গণহিংসার সহজ শিকার কারা? তারা নির্দিষ্ট স্থান-কালে দুর্বলতর তো বটেই। কিন্তু শুধু কি তাই? গণধোলাইয়ের সুলভতম শিকার পাগল, কারণ জগৎসংসারে সে সকল মাপকাঠিতেই ‘অপর’। অপরায়নের প্রবণতা গণধোলাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘অপর’ হল সে, যার ওপর আমার সব নিষিদ্ধ ও সুপ্ত প্রবৃত্তির ভার চাপিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হই। তাই পাগল বা উসকোখুশকো কাগজকুড়ানি অর্ধপাগল দেখলেই মনে হয়, ‘ব্যাটা নির্ঘাৎ চোর! হাতের সুখ করে নিই।’
এক ডাক্তারের ধর্ষণ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি জনগণের যে জাগরণ দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে, তার উল্টোপিঠে এক গণরাক্ষস বাস করে। তথাকথিত নির্ভয়ার গণধর্ষণে মূল অভিযুক্ত বাস ড্রাইভার রাম সিং ও তার বাহিনীর সঙ্গে নির্ভয়ার প্রেমিকের প্রাথমিক কথোপকথনের বর্ণনা পড়েছিলাম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ (১১ মে, ২০১৩)। ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এত রাতে যুবতী মেয়ে নিয়ে বেরিয়েছিস কেন?’ ছেলেটি অবাক হয়, মেয়েটিও। তারা বলে, ‘আপনাদের তাতে কী?’ অতঃপর, আক্রান্ত হয় ছেলেটি। তাকে নগ্ন করে পেটানো হয়। মেয়েটিকে ব্যাকসিটে টেনে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। যারা করে, তারাও সমষ্টি। আবার, ভিনরাজ্যে যারা গোমাংসাশী সন্দেহে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিক সাবিরকে পিটিয়ে মারে, তারাও সমষ্টি। সমষ্টির সদর্থক ভূমিকা উদযাপনের কালে যেন আমরা সমষ্টির এই কদর্য মুখও না ভুলি।
বলা বাহুল্য, নির্ভয়ার আততায়ীরা কথা শুরু করেছিল তার প্রেমিকের সঙ্গে, নারীর সঙ্গে নয়। ‘ম্যান টু ম্যান টক।’ পুরুষমানুষের যাতায়াত অবাধ দিনে রাতে। কিন্তু রাতে পুরুষমানুষ মেয়ে-সঙ্গী নিয়ে বেরলে অন্য পুরুষের চোখ টাটায়। নারীহীন পুরুষগণ তখন ‘হ্যাভ নটস’। ‘হ্যাভস’-দের প্রতি তার ঈর্ষাই স্বাভাবিক যেন! এ ভাবনা ‘জায়েজ’ হয়ে যায়, কারণ নারীকে ভাবা হয় ভোগ্য সামগ্রী– কারও আছে, কারও নেই। সমষ্টি এভাবেই ভাবে। আবার, জনমানসে রাতে পুরুষমানুষের সঙ্গে আমোদ করতে বেরনো নারী এমনই নষ্টা যে, তাকে হতেই হবে বহুভোগ্যা। তাই, মেয়ের কাছে ‘ভিড়’ মানে সবসময় সহমানুষের সমাহার নয়। বরং মুখহীন লোলুপ হাতের সারি। মেয়ে ভিড় ভয় পায়। অন্যদিকে, ইন্টারনেটে মেয়েদের প্রতি ‘বুলিং’-এর সংস্কৃতি নিয়ে নানা সমীক্ষা হয়েছে। যখন হাতের সুখ করা যায় না প্রহার করে, কিংবা ধর্ষণের মাধ্যমে যৌনপ্রহার করা যায় না, তখন ভরসা এই সমষ্টিগত বাচিক হিংসাত্মক আক্রমণ।
সাধারণভাবে, গণহিংসার সহজ শিকার কারা? তারা নির্দিষ্ট স্থান-কালে দুর্বলতর তো বটেই। কিন্তু শুধু কি তাই? গণধোলাইয়ের সুলভতম শিকার পাগল, কারণ জগৎসংসারে সে সকল মাপকাঠিতেই ‘অপর’। অপরায়নের প্রবণতা গণধোলাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘অপর’ হল সে, যার উপর আমার সব নিষিদ্ধ ও সুপ্ত প্রবৃত্তির ভার চাপিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হই। তাই পাগল বা উসকোখুশকো কাগজকুড়ানি অর্ধপাগল দেখলেই মনে হয়, ‘ব্যাটা নির্ঘাৎ চোর! হাতের সুখ করে নিই।’ হরিয়ানার জনগণও ভেবেছিল, সাবির ঠিক তাদের মতো নয়। ওর সুন্নত হয়েছে। হয়তো লুঙ্গি পরে। হয়তো অন্য খাদ্যাভ্যাস। অতএব তাদের অবচেতনের যা কিছু অপরাধেচ্ছা, সব সাবিরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে তাদের। তাকে মূর্তিমান অনর্থ মনে হয়। মনে হয়, তাকে নিকেশ করলেই সমাজের পাপস্খালন হবে।
আবার, সেই প্রক্রিয়ায় জনমানুষের অন্তরে নিরন্তর বহমান ক্ষোভের লাভা, ঘৃণার তরঙ্গ, তা বাঁধ ভেঙে বেরয়। অথচ তার ক্ষোভ হয়তো বদরাগী বস কিংবা মূল্যবৃদ্ধির ওপর। যা যা কিছুর ওপর তার রাগ হওয়া ন্যায্য ছিল, তাদের পেড়ে ফেলা সহজ নয়। সাবিরকে পেড়ে ফেলা যায়, মেরে ফেলা যায়। সে সংখ্যালঘু, অতএব ‘অপর’। তায় আবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।
ভিড় যাকে ‘অপর’ ভাবে, সে যে সবসময় ‘ধোওয়া তুলসীপাতা’, তাও নয়। যেমন, ধরা পড়লে ধর্ষক জনগণের চোখে ‘অপর’। তখন তার ফাঁসি চাই, কিংবা চাই জনতার হাতে তার নির্মমতর মৃত্যু। কিন্তু ধরা না পড়লে? তখন সে ভিড়ের একজন। অতএব, বালিকার শরীর হাতড়ানো অসংখ্য হাতের মধ্যে একটি হাত তারও।
গণহিংসার মনস্তত্ত্বের সঙ্গে নির্যাতিতর ‘অপরায়ন’ যদি অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত বলে ধরে নিই, তাহলে সিমোন দ্য বোভোয়া-কে এরপর মনে করিয়ে দেওয়া যায়। পশ্চিমা নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের আকরগ্রন্থ ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’-এ তিনি বলেছিলেন, পুরুষ হল সত্তা, নারী অপর। নারী (এবং তৃতীয় তরঙ্গ মতে প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার যে কোনও মানুষ) প্রাথমিক ভাবে ‘অ-পুরুষ: যারা পুরুষ নয়।’ তাদের দোষ-গুণ-সংজ্ঞা-বৈশিষ্ট্য সবই নির্ধারিত হয় ‘পুরুষ’ নামক মাপকাঠিতে। লিঙ্গগত ভাবে তারা যদি জন্মসূত্রেই ‘অপর’ হয়, তাহলে তারা তো গণ-আক্রোশের শিকার হবেই! সেই সঙ্গে যদি তারা ধর্মীয় বা বর্ণগত ভাবেও প্রান্তিক হয়, তবে হিংসার মাত্রা বাড়ে।
সমষ্টিগত গণ-হিংসা পুরুষের ক্ষেত্রে গণধোলাইয়ের চেহারা নেয়। কিন্তু তথাকথিত ‘পুরুষেতর’-র ক্ষেত্রে? সেক্ষেত্রে গণপ্রহারের আগে গণধর্ষণের এক পর্ব থাকে। তা না হলে, অন্তত নগ্ন করে ঘোরানো। অর্থাৎ নারীকে যখন গণশত্রু ঠাওরাচ্ছে জনতা, তখনও তার শরীরটিকে যৌনবস্তু ভাবতে ভুলছে না। নির্ভয়া বা অভয়া হিসেবে পুনর্নামাঙ্কিত যারা, তাদের নির্যাতনের চেয়ে অনেক কম চর্চিত হয়েছে খয়রলাঞ্জির ঘটনা। ২০০৬ সালে সেখানে প্রিয়াঙ্কা ভোটমাঙ্গে নামের এক দলিত তরুণীকে নগ্ন করে ঘুরিয়ে, গণধর্ষণ করে, হত্যা করা হয়েছিল।
দলিত কবি সুকীর্থারানি বলেছিলেন, সেই মেয়েটির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করেছিলেন। মেয়েটির পরিবারের সদস্যদেরও খুন করা হয়। বর্ণহিন্দু জনতা প্রাণভরে ক্ষোভের উদগীরণ ঘটিয়েছিল দুর্বল দলিতের ওপর। মেয়েদের ক্ষেত্রে গণধর্ষণ ছিল উপরি পাওনা। আমরা নিশ্চয় বিলকিস বানোকেও ভুলিনি। সেই বিলকিস বানো, যে ২০ বছর লড়াই করে ন্যায় ছিনিয়ে এনেছিল আদালতে। সেই বিলকিস বানো, যার ধর্ষকদের ‘আজাদির অমৃত মহোৎসব’ উপলক্ষে ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৭ বছরের বিলকিস বানো, গর্ভবতী বিলকিস বানো গণধর্ষিত হয়েছিল ২০০২ সালে, গুজরাত দাঙ্গার কালে। যেহেতু সে নারী, তাই গণপ্রহার ছাড়াও তার প্রাপ্য ধর্ষণ!
আবার এই তো গত মে মাসে, মণিপুরে তিনজন কুকি নারীকে নগ্ন করে ঘোরানো হল। কারণ? মৈতেই-কুকি জাতিদাঙ্গা। মৈতেইদের সমবেত কুকি-ঘৃণা প্রকাশের সহজ লক্ষ্য, আবারও নারী। আটশো থেকে হাজার লোকের সেই মৈতেই বাহিনীর হাত থেকে কুকি নারীদের বাঁচানোর বদলে, জনগণের হাতেই তাদের সঁপে দিয়েছিল পুলিশ স্বয়ং। সেই সমষ্টির মধ্যে কিন্তু মৈতেই নারীরাও ছিল! নির্যাতিত কুকি মেয়েদের মধ্যে অন্তত একজন নগ্ন মিছিল শেষে গণধর্ষিতও হয়। প্রশ্ন জাগে, মৈতেই নারীরা কীভাবে তা হতে দিল? তারা কি সমষ্টির অংশ হওয়ার পর নারীচেতনা হারিয়েছিল?
প্রাচীন ইউরোপে সীমানা-লঙ্ঘনকারী মেয়েরা ‘ডাইনি’ হিসেবে চিহ্নিত হত। তারপর জ্যান্ত পোড়ানো হত তাদের। ফ্রান্সের জোয়ান অফ আর্ক তো ছিলেন খ্রিস্ট-ভজা সাধ্বী! কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে তিনি অকুতোভয় সেনানেত্রী। এ-ও মধ্যযুগের নারীর পক্ষে সীমানালঙ্ঘন। অতএব, খুঁটিতে বেঁধে জ্বালিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের ডাকিনীরা প্রচলিত রাজতন্ত্রের সমান্তরালে এক অপর জগতে বাস করে। স্থিতাবস্থাকে ওলট-পালট করতে চায় কেন তারা, তা জানা যায় না। কিন্তু এটুকু বোঝা যায় যে, এমনটা চায় বলেই তারা ডাকিনী। আমাদের দেশে লোককাহিনিতে যে ডাইনিদের কথা শুনি, তাদের কুদৃষ্টি পড়লে নধর শিশু বেঁকেচুরে মরে যায়। প্রশ্ন হল, ধনুষ্টংকারে শিশুমৃত্যুর দায় যার ওপর পড়ল, তার ওপরেই কেন পড়ল কুসংস্কারের কোপ? সে কি একাকিনী নারী? অবিবাহিতা? সে কি উচ্চাভিলাষী? সে কি অলক্ষ্মী? সে কি কারও ‘অবৈধ’ প্রেমিকা? কীভাবে সে ডিঙিয়েছে লক্ষণরেখা? লোদগি কিস্কো এবং ডলি সোরেন ছিলেন ময়ূরেশ্বর থানার হরিসরা গ্রামের আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁদের বাড়ি থেকে টেনে বের করা হয় ডাইনি সন্দেহে। খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারধর শেষে, মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সেচনালার জলে।
………………………………………………….
আরও পড়ুন সেবন্তী ঘোষ-র লেখা: শারীরিক প্রহারই একমাত্র শাস্তি, এটা মাথায় গেঁথে বসলে শান্ত মানুষও খেপে ওঠে
………………………………………………….
আর. জি. করের মৃতাকে ঘিরে গণরোষ হয়তো আজ বড় ন্যায্য আর পবিত্র লাগছে। সীমাহীন গণরোষ ঘিরে রোম্যান্টিসিজমও আমাদের স্বীকৃত রাজনৈতিক ভাষ্যে বর্তমান। কিন্তু রোষকে সঠিক পথে চালিত না করলে তা যে কোনও মুহূর্তে ‘অপর’ ঠাওরাতে পারে যে কোনও কাউকে। হয়তো প্রতিবাদীকেই! প্রতিবাদীকে গণশত্রু ঠাওরানোর কথা আমরা পড়িনি কি ইবসেনের ‘এনিমি অফ দ্য পিপল’-এ? দেখিনি কি সোভিয়েত পার্জের সময় ন্যায্য প্রতিবাদীদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিতকরণ? আমাদের তাই থাকতে হয় সংযত ও প্রস্তুত। অন্ধ গণরোষকে আলো দেখানোর দায়ভার আমাদের ওপরেই বর্তায়।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..