সাধারণ মানুষ যখন দিনের পর দিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষার না করা নিয়ে সবর হয়, এবং দেখে যে তা নিয়ে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, তখন ক্ষোভ আকারে বড় হতে থাকে। একটা সময় সে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বলের ওপরে। সে তখন ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে চায়, সে নিজের হাতে নিয়ম তুলে নেয়। তার নিজের অক্ষমতাকে অতিক্রম করে সে তখন রাষ্ট্রের প্রতিরূপ হিসেবে ক্ষমতা জাহির করে, নিয়ম জাহির করে। সে কারণেই তার মনে হয় না সে কোনও অন্যায় করছে। কারণ দেশের বা রাষ্ট্রের নিয়মাবলি তাকে কোনও সাহায্য করেনি। তার উপকারে লাগেনি। তাই সে নিজে কাজে নামে। আর ক্ষমতা সবসময় কোপ মারে দুর্বলেরই ওপর। তাই মব খুঁজে নেয় একা একটা মানুষকে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
আমার কর্মজীবনে দেখেছি মানুষের ছোট ছোট রাগ-হতাশাগুলো কীভাবে বড় আকারে ফিরে আসে, তা কীভাবে সেই ব্যক্তিকে মারমুখী, হিংস্র মানুষে পরিণত করে। শুধু তা নয়, এমন কিছু সে করে বসে, তা যে সে করতে পারে, এমন ধারণা ছিল না আগে। তবে কী হল সেই মানুষটির? কী ঘটল? এরই উৎসসন্ধান করতে গেলে দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিজীবনের হতাশা পুষে রাখা একটা বড় কারণ। আর এই রাগ ও হতাশা যদি কালেকটিভ হয়? কী হয় তখন? তখন তৈরি হয় মব।
মব যখন একত্রিত হয়ে অন্য মানুষকে স্রেফ মেরে ফেলে, তার পিছনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যেমন অনস্বীকার্য, তেমন নিজের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনও অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও গ্লানিকে স্বীকার করতে, তখন সমবেতভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়, তার দায় রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। ক্ষুব্ধ জনতা রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে ফেলে। সেই বিক্ষুব্ধ জনতার রাগ কোথায় গিয়ে পড়বে, কোথায় সে নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাবে, সেটা জানা থাকে না। এটাকে বলা যেতে পারে ইমোশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট। এটা নিয়ে আমাদের, মনোবিদদের অনেক দিনের কাজ। স্কুল বয়স থেকেই এমন প্রবণতা শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। স্কুলে হয়তো সে কোনওভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, বাড়িতে সে কথা না জানিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে, অসহযোগিতা করছে। মবের ক্ষেত্রেও এই একই মানসিকতা কাজ করে। মব আকর্ষিত করে সেই সব মানুষকেই যারাও এই একই ক্ষোভ ও হতাশায় রয়েছে। ফলে তৈরি হয় একরকমের হৃদ্যতা, যাকে ‘আইডেন্টিফিকেশন’ও বলা হয়।
আমি বারবার রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিবারের একান্ত জায়গার অনুষঙ্গ টেনে আনছি ইচ্ছাকৃতভাবেই। বৃহত্তর ক্ষেত্রটাকে বুঝতে হলে, জানতে হলে, বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের একান্ত জায়গা থেকে সেটা বুঝতে হবে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, যখন বাবা-মায়েরা একটা কথা বলেন, এবং তাদের কাজেকর্মে সে-কথা যখন প্রকাশ পায় না, সোজা ভাষায় বললে কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না, তখন বাবা-মায়ের ওপর একটা ক্ষোভ তৈরি হয়। এবং এই ঘটনা যদি বারবার ঘটতে থাকে, তাহলে সেই ক্ষোভ আক্রোশে পরিণত হয়। সেই একইভাবে সাধারণ মানুষ যখন দিনের পর দিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষার না করা নিয়ে সবর হয়, এবং দেখে যে তা নিয়ে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, তখন ক্ষোভ আকারে বড় হতে থাকে। একটা সময় সে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বলের ওপরে। সে তখন ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে চায়, সে নিজের হাতে নিয়ম তুলে নেয়। তার নিজের অক্ষমতাকে অতিক্রম করে সে তখন রাষ্ট্রের প্রতিরূপ হিসেবে ক্ষমতা জাহির করে, নিয়ম জাহির করে। সে কারণেই তার মনে হয় না সে কোনও অন্যায় করছে। কারণ দেশের বা রাষ্ট্রের নিয়মাবলি তাকে কোনও সাহায্য করেনি। তার উপকারে লাগেনি। তাই সে নিজে কাজে নামে। আর ক্ষমতা সবসময় কোপ মারে দুর্বলেরই ওপর। তাই মব খুঁজে নেয় একা একটা মানুষকে। মবের ক্ষমতা বন্যার মতো তীব্র ও সংক্রামক। সমষ্টির মাদকীয় মুহূর্তে, আর সে মাদকতা সৃষ্টি ও ধ্বংসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সমান রূপে সম্ভাবনাময়।
…………………………………………………………
অপরাধ করে ফেলার পরেও সমষ্টির মনে হয় না যে সে ভুল করেছে। তার সেই চেতনাটাই নেই। সমষ্টি আরও আরও মানুষকে আকৃষ্ট করে সেই অপরাধটা ঘটানোর জন্য। আমার মাথার ওপর যারা আছে, তাদের দেখেছি এভাবেই নীতিহীনতায় থাকতে, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায় নীতির কোনও জায়গা নেই। দেশের থেকে আমরা শিখি, পরিবারের থেকে আমরা শিখি, দেশ আমাদের নৈতিকতা তৈরি করে, আমার ব্যক্তিপরিবার ও সম্প্রদায় আমার নৈতিকতা নির্মাণ করে। আমাদের দেশের মনন থেকে, নৈতিকতা থেকে ভিন্নতা অপসারিত হয়েছে। তাই এই দেশের মানুষও ভিন্নতাকে প্রশ্রয় দিতে শেখেনি, ভিন্নতার যে শিক্ষা, তা ভুলে গেছে।
…………………………………………………………
একটা সমষ্টি মনে করছে অন্য কেউ ভুল করছে, এবং সেই ভুল সংশোধন করার ক্ষমতা তার আসছে কোথা থেকে? কারও গায়ে হাত তোলা যায় না– এই ধারণা তো আমাদের সমাজে নেই। নইলে দিনের পর দিন কীভাবে মেয়েদের গায়ে হাত তোলা ও গায়ে হাত দেওয়া হয় আড়ালে ও প্রকাশ্যে? কারণ সমাজের যে নীতিবোধ তা বহুদিন হল অবলুপ্ত হয়েছে। নয়তো অপরাধ করে ফেলার পরেও সমষ্টির মনে হয় না যে সে ভুল করেছে। তার সেই চেতনাটাই নেই। সমষ্টি আরও আরও মানুষকে আকৃষ্ট করে সেই অপরাধটা ঘটানোর জন্য। আমার মাথার ওপর যারা আছে, তাদের দেখেছি এভাবেই নীতিহীনতায় থাকতে, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায় নীতির কোনও জায়গা নেই। দেশের থেকে আমরা শিখি, পরিবারের থেকে আমরা শিখি, দেশ আমাদের নৈতিকতা তৈরি করে, আমার ব্যক্তিপরিবার ও সম্প্রদায় আমার নৈতিকতা নির্মাণ করে। আমাদের দেশের মনন থেকে, নৈতিকতা থেকে ভিন্নতা অপসারিত হয়েছে। তাই এই দেশের মানুষও ভিন্নতাকে প্রশ্রয় দিতে শেখেনি, ভিন্নতার যে শিক্ষা, তা ভুলে গেছে।
আজকে কলকাতার রাস্তায় ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধে লোকে কথা বলছে। কথা বলছে রাষ্ট্রের হাতে হত্যার ক্ষমতা তুলে না দেওয়ার জন্য। এমনকী সেই সময়েও দেখছি সাধারণ জনতা অন্যকে মেরে ফেলছে। আর.জি. করের জুনিয়র ডাক্তার হোক বা সাবির মল্লিক বা তোফাজ্জল। আমরা জেল বলা ছেড়ে দিয়েছি, বলি সংশোধনাগার। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি প্রতিদিন এই সমাজটাকে সুস্থ মানুষ-বান্ধব করে তোলার। তবুও আমরা সমষ্টির হাতে মারা পড়ছি, সমষ্টির বোধের মৃত্যু ঘটছে। ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের অবিশ্বাসের ফল এই নিদারুণ পরিকল্পিত ক্ষুব্ধ হত্যাগুলি।
মানুষকে প্রতিদিন মনুষ্যত্বের চর্চা চালাতে হবে।
আজ যখন আরজিকরের জন্য গোটা সমাজ উটে দাঁড়িয়েছে, বিচার চাইছে দিনের পর দিন, সেটার পিছনেও তো সমষ্টির হাত রয়েছে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে চৈতন্য দিচ্ছে, একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে জাগ্রত করছে। তারা একই স্বরে কথা বলছে, তারা ন্যায় চাইছে। উল্টোদিকে সবাই মিলে তোফাজ্জেলকে মেরে ফেলে। একটা গণজাগরণের কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলা হচ্ছে। মানুষের জীবন কখনও কোল্যাটারাল হয়?
কথোপকথনের ভিত্তিতে তিতাস রায় বর্মনের লেখা
…………………….. পড়ুন গণশত্রু-র অন্যান্য লেখা ………………………….
শতাব্দী দাশ-এর লেখা: অন্ধ যে গণ মারে আর শুধু মরে
সেবন্তী ঘোষ-এর লেখা: শারীরিক প্রহারই একমাত্র শাস্তি, এটা মাথায় গেঁথে বসলে শান্ত মানুষও খেপে ওঠে
অর্ক ভাদুড়ি-র লেখা: ‘পাশের দেশের ঘটনা’ বলে আমাদের সান্ত্বনা পাওয়ার কিছু নেই
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।