কোনও মানুষকে জন্মের আগেই গবেষণার বিষয় করে তোলা কি ঠিক? অনেকেই এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। প্রকৃতিকে এড়িয়ে মানবদেহে জিনগত পরিবর্তনের চেষ্টা বিবর্তনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিবহুল হতে পারে অবশ্যই। মানুষের ভ্রূণের জিন যখন বদলে দেওয়া হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে, তখন কিন্তু শুধু একজন ব্যক্তির জিন বদল হচ্ছে না। বদলে যাচ্ছে একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিনও। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে তৈরি হবে ‘ডিজাইনার বেবি’ বা ‘পছন্দসই শিশু’। এই প্রবণতাকে চলতি কথায় ‘ইউজেনিক্স’ বলা হয়। যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকবে, তারা তৈরি করবে ‘উন্নততর’ শিশু। তৈরি হতে পারে জিনগত বৈষম্য এবং সামাজিক বিভেদও।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
যুগ যুগ ধরে খোদার ওপর খোদকারির চেষ্টা হয়েছে। এখনও হয়ে চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাতে লাভ কি কিছু হয়েছে? নাকি সবটাই ‘খরচের খাতা’য়? একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে প্রকৃতি তথা মানব সভ্যতাকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা বা উদ্দেশ্যের নেপথ্যে আসল লক্ষ্যটা কী? নিছকই বাণিজ্যিক মুনাফা নাকি সত্যিই সভ্যতার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখা।
বিজ্ঞানের নিরন্তর চর্চা, নিত্য-নতুন আবিষ্কার সভ্যতার ভোল আমূল বদলে দিয়েছে। তার ভালো-মন্দ নিয়ে বিস্তর বিতর্কও রয়েছে। কিন্তু ভুল পথে খাল কাটলে জলের সঙ্গে কুমীরও যে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে, সে কথাও মাথায় রাখতে হবে। সবসময় ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকলে চলে না। লক্ষ্য স্পষ্ট করে, অভিমুখ নিশ্চিত করে বৃহত্তর মানব কল্যাণের কথা না জানালে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। যেমনটা উঠেছে মার্কিন স্টার্ট আপ সংস্থা হেলিওস্পেক্ট জিনোমিক্স-এর পদক্ষেপ নিয়ে।
কী করেছে হেলিওস্পেক্ট জিনোমিক্স? গোপন তদন্তের ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী, ‘হেলিওস্পেক্ট জিনোমিক্স’ আইভিএফ-এর আওতায় থাকা এক ডজনেরও বেশি দম্পতির সঙ্গে একটি প্রকল্পে কাজ করেছে। ভিডিও-তে দেখা গিয়েছে, সংস্থাটি তাদের মক্কেলদের ১০০টি ভ্রূণের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করার সুযোগ দিচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রায় যার খরচ কমবেশি ৪২ লক্ষ টাকা। এক কথায়, ধনী দম্পতিদের ভ্রূণের আইকিউ পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সূত্রের দাবি, ওই বাবা-মায়েরা বুদ্ধিমত্তার জেনেটিক ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সন্তান নির্বাচন করতে পারবেন। অর্থাৎ, ১০০টি ভ্রূণের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সেটি পৃথিবীর আলো দেখবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া শিশুরা যে সুযোগ পাবে না। টাকার জোরে জন্মের আগেই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ‘অ্যাডভান্টেজ’ পাবে বিশেষভাবে ‘বুদ্ধিমান’ ঘোষিত শিশুরা। সংস্থার ম্যানেজাররা গর্ব করে জানিয়েছেন যে, তাঁদের পদ্ধতিতে আগত শিশুরা ছয়ের বেশি আইকিউ পয়েন্ট লাভ করতে পারে।
জেনেটিক পরিবর্তন কতটা নৈতিক, তা নিয়ে নানা স্তরে বিতর্ক রয়েছে। তার মধ্যেই হেলিওস্পেক্ট জিনোমিক-এর পদক্ষেপ আগুনে ঘি ঢেলেছে। তদন্ত চালিয়েছিল অসরকারি সংস্থা ‘হোপ নট নেট’। তাদের সাফ কথা, এই পদক্ষেপ চরম অনৈতিক। ক্যালিফোর্নিয়ার জেনেটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি সেন্টারের সহযোগী পরিচালক কেটি হাসনের মত, “সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এটি ‘উন্নত’ এবং ‘নিকৃষ্ট’ জেনেটিক্সের যে ধারণা রয়েছে, সেটাকেই স্বাভাবিক হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় হলে এই বিশ্বাসই পোক্ত হবে যে, সামাজিক কারণের ফলে বৈষম্য তৈরি হয় না। উল্টে তা জীববিজ্ঞান, বলা ভালো জিনের তারতম্যের ফল।”
…………………………………………………..
‘হেলিওস্পেক্ট জিনোমিক্স’ আইভিএফ-এর আওতায় থাকা এক ডজনেরও বেশি দম্পতির সঙ্গে একটি প্রকল্পে কাজ করেছে। ভিডিও-তে দেখা গিয়েছে, সংস্থাটি তাদের মক্কেলদের ১০০টি ভ্রূণের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করার সুযোগ দিচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রায় যার খরচ কমবেশি ৪২ লক্ষ টাকা। এক কথায়, ধনী দম্পতিদের ভ্রূণের আইকিউ পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সূত্রের দাবি, ওই বাবা-মায়েরা বুদ্ধিমত্তার জেনেটিক ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সন্তান নির্বাচন করতে পারবেন। অর্থাৎ, ১০০টি ভ্রূণের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সেটি পৃথিবীর আলো দেখবে।
…………………………………………………..
মানুষের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য গঠন পূর্বনির্ধারিত হলে সৃষ্টির রহস্য বলে আর কিছু থাকবে না। মানুষ ‘ম্যানুফ্যাকচার’ হবে মাতৃ জঠরে, পরে হয়তো গবেষণাগারে। ইতিমধ্যেই এমন পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে রেখেছেন ইয়েমেনের মলিকিউলার বায়োটেকনোলজিস্ট হাশেম আল-ঘাইলি। বিশাল গবেষণাগারে বসানো থাকবে কাঁচের গোলকের মতো যন্ত্র। আর তাতে তৈরি হবে মানবশিশু। তাঁর দাবি ‘এক্টোলাইফ’ নামে ওই গবেষণাগারে থাকবে ৭৫টি কক্ষ। প্রতি ঘরে থাকবে ৪০০টি ‘কৃত্রিম গর্ভ’। অর্থাৎ, একসঙ্গে জন্ম দেওয়া যাবে ৩,০০০ শিশুর। এখানেও উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রসূতি-নবজাতকের মৃত্যু রোধ করাই লক্ষ্য, শুরুতে জানিয়েছিলেন কাশেম। কিন্তু তারপরই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। জানা যায়, সন্তানের মধ্যে বাবা-মায়ের কোন গুণ থাকবে, গায়ের রং, উচ্চতা, শারীরিক গঠন, বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়ও জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আগে থেকেই ঠিক করা যাবে। আবার চিনের সাংহাই প্রদেশের ‘সাংহাই অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট’-এর নিউরোসায়েন্স বিভাগের জীববিজ্ঞানীরা ক্লোন করে তৈরি করেছে বাঁদর। ঠিক যেন আসল রেসাস বাঁদরের ‘জেরক্স কপি’। এমনকী, দেহকোষগুলিও একই রকমের। এর আগেও গিনিপিগ, কুকুর, বেড়াল, খরগোশ, ভেড়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর ক্লোন করা হয়েছে। তবে ১৯৯৬ সালে এভাবে জন্ম নেওয়া ভেড়া ‘ডলি’ ও অন্য প্রাণীগুলি বেশিদিন বাঁচেনি।
অর্থাৎ, খোদার ওপর খোদকারি চলছেই। এর আগে জিন বদলানো মশাদের সঙ্গম ঘটিয়ে মশার বংশ ধ্বংস করার পরিকল্পনা হয়েছিল। সেভাবেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে কীট-পতঙ্গ তৈরি হয়েছে। আবার বিভিন্ন খাদ্যশস্যে জিনগত পরিবর্তন বা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নতির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তা যতটা কৃষক ও সাধারণ মানুষের জন্য, তার চেয়েও বেশি ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। হড়পা বান একেবারে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু ২০১৩ সালের কেদারনাথ থেকে ২০২১-এর চামোলি, ২০২২-এর জুলাইয়ে অমরনাথ থেকে অক্টোবরের মালবাজার, সব এক সুতোয় বাঁধা। প্রকৃতিকে শাসন করার নামে বাণিজ্যিক মুনাফা করতে গিয়ে উল্টে প্রকৃতির রোষেই বারবার বিপর্যয় নেমে এসেছে।
………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: পেশার দায়বদ্ধতা ‘মানবিক’ হওয়ার পথে বাধা হয় না
………………………………………………..
কিন্তু কোনও মানুষকে জন্মের আগেই গবেষণার বিষয় করে তোলা কি ঠিক? অনেকেই এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। প্রকৃতিকে এড়িয়ে মানবদেহে জিনগত পরিবর্তনের চেষ্টা বিবর্তনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিবহুল হতে পারে অবশ্যই। মানুষের ভ্রূণের জিন যখন বদলে দেওয়া হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে, তখন কিন্তু শুধু একজন ব্যক্তির জিন বদল হচ্ছে না। বদলে যাচ্ছে একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিনও। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে তৈরি হবে ‘ডিজাইনার বেবি’ বা ‘পছন্দসই শিশু’। এই প্রবণতাকে চলতি কথায় ‘ইউজেনিক্স’ বলা হয়। যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকবে, তারা তৈরি করবে ‘উন্নততর’ শিশু। তৈরি হতে পারে জিনগত বৈষম্য এবং সামাজিক বিভেদও।
তাই এই ধরনের যে কোনও পদক্ষেপের আগে নৈতিকতার প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া বেশি জরুরি। বহু দেশই কিন্তু ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। তাই ‘প্রজনন সংক্রান্ত নয়, শুধু এমন ক্ষেত্রেই জিনগত পরিবর্তন’-কে সীমিত রেখেছে তারা। ভবিষ্যতের মানুষের চেহারা বা চরিত্র কী হবে, তা নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই। হয়তো শরীরে থাকবে উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্র। হাত-পা-ফুসফুস প্রতিস্থাপিত হবে কৃত্রিম অঙ্গে। কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের মতো মানুষ হয়ে উঠবে সাইবর্গ। কিন্তু যা হবে, তা যেন হয় সার্বিক, গোটা মানবসভ্যতার জন্যই। শুধু বিশেষ কয়েকটা শ্রেণির হাতে তা সীমাবদ্ধ থাকলে সেটা হবে ‘মানুষ’ জাতির কলঙ্ক।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………