যে-দেশে ট্রেনে চড়া এখনও অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন, যে-দেশে ট্রেনে চড়া এখনও রোমাঞ্চকর, যে-দেশে ট্রেন দেখতে অপু-দুর্গা ছুটে গিয়েছিল, যে-দেশে ট্রেনে চড়ে অনেকদূর যাওয়া যায়, যে-দেশে ট্রেনের কামরায় বন্ধুত্ব হয়, যে-দেশের ট্রেনের সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ হলে সে আলাপ দীর্ঘদিন থেকে যায়, যেখানে একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া হয়, যে-ট্রেনে অচেনা যাত্রীরাও একসময়ে তাস খেলায় মেতে ওঠে, যেখানে অন্ত্যাক্ষরি খেলা হয়, সেই ট্রেনই এখন আতঙ্কের আরেক নাম।
২০২৪, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস, এখনও অবধি মৃত ৯, আহত ৬০। ২০২৩, করমণ্ডল এক্সপ্রেস, মৃত ৩০০, আহত ১২০০। ২০২২, বিকানের-গৌহাটি এক্সপ্রেস, মৃত ৯, আহত ৩৬। ২০২০, অউরঙ্গাবাদ এক্সপ্রেস, মৃত ১৬ পরিযায়ী শ্রমিক।
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ২.৬ লক্ষ মানুষ।
এদেশে সাধারণ মানুষের, খেটে খাওয়া, গরিব-মধ্যবিত্তের ততটাও বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই বলে মনে করে এদেশের মন্ত্রিসভা, তাবড় তাবড় পয়সাঅলা লোকেরা, হঠাৎ টাকা এসে যাওয়া বড়লোকেরা। যাদের সব আছে, তাদের সেবায় আমাদের দেশ মেতেছে। আমাদের এই দেশটি কয়েকজনের ‘ব্যক্তিগত দেশ’-এ পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা জানতাম দেশ সকলের, জানতাম– প্রতিটি মানুষেরই তার নিজের দেশ তার ব্যক্তিগত চাদর। কিন্তু পৃথিবীতে শরণার্থী বাড়ছে, দেশহীন মানুষই সংখ্যাগুরু হতে চলেছে। দেশ হাতে-গোনা কয়েকজনের। তাই সাধারণ মানুষের দিকে, জনসাধারণের পরিষেবার দিকে এই দেশ আর বিনিয়োগ করবে না। পরপর ট্রেন দুর্ঘটনা আমাদের এই বিশ্বাসে উপনীত করছে যে, ট্রেনের বেসরকারিকরণ আর বেশি দূরে নয়। তখন কম খরচে বেশিদূর যাত্রা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে হবে। ইতিমধ্যেই আমাদের বাস্তবতা প্রায় সেটাই।
বুলেট ট্রেন, স্পেশাল ট্রেনের বাড়বাড়ন্ত যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ট্রেনও এবার বড়লোকের কান্ট্রিসাইড দেখার বিলাসিতা শুধু। চার বছর আগে যদিও আমরা টের পেয়ে গিয়েছিলাম এ সত্য, যখন দেখেছিলাম কোভিডের বছর জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা হাঁটছিলেন। তাঁদের জন্য কোনও পরিবহণের ব্যবস্থা করেনি সরকার। বরং, তাঁদের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গিয়েছিল। শুধু পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর নয়, যাঁরা লাইন সারাইয়ের কাজ করেন, যাঁরা রেলেরই কর্মী, তাঁদের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার হিসেব আমাদের কখনও জানানো হয়নি। একটু খুঁজলেই দেখা যাবে, এই ‘সস্তা’র রেলকর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা। রাতে রেললাইনে তাঁরা কাজ করেন ট্রেনের সংখ্যা কম বলে, ট্রেন আসবে না এই বিশ্বাসে– এই তথ্য জেনে। তবুও তাঁদের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়। সিগন্যাল না মানা, কুয়াশায় দেখতে না পাওয়ার জেরে কতশত রেলকর্মীর যে মৃত্যু হয়, তা রেলমন্ত্রক চেপেই যায়। কারণ এদেশে মানুষ সস্তা। সামান্যতম টাকায় মানুষ পাওয়া যায় কাজের জন্য, সামান্যতম টাকায় তাঁর মৃত্যু চেপে দেওয়া যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এদেশে