও বলেছেন যে, প্রতিটি টেবিলে ছ’জন স্পনসর পুরুষের সঙ্গে বসানো হয় দু’জন সুন্দরী প্রতিযোগীকে, মোট আটজনের একটি টেবিল। সেখানে কেউ প্রতিযোগিতার অর্থ বোঝে না। সবাই শুধু শরীর মাপে, চোখ দিয়ে গিলে খায়। তার ভাষায়, ‘আমরা সেখানে ছিলাম এদের আনন্দ দেওয়ার জন্য, সার্কাসের বাঁদরের মতো বসে থাকার জন্য।’

অতঃপর, মিস ইংল্যান্ড হয়ে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসে, শেষমেশ নাম তুলে নিয়ে ফিরে গেছেন মিলা ম্যাগি। মিলা ম্যাগির এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক সাহসী প্রতিবাদ, নারীর আত্মমর্যাদা ও অধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। বিজয়ী মঞ্চ অবধি পৌঁছে তার এই সরে আসা, নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদার দাবিতে এক জোরালো আওয়াজ।

……………………………..

তাঁর নিজেকে ‘বেশ্যা’র সঙ্গে তুলনাকে ভাষার দায়িত্বহীন ব্যবহার হিসেবে দেখাই উচিত, যেখানে তিনি ‘বেশ্যা’ শব্দটিকে অপমানের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করলেন। এই ভাষার ব্যবহার যৌন শ্রমিকদের প্রতি অসম্মানের। যৌন শ্রম একটি বাস্তব পেশা, এবং অনেকেই এই পেশায় আসেন আর্থিক সংকট, লিঙ্গগত বৈষম্য, শ্রেণিগত বঞ্চনা অথবা উপার্জনের বিকল্পের অভাবে। তাঁদের এই পেশাকে ছোট করে দেখা, তাঁদের অপমান করা– এটা কোনও প্রতিবাদের যথার্থ ভাষা হতে পারে না। 

……………………………..

মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতাও একটা বৃহৎ পুঁজিবাদী কাঠামোর অংশ, যেখানে পণ্য নারীর সৌন্দর্য, এবং মুনাফা পুরোটাই এই কাঠামোর। এবং এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তাদের একটি নির্দিষ্ট সৌন্দর্য মানদণ্ডে ফেলে দেওয়া হয়। মিলা ম্যাগির প্রতিবাদ এই পুঁজিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি প্রতীক।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মিলা ম্যাগির বক্তব্যের সমস্যা নিয়েও কথা বলা দরকার।

তাঁর নিজেকে ‘বেশ্যা’র সঙ্গে তুলনাকে ভাষার দায়িত্বহীন ব্যবহার হিসেবে দেখাই উচিত, যেখানে তিনি ‘বেশ্যা’ শব্দটিকে অপমানের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করলেন। এই ভাষার ব্যবহার যৌন শ্রমিকদের প্রতি অসম্মানের। যৌন শ্রম একটি বাস্তব পেশা, এবং অনেকেই এই পেশায় আসেন আর্থিক সংকট, লিঙ্গগত বৈষম্য, শ্রেণিগত বঞ্চনা অথবা উপার্জনের বিকল্পের অভাবে। তাঁদের এই পেশাকে ছোট করে দেখা, তাঁদের অপমান করা– এটা কোনও প্রতিবাদের যথার্থ ভাষা হতে পারে না।

ম্যাগির বক্তব্যের মর্ম এই যে– তার শরীর, উপস্থিতি এবং ব্যক্তিত্বকে যেভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তাতে তিনি নিজের ওপর নিজের অধিকার হারিয়ে ফেলছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তাকে এমন একটা অবস্থায় ফেলা হয়েছিল, যেখানে তিনি ‘ক্ষমতাহীন’, এবং ‘দর্শকদের খুশি করার জন্য নিযুক্ত’, যা তার আত্মসম্মানের পরিপন্থী। কিন্তু তার বর্ণনার ভাষা– যৌন শ্রমিকদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষের ছবিকেই আরও প্রকট করে।

কিন্তু পুঁজিবাদ ও নারী শরীরের পণ্যায়নের সমালোচনা করতে গিয়ে যৌন শ্রমিকদের অসম্মান করা যায় না। তাদেরও নিজের শরীরের ওপর অধিকার আছে, এবং তারা কোনও বস্তু হিসেবে নয়, এক একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সমাজে বাঁচার অধিকার রাখেন।

ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘বেশ্যা’ পরিচিতি– বা তাকে ঘিরে ঘৃণা, লজ্জা, অপমান– এই পুরো কাঠামোটাই পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার জোট।

May be an image of 1 person, blonde hair, surfboard, beach and water
ফটোশুটে মিলা ম্যাগি

পিতৃতন্ত্রে নারীর যৌনতা চিরকাল থাকবে পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন– সেই নিয়ন্ত্রণের সাফল্য নির্ধারিত করে ‘সৎ’ এবং ‘অসৎ নারী। ‘সৎ নারী’ সে, যে কেবল সংসারের জন্য, এবং একজন পুরুষের অধিকৃত। ‘অসৎ নারী’, বা ‘বেশ্যা’ সেই নারী, যে নিজের শরীর বা যৌনতা নিজের ইচ্ছেয় ব্যবহার করে– পেশার কারণে হোক বা স্বাধীনতার কারণে। একইভাবে, যে নারীই পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ভাঙে, তাকেই ‘দোষী’, ‘অপরাধী’, ‘নষ্টা’, ‘বেশ্যা’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়।

পুঁজিবাদ আবার এই নারী-বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিকেই নিজের লাভের জন্য কাজে লাগায়। যৌনতা, শরীর, রূপ– সবকিছুকে বাজারে আনে পণ্য বানিয়ে। সিনেমা, বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন শো, বিউটি কনটেস্ট– সব জায়গায় নারীই দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। দ্বিচারিতা এমনই যে, একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর যৌনতা ভোগও করে, অন্যদিকে তাকে ‘বেশ্যা’ বলে খেউড়ও করে।

এই দ্বিচারিতা শোষণ এবং নীতিবোধের ভণ্ডামির চরম প্রকাশ; এবং বেশ্যাবৃত্তি সামাজিক নির্মাণ না হলেও, অপমানের ধারণাটি নির্মাণ করেছে আমাদের সমাজই। যৌন শ্রমিক হওয়া মানেই নোংরা, বা অনৈতিক– এই ধারণাটা তৈরি করা হয়েছে অত্যন্ত নিপুণভাবে; যাতে সমাজ তাদের ‘মানুষ’ হিসেবেই না দেখে, যেন রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করতে পারে, যেন তারা চুপ থাকে, সংগঠিত হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার দাবি না করে।

এইভাবে ‘বেশ্যা’ পরিচিতিকে কলঙ্কিত করে একদিকে সমাজে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রতিষ্ঠা করে, পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র যাতে তাদের দেহ ব্যবহার করে লাভ তুলতে পারে– সেই পথকে মসৃণ করা হয়।

কাজেই সবসময় মনে রাখতে হবে, ‘বেশ্যা’ শব্দটি একটা ক্ষমতার চাবিকাঠি। যে কোনও নারী– যিনি পুরুষতান্ত্রিক শাসনের বাইরে যান, খোলামেলা পোশাক পরেন, স্বাধীনভাবে প্রেম করেন, এবং প্রতিবাদ করেন– তাকেই এই উপাধি দেওয়া যায়। ‘বেশ্যা’ কোনও বাস্তব পরিচয়ই নয়, আদতে একটা রাজনৈতিক উপাধি বা দাগ, যার উদ্দেশ্য নারীকে চুপ করিয়ে রাখা।

নারী সংগ্রামের লড়াই তাই চিরকালই দুই রকম ক্ষমতার বিরুদ্ধে। এক পিতৃতন্ত্র, যা নারীর যৌনতাকে ভয় পায় এবং সেই কারণে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এবং দুই পুঁজিবাদ, যা নারীর যৌনতাকে পণ্য করে, কিন্তু তাকে সম্মান দিতে অস্বীকার করে। এই লড়াইয়ের পথ হল যৌন শ্রমিকদের নিশ্চিত মানবাধিকারের দাবি, নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার মর্যাদার দাবি, ‘বেশ্যা’ শব্দটি ঘৃণার অস্ত্র হিসেবে না ব্যবহার করা, এবং প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের ভাষা– দুটোকেই একসঙ্গে ধরে রাখা।

Miss England Milla Magee wages war on body stereotypes

 

মিলা ম্যাগির (Milla Magee) এই প্রতিবাদ এবং এই পুরো ঘটনার মাধ্যমে একটা জিনিসই স্পষ্ট হয় যে, নারীর সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে হলে আমাদেরকে এই ধরনের প্রতিযোগিতার পুঁজিবাদী কাঠামোকে প্রশ্ন করতে হবেই। নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এই দাবিতে রুখে দাঁড়াতে হবে যেখানে যখন প্রয়োজন।

প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর বিরুদ্ধে কোনও বিজয়ী প্রতিযোগী মুখ খুললেন, সরব হলেন, অপমানের কেন্দ্র থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন, তাই গণচেতনায় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন– ‘সৌন্দর্য মানে কী?’, ‘কে ঠিক করে কাকে সুন্দর বলা হবে?’, ‘আমরা নারীদেহকে নিয়ে কী করছি?’ আশা করা যায় ভবিষ্যতের প্রতিযোগীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, এবং আরও বাড়বে এতে। এবং তাহলে নিশ্চিত আয়োজক সংস্থাগুলোর ওপর চাপ পড়বেই, কারণ যদি বারবার এমন প্রতিবাদ হলে, স্পনসররা পিছিয়ে যাবে। এই পথ ধরেই যদি মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে এই কাঠামোর!

মিলা ম্যাগির প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব বদল না আনলেও, এটা ফাটলের মতোই কাজ করুক– যেখান থেকে প্রশ্ন, চেতনা, এবং ভবিষ্যতের আন্দোলনের রাস্তা তৈরি হবে।

একটা প্রতিবাদই যথেষ্ট নয়, কিন্তু একটি প্রতিবাদই শুরু করতে পারে দারুণ বিপ্লব।

…………………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

…………………………..