Robbar

জাতীয় স্বার্থরক্ষায় অনুদান বন্ধ আমেরিকার, অতল অন্ধকারে আজকের আফ্রিকা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 4, 2025 5:02 pm
  • Updated:March 4, 2025 5:05 pm  

দু’জন মানুষ– একজন রাষ্ট্রের প্রধান, আর বিজনেস টাইকুন– যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত নন, তাঁদের সিদ্ধান্তে গত দু’-তিন সপ্তাহে এত মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে, এত সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, হিসাব রাখা যাচ্ছে না। প্রত্যেক দিন সকালে উঠে এক নতুন আশঙ্কায় থাকি। আজ কী হবে? সঙ্গে হাজার হাজার মাইল দূরে নিজের পৃথিবীতে বসে, আফ্রিকার এত মানুষের ক্ষতির পরিমাণ কতটা, তা সংখ্যা দেখে, খবর পড়ে, সেখানে থাকা রিপোর্টারদের দেওয়া ইন্টারভিউ পড়ে শুধু আঁচ করতে পারি। খানিকটা। এর চেয়ে বেশি ধৃষ্টতা করা যায় না। তার মধ্যে কিছু খবর আসে তা যেন একটা অসহায় অভিঘাত রেখে যায়।

গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান। ওমদুরমান শহরে বসবাসকারী ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হামাত তাঁর পরিবারের খাবার নিয়ে আসেন রাস্তার মোড়ে খাবার বিতরণের জায়গা থেকে। চাকরি তো দূরের কথা, পরিবারের মুখে খাবারও জোগাতে পারেন না তিনি। যুদ্ধে সুদানের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। হামাতের কথায়, পরের বেলা খাবার কোথা থেকে আসবে সেটা ঈশ্বর, আর বাইরে থেকে আসা অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সত্যিই তা শুধু ঈশ্বরের ওপরই নির্ভরশীল, কারণ দুই মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে আর ৮০ শতাংশ খাদ্য বণ্টনকারী সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ এগুলো প্রধানত চলে ‘ইউএসএইড’ (USAID)-এর অর্থে। ‘ইউএসএইড’ সেই সংস্থা, আমেরিকার হয়ে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হিউম্যানেটেরিয়ান কাজ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ফেডারেল গভর্নমেন্টকে ছোট করার অভিপ্রায়ে শুরু হয় সরকারি কর্মচারী ছাঁটাই, প্রথম ছাঁটাই নেমে আসে,ইউএসএইডের ওপর– সংস্থার বেশিরভাগ কর্মীকে ইস্তফাপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বে আমেরিকার অনুদান রাতারাতি সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়, তিন মাসের জন্য। তারপর বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ওমদুরমান তো সুদানের শুধু একটি শহর, সমস্ত দেশে প্রায় ১১০০টি খাদ্য বণ্টন সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে চালানো কমিউনিটি সংস্থার নেটওয়ার্ক, যারা যুদ্ধ বিধ্বস্ত সুদানে এই সুপ কিচেনগুলো চালান, যা কি না দুই মিলিয়ন মানুষের প্রত্যেক দিন খাবারের সংস্থান, আমেরিকা সরকারের আকস্মিক অনুদান বন্ধের সিদ্ধান্তে বর্তমানে গভীর সংকটের মুখে। এছাড়া আছে হাসপাতাল। ওমদুরমান শহরের একটি হাসপাতাল যেখানে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা হয়, এমনিতেই প্রচুর রোগীর ভিড় সেখানে। এখন হাসপাতালটিতে রোগীদের দিনে একবার খাবারের সংস্থান আছে, জীবনদায়ী ওষুধ এমনকী, ব্যথা নিরোধক ওষুধের পরিমাণ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার জামাল মহম্মদের কথায় তিনি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।

What Is USAID? Why Trump, Musk are pushing to shut down the U.S. foreign aid agency

সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের এইডস অধ্যুষিত অঞ্চলে মহিলাদের জন্য বিশেষ ক্লিনিকগুলোর দরজা রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেছে। যে-মহিলারা এখানে নিয়মিত আসেন তাঁরা বুঝতেই পারছেন না কী হল, যে ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল, তার আর কোনও উপায় নেই। সে দরজা কি খুলবে? সম্প্রতি ইউএসএইড-এর আগের বাজেটের দশ শতাংশ চালু থাকবে বলে ঘোষণা করেছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। তার আওতায় আসবে কি এই ক্লিনিকগুলো? জানা নেই।

খাদ্য, স্বাস্থ্য– এই দু’টি মূল ক্ষেত্র দাঁড়িয়েছে প্রবল আশঙ্কার সামনে কিন্তু সেটাই সব নয়। ‘পাওয়ার আফ্রিকা’। প্রায় দশ বছর আগে ওবামা সরকারের সময়ে হওয়া আফ্রিকার অতিরিক্ত ৩০ গিগাওয়াট বৈদ্যুতিকরণ– যার মাধ্যমে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছয়, যাদের কাছে অন্য কোনও ভাবে বিদ্যুৎ পৌঁছয় না। ট্রাম্প ইউএসএইডের বিপুল বাজেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার আফ্রিকার প্রায় সমস্ত কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। সাব-সাহারান আফ্রিকান যে বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছচ্ছিল বন্ধ হয়ে গেছে রাতারাতি। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া এই বিপুল সংখ্যার মানুষ রোজকার জীবন, চাকরি, ব্যবসা, স্কুল, যোগাযোগ কীভাবে চালাবে, তা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

South Sudan closes all schools as heatwave soars

তিনমাস সময় লাগেনি সরকারের, ২৭ ফেব্রুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্ট পাকাপাকিভাবে ঘোষণা করেছে ৯০ শতাংশ ইউএসএইড-এর সমস্ত চুক্তি মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাইতির কোনও ছোট হাসপাতাল হোক অথবা কেপ টাউনের বিশাল এইচআইভি প্রজেক্ট– সব কিছু প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ডক্টর কেট রিস, কেপটাউনের সবথেকে বড় এনজিওর পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট জানিয়েছেন, তাঁরা ভাবছিলেন তাঁদের অর্থ সাহায্য কমবে, কিন্তু সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তা তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। তিনি বলেন, তাঁদেরকে প্রায় পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার চুক্তিপত্র বাতিল হয়েছে, এই মর্মে এনজিওগুলোর কাছে বার্তা গেছে যে, তাদেরকে দেওয়া অর্থ অনুদান আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না কারণ আমেরিকার জাতীয় স্বার্থরক্ষা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সোমালিয়ার একটি হেলথ ক্লিনিক যা ১৩টি কমিউনিটিতে কাজ করত আর প্রত্যেক দিন প্রায় ১,৭০০ বাচ্চার ম্যালনিউট্রিশনের থেরাটিউপিক চিকিৎসা করত, ২৭ ফেব্রুয়ারি তাদের দরজা বন্ধ করে দিল। আর এই একই দিনে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএসএইড কর্মচারীদের মাত্র ১৫ মিনিট করে সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের অফিস বিল্ডিং থেকে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তাদের কাজ ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে গেছে!

…………………

সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার চুক্তিপত্র বাতিল হয়েছে, এই মর্মে এনজিওগুলোর কাছে বার্তা গেছে যে, তাদেরকে দেওয়া অর্থ অনুদান আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না কারণ আমেরিকার জাতীয় স্বার্থরক্ষা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সোমালিয়ার একটি হেলথ ক্লিনিক যা ১৩টি কমিউনিটিতে কাজ করত আর প্রত্যেক দিন প্রায় সতেরোশো বাচ্চার ম্যালনিউট্রিশনের থেরাটিউপিক চিকিৎসা করত, ২৭ ফেব্রুয়ারি তাদের দরজা বন্ধ করে দিল। আর এই একই দিনে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএসএইড কর্মচারীদের মাত্র ১৫ মিনিট করে সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের অফিস বিল্ডিং থেকে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তাদের কাজ ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে গেছে।

…………………

দু’জন মানুষ– একজন রাষ্ট্রের প্রধান, আর একজন বিজনেস টাইকুন– যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত নন, তাঁদের সিদ্ধান্তে গত দু’-তিন সপ্তাহে এত মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে, এত সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, হিসাব রাখা যাচ্ছে না। প্রত্যেক দিন সকালে উঠে এক নতুন আশঙ্কায় থাকি। আজ কী হবে? সঙ্গে হাজার হাজার মাইল দূরে নিজের পৃথিবীতে বসে, আফ্রিকার এত মানুষের ক্ষতির পরিমাণ কতটা, তা সংখ্যা দেখে, খবর পড়ে, সেখানে থাকা রিপোর্টারদের দেওয়া ইন্টারভিউ পড়ে শুধু আঁচ করতে পারি। খানিকটা। এর চেয়ে বেশি ধৃষ্টতা করা যায় না। তার মধ্যে কিছু খবর আসে তা যেন একটা অসহায় অভিঘাত রেখে যায়।

USAID religious adviser appointee made harsh anti-Islam comments and warned of violence if Tea Party failed in 2010 elections | CNN Politics

মাদাই আলম-ইথিওপিয়া নিবাসী এই অ্যাক্টিভিস্ট কাউন্সেলরের ইন্টারভিউতে শুনছিলাম তাঁরা কাজ করেন অন্য দেশের যুদ্ধ জেনোসাইড থেকে আহত, যৌন নিগ্রহের শিকার মানুষদের সঙ্গে, বাচ্চাদের সঙ্গেও, যারা পালিয়ে আসে ইথিওপিয়ায়। যাদের পক্ষে নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। বছরে প্রায় ১১ হাজার মানুষকে চিকিৎসা আর কাউন্সেলিং দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করে তাদের সংগঠন। যুদ্ধ বা জেনোসাইডের সময় হওয়া যৌননিগ্রহ শরীরের সঙ্গে মনকেও পঙ্গু করে দেয়। অনেক ধৈর্য আর সহমর্মিতার সঙ্গে জীবনে ফেরাতে হয়। অনেক সময় দিতে হয়। ‘আমাদের কাউন্সিলররা তাদের এত কষ্ট করে অর্জিত, এত চেষ্টা করে জীবনে ফিরতে চাওয়া ক্লায়েন্টদের হারিয়ে ফেললেন এক দিনের মধ্যে, তাদের বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারলেন না।’ এ শুনতে শুনতে ভেতরটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল… সুদূর আদ্দিস আবাবা থেকে  যিনি বলছেন, যারা শুনছি তারা জানি ওই ক্লিনিকগুলোর দরজা আর খুলবে না।

…………………………………………

আরও পড়ুন শুভশ্রী নন্দী-র লেখা: উদার অভিবাসী নীতি থেকে সরে আমেরিকার ‘ইউ টার্ন’ কেন?

…………………………………………

এ কোথায় চলেছি আমরা?

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ইউএসএইড-এর বাজেট আমেরিকার সম্পূর্ণ বাজেটের মাত্র এক শতাংশ।

…………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………..