সাধারণ মানুষের, খেটে খাওয়া, গরির-মধ্যবিত্তের ততটাও বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই বলে মনে করে এদেশের মন্ত্রিসভা, তাবড় তাবড় পয়সাঅলা লোকেরা, হঠাৎ টাকা এসে যাওয়া বড়লোকেরা। যাদের সব আছে, তাদের সেবায় আমাদের দেশ মেতেছে। আমাদের এই দেশটি কয়েকজনের ‘ব্যক্তিগত দেশ’-এ পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা জানতাম দেশ সকলের, জানতাম– প্রতিটি মানুষেরই তার নিজের দেশ তার ব্যক্তিগত চাদর। কিন্তু পৃথিবীতে শরণার্থী বাড়ছে, দেশহীন মানুষই সংখ্যাগুরু হতে চলেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এদিকে বুলেট ট্রেনের দাম চড়চড়িয়ে বাড়ছে, পরিষেবাও উন্নত হচ্ছে, ট্রেনে উঠলেই ট্রেনকর্মীরা হাতে গোলাপ ফুল ধরিয়ে দিচ্ছে, তারা স্যুটেড-বুটেড, রিভলভিং চেয়ার, অনেকটা লেগ স্পেস, ঘণ্টায় ঘণ্টায় রিফ্রেশমেন্ট, বাইরে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। কারণ এইসব ট্রেনের ছোট ছোট অজানা স্টেশনে দাঁড়ানো নেই। শুধু, বড় বড় স্টেশন থেকে ট্রলি নিয়ে উঠবে প্যাসেঞ্জার। বন্দে ভারতের এক-একটি কামরা তৈরি করতে খরচ হয় সাড়ে ছ’কোটি টাকা। এক-একটি ট্রেন তৈরি করতে খরচ হয় ১০৫ কোটি টাকা। সঙ্গে রয়েছে বন্দে ভারতের জন্য বিশেষ লাইনের খরচ, সেটাও অঙ্কও কোটির ওপর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন তিতাস রায় বর্মন-এর লেখা:‘মেয়ে চাই?’ আর ‘মেয়ে কই!’ শহরের দেওয়াল লিখন যেন মেয়েদেরই ভাগ্যলিপি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর এইসব সস্তা মানুষের ট্রেনের ভেতরে ঢুকলে বাস্তবটা সজোরে ধাক্কা মারে। একটা বার্থে দু’-তিনজন দলা পাকিয়ে শুয়ে আছে। মাটিতে এর-ওর গায়ে চেপে শুয়ে আছে। অনেক সময় শোয়ারও জায়গা নেই। কোনও রকমে একটা পা ফেলার জায়গা। একটা ঢাউস ব্যাগ বুকে চেপে কোনও রকমে সময়টা পেরিয়ে যাওয়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা রাত পার করে দিচ্ছে যাত্রীরা। খাওয়া-দাওয়ার বালাই নেই। বাথরুম যাওয়াও দুষ্কর। এর ওপর চড়ে, ওকে মাড়িয়ে যাওয়া। তবুও ওই ট্রেনেই যেতে হবে। কাজের জ্বালায়, খাবারের প্রয়োজনে। আর এই ট্রেনগুলোরই সুরক্ষা দেবে না সরকার। এই ট্রেনগুলোতে লাগাবে এলএইচবি বগি। যে বগি দুর্ঘটনা নিরোধক। এই বগি থাকলে দেশলাই কাঠির মতো উল্টে যাবে না কামরা। যে বগি থাকলে ট্রেন লাইনচ্যুত হলে উল্টে যায় না। এই ব্যবস্থা শুধু বুলেট ট্রেনে, বিলাসবহুল ট্রেনে।
যে-দেশে ট্রেনে চড়া এখনও অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন, যে-দেশে ট্রেনে চড়া এখনও রোমাঞ্চকর, যে-দেশে ট্রেন দেখতে অপু-দুর্গা ছুটে গিয়েছিল, যে-দেশে ট্রেনে চড়ে অনেকদূর যাওয়া যায়, যে-দেশে ট্রেনের কামরায় বন্ধুত্ব হয়, যে-দেশের ট্রেনের সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ হলে সে আলাপ দীর্ঘদিন থেকে যায়, যেখানে একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া হয়, যে-ট্রেনে অচেনা যাত্রীরাও একসময়ে তাস খেলায় মেতে ওঠে, যেখানে অন্ত্যাক্ষরি খেলা হয়, সেই ট্রেনই এখন আতঙ্কের আরেক নাম। কারণ ট্রেন এখনও সাধারণ মানুষের, ট্রেন এখনও কাজে যাওয়ার উপায়, কারণ ট্রেন এখন বহু মানুষের সামর্থ্যের বাইরে। তাই এই ট্রেনের সুরক্ষা কারও দায়িত্ব নয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved