দুর্ঘটনা-সাহিত্য’র সেই স্বর্ণযুগ আজ চলে যেতে বসেছে! তার বদলি হিসেবে অবশ্যি এসেছে অ্যানালিটিক্স ও থিওরিক্সের অ্যাডভেঞ্চারের গালগল্প! বিমান দুর্ঘটনার পর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, মন ভরে গেছে! আমার চারিপাশে এত টম ক্রুজ! আমি তো খবরটা ওই সমস্ত বিশারদের কলম থেকেই জানলাম! প্লেনের প্রপেলার কতটা প্রো, প্লেনের চাকা ফিরে এসেছিল কি না, বোয়িং প্লেনের ডিমে কত ওমে তা দিলে চাটার্ড প্লেন ফুটে বেরয়, ব্ল্যাকবক্স কোন রঙের হয়, ইত্যাদি-প্রভৃতি সব জানে! সওওওওব! প্লেনে উঠলে পাইলট বলে, ‘দাদা আপনিই চালান!’
১৯৯৯ সালে, মানে ওলেবাবালে নাইন্টিজের শেষবেলায় ‘আনন্দের শহর’ কলকাতায় এক নামজাদা পুজো কমিটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাকে দুর্গাপুজোর ‘থিম’ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমাদের পাশের পাড়ায় কালীপুজোয় এক নিদারুণ আকর্ষণ হয়ে উঠল ওড়িশার মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড়! সে একেবারে দারুণ হুলাবিলা ব্যাপার! মণ্ডপের একপাশে ত্রিপল ঢাকা সেট পড়েছিল। সন্ধ্যার পর থেকে আধ ঘণ্টার গ্যাপে, সেখানে ঝড়ের ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ অনুষ্ঠিত হত। দামড়া দামড়া চারটে স্ট্যান্ড-ফ্যান লড়িয়ে দেওয়া হাওয়ার হাহাকারে মিশে যেত আর্তদের চিৎকারের অভিনয়। পাড়ার কিছু অত্যুৎসাহী বাচ্চাকেও দেওয়া হয়েছিল অভিনয়ের সুযোগ। তারা বাকি ‘পোড় খাওয়া’ অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাশ সাজত! তবে এই তানানার মূল আকর্ষণ ছিল শোলার তৈরি, হেডলাইট জ্বলা একটা হেলিকপ্টার! ত্রাণ নিয়ে দড়ি ধরে চলে যেত এ মাথা থেকে ও মাথা! জনপ্রিয়তার চাপে এই পালা ভাইফোঁটার পরদিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হয়!
সুধী পাঠক, আপনি হয়তো ভাবছেন হুট করে কেন এত ‘সুখস্মৃতি’ আওড়াচ্ছি, তাই না? সহ্য করতে না পেরে বলছি! রাগ থেকে বলছি! হতাশা থেকে বলছি! কিছু মানুষ আজ এনে দাঁড় করিয়েছে এই জায়গায়!
সেই সমস্ত মানুষ, যাদের কিছুই ভালো লাগে না! সবটাতে একটা নাক সিঁটকোনো ব্যাপার! ওরা দেখবেন গলাটলা ভারী করে এমন ধরনের কথা বলে যে, “মানবসভ্যতা কথাটা থেকে ‘সভ্যতা’ শব্দটা তুলে দিলে দু’পক্ষেরই সুবিধা হয়। একদিকে মানবজাতিকে অসভ্য, নোংরা মন্তব্য করার পর গুর্মে-পুরস্কার হাতে নিজেকে জাস্টিফাই ধকল সইতে হয় না। অন্যদিকে সভ্যতা ব্যাপারটাকেও দিনের পর দিন মাথা খুঁড়ে বইতে হয় না ‘মানব’ বিষয়টার ভার…।’ এগুলো যারা বলে তারা একেবারে ফালতু মাল! হাড়-বজ্জাত, বদস্য বদ যাকে বলে! এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত বা আঁতেল বেরিয়ে গেলেও অবাক হওয়ার বিশেষ কিছু দেখি না! যেমন এই শুরুতেই যে দুটো উদাহরণ দিলাম তেমন আশ্চর্য জিনিস আজকাল আর চোখে পড়ে? আমার তো পড়ে না। এই এদের মতো অসভ্যগুলোর টিপ্পনির জন্যেই পড়ে না! শেষ বোধহয় দেখেছিলাম সুনামির সময়, পাড়ার ছেলেরা সরস্বতী পুজোর থিম করেছিল!
আহা রে, কী দিন ছিল সে সব! লোকে দেখে এসে তারিফ করে বলত– ‘মাটি নারে, মোম দিয়ে বানানো! তাই তো রিয়াল বডির মতো লাগছে’। সেই শিল্পও নেই, সেই সমঝদারও নেই! সোশাল মিডিয়া আসার পর তবুও মানরক্ষা হয়েছিল কিছুটা। কোনও একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলেই একেবারে সাহিত্যের সমারোহ বসে যেত। কবিতা, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, কাব্যগদ্য, স্মৃতিচারণা আহা! মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ফলে এই সমস্ত সাহিত্যিকরা যে কষ্টটা পেয়েছিল, সেটা পরিষ্কার দেখা যেত লেখায়! সঙ্গে সঙ্গে মাথা খাটিয়ে, নিজের বুক ফেটে যাওয়া কষ্ট জাহির করে, ১০০০ শব্দ লিখে ফেলার কষ্ট কি কম? সেই কষ্ট সওয়ার মুরোদ না থাকলে পুনম পাণ্ডের চোখে বিষাদ দেখা যায় না!
এ ধরনের জিনিসও আজকাল কমে আসছে আস্তে আস্তে! কারণও ওই এক আঁতেল গোষ্ঠী! কীসব ট্যাঁরা ট্যাঁরা কথা বাবা! বলে, ‘দুর্ঘটনাকে কন্টেন্ট করে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করে যারা তাদের আমি ঘেন্না করি’। নেকু! তো ঘেন্না করবি তো কর! নিভৃতে কর! তোকে আবার ফলাও করে সেটা বলতে হবে কেন রে? এদের সঙ্গে তর্ক করতে যান, এত অসভ্য, এত অসভ্য যে, মুখের ওপর যুক্তি ছুড়ে মারবে! জিজ্ঞাসা করে দেখুন গত কালকের বিমান দুর্ঘটনার পরে আমাদের কী করা উচিত ছিল? বলবে, ‘শুধুমাত্র হেল্পলাইন নম্বরগুলো শেয়ার করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার দরকার নেই।’ এটা কোনও কথা হল! এই ধরনের দুর্ঘটনার পর একটা মানুষ চাট্টি ছড়া পর্যন্ত লিখতে পারবে না নিজের কষ্টটা জাহির করার জন্য! লজিকের বাচ্চা কোথাকার! মাথা গরম হয়ে গেল এসব লিখতে লিখতে! একটা গল্প না বললে শান্ত হবে না।
…………………………….
আহা রে, কী দিন ছিল সে সব! কোনও একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলেই একেবারে সাহিত্যের সমারোহ বসে যেত। কবিতা, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, কাব্যগদ্য, স্মৃতিচারণা আহা! মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ফলে এই সমস্ত সাহিত্যিকরা যে কষ্টটা পেয়েছিল, সেটা পরিষ্কার দেখা যেত লেখায়! সঙ্গে সঙ্গে মাথা খাটিয়ে, নিজের বুক ফেটে যাওয়া কষ্ট জাহির করে, ১০০০ শব্দ লিখে ফেলার কষ্ট কি কম? সেই কষ্ট সওয়ার মুরোদ না থাকলে পুনম পাণ্ডের চোখে বিষাদ দেখা যায় না!
…………………………….
অ্যান্থনি জেসলনিক বলে একজন বেয়াড়া মার্কিন স্ট্যান্ডআপ কমিক আছেন। মূলত অফেন্সিভ আর ডার্ক-জোক বলার জন্যে নাম কিনেছেন ভদ্রলোক। তো মার্কিন দেশের জনদরদি বন্দুক আইনের জন্য যা হয় আর কী, একবার এক উন্মাদ বন্দুকবাজ, একটা সিনেমাহলে ঢুকে পড়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দেয় সাধারণ মানুষের ওপর। দুর্ঘটনার ভয়বহতা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এহেন ঘটনার পর জেসলনিক যে টুইটটা করেছিল সেটা বাংলা করলে কতকটা এমন দাঁড়ায়, ‘সব বুঝলাম কিন্তু সিনেমাটা কেমন ছিল?’
যথারীতি নিন্দার ঝড় ওঠে। জেসলনিক তাঁর নেটফ্লিক্স কমেডি ‘স্পেশাল থটস অ্যান্ড প্রেয়ার্স’-এ সেটার উত্তরও দেন। বলেন, এই যে কোথাও একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই আপনারা সকলে আবেগে, দুঃখে, উদ্বেল হয়ে ওঠেন, সমবেদনা জানান, ‘থটস অ্যান্ড প্রেয়ার্স’ বলে এই সবকিছুর পিছনে কারণ একটাই, জাহির করা। জানি খুব কষ্টের একটা ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু প্লিজ আপনার ভুলে যাবেন না আমিও খুব কষ্টে আছি এই যে দেখুন আমার কষ্ট! দিন আমায় অ্যাটেনশন’। যারা দুর্ঘটনার সরাসরি শিকার বা যাদের কাছের মানুষজন আক্রান্ত, তারা তো নিশ্চয়ই সোশাল মিডিয়ায় এসে লাইক তোলার অবস্থায় নেই, তাই জেসেলনিকের মতে– এই সময় একটা জোক যদি একটা মানুষকেও হাসাতে পারে, তাহলে সেটাও অনেক। দুর্ঘটনা দু’জনের কাছেই কনটেন্ট, খালি একজন বুক বাজিয়ে সেটা বলছে, আরেকজন বলছে না!
আপনি এখন যে লেখাটা পড়ছেন। সেটাও তাই। কন্টেন্ট।
এই সবকিছু মিলিয়েই ‘দুর্ঘটনা-সাহিত্য’র সেই স্বর্ণযুগ আজ চলে যেতে বসেছে! তার বদলি হিসেবে অবশ্যি এসেছে অ্যানালিটিক্স ও থিওরিক্সের অ্যাডভেঞ্চারের গালগল্প! কাল বিমান দুর্ঘটনার পর হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, মন ভরে গেছে! আমার চারিপাশে এত টম ক্রুজ!
আমি তো খবরটা ওই সমস্ত বিশারদের কলম থেকেই জানলাম! প্লেনের প্রপেলার কতটা প্রো, প্লেনের চাকা ফিরে এসেছিল কি না, বোয়িং প্লেনের ডিমে কত ওমে তা দিলে চাটার্ড প্লেন ফুটে বেরয়, ব্ল্যাকবক্স কোন রঙের হয়, ইত্যাদি-প্রভৃতি সব জানে! সওওওওব! প্লেনে উঠলে পাইলট বলে, ‘দাদা আপনিই চালান!’ বললাম না, মন ভরে গেছে! তবে ওই আঁতেলগুলো জ্বালায় এই ভালো সময়টাও বেশিদিন সইলে হয় কপালে! মালগুলো শিওর এতক্ষণে এসবের বিরোধিতা করছে! ছিঃ, ছিঃ! একটা মানুষ দুর্ঘটনার ছবি শেয়ার করেছে কয়েকটা রিয়্যাক্ট পাওয়ার আশায়, মাথা খাটিয়ে ক্যাপশন করেছে যে, ‘এই দিন যেন আমরা না ভুলি’, আর তুই হতভাগা, সেটা ক্রিটিসাইজ করছিস? ‘অমানুষ’ বলে গালাগাল করছিস! ওরে কোনও ধর্মেই যে সইবে না রে!
জানি না বাবা! সমাজ যে পথে এগচ্ছে এরপর তো এইসব সেন্সেবল মাস্তানদের ভয়ে মানুষ কোনও একটা দুর্ঘটনার পর শুধু হেল্পলাইন নম্বরই শেয়ার করবে…। উফ্, ভেবেই শিউরে উঠছি! তাই সেই দিন আসার আগে এই লেখা, থুড়ি কন্টেন্টটাকে, লাইক করুন, শেয়ার করুন, ফলো করুন! আর মনে রাখবেন– আমার সমবেদনা আপনার শিরোধার্য!
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….