Robbar

ইজরায়েল-গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ট্রাম্পকে কি আর যুদ্ধবাজ বলা যায়?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 6, 2024 8:24 pm
  • Updated:November 6, 2024 8:24 pm  

বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর শেখ হাসিনাও তাঁর বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়েছে বাইডেনের আমেরিকাই। হাসিনার দাবি যদি সঠিক হয়, তাহলে ট্রাম্পের কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে করা মন্তব্যের ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে যে, ইউনূসকে হয়তো স্বস্তি দেবে না মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের এই পরিবর্তন। একইভাবে ট্রাম্পের জয়ের পর মনে করা হচ্ছে দীর্ঘ আড়াই বছর বাদে অবসান হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সখ‌্যতা নিয়ে কোনও মহলে কোনও গোপনীয়তা নেই। ভোটের প্রচারেও ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলে ইউক্রেনের পিছনে গাদা গাদা টাকা খরচ বন্ধ করবেন।

সুতীর্থ চক্রবর্তী

আমেরিকার ইতিহাস প্রেসিডেন্টের চেয়ারে এইরকম প্রত‌্যাবর্তন দ্বিতীয়বার দেখল। প্রথমটা ঘটেছিল ১৮৯৩ সালে। ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৯ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে গ্রোভার ক্লিভল‌্যান্ড পুনর্নির্বাচিত হতে পারেননি। চার বছর বাদে ১৮৯৩-তে তিনি ফের প্রসিডেন্টের চেয়ারে ফিরে আসেন। ১৩১ বছর বাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন।

US Election 2024: Donald Trump secures second term as President, world leaders congratulate 'on greatest comeback' - BusinessToday
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্টের দৌড়ে আরও এক নারীর যাত্রাভঙ্গ করলেন তিনি। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন হিলারি ক্লিন্টন। এবার কমলা হ‌্যারিসকে ফিরতে হল হোয়াইট হাউসের খুব কাছ থেকে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরপর দুই দাপুটে মহিলা নেত্রীর কাঁচের ছাদ ভাঙতে ব‌্যর্থ হওয়া মার্কিন রাজনীতিতে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ, ট্রাম্প শুধু মার্কিন সমাজে  শ্বেতাঙ্গ আধিপত‌্যবাদের প্রতীকই নন, রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরও একটি মুখ। গর্ভপাতের আইনি অধিকারকে সামনে রেখে কমলার মার্কিন সমাজের ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই ট্রাম্পের জয়ের মধ্যে দিয়ে কিন্তু পর্যুদস্ত হল।

পক্ষ-বিপক্ষ: ডোনাল্ড ট্রাম্প-কমলা হ্যারিস

প্রেসিডেন্টের চেয়ারে একজন রিপাবলিকান বসলেন না একজন ডেমোক্র‌্যাট বসলেন– তাতে কখনওই আমেরিকার অর্থনীতি ও বিদেশনীতির আমূল কোনও পরিবর্তন ঘটে না। ফলে ভারত-সহ গোটা দুনিয়ায় এই পরিবর্তনে শেষপর্যন্ত কিছু যায় আসবে না। তবুও ট্রাম্পের জয়ে ভারতের কিছুটা উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। কয়েকদিন পতনের পর শেয়ার বাজার ট্রাম্পের জয়ের খবরে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব দ্রুতই তাঁর প্রতিক্রিয়া দিয়ে দিয়েছেন। সরকারিভাবে ট্রাম্পের জয় ঘোষণার আগেই এক্স হ‌্যান্ডলে মোদির বার্তা চলে এসেছে। যদিও বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব‌্যাখ‌্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র‌্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের  উন্নতি ঘটেছে।’ এই পাঁচ প্রেসিডেন্টের মধ্যে যেমন রিপাবলিকান জর্জ বুশ, ডোনাল্ড ট্রাম্প রয়েছেন তেমন ডেমোক্র‌্যাট বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামা ও জো বাইডেনও আছেন।

Image
ভারত-মার্কিন সুসম্পর্ক: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

তবে ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত‌্যবাদী মানসিকতার জন্য তাঁকে ভারতের বর্তমান শাসকদলের প্রকৃত বন্ধু বলে অনেকে ভাবে। মোদি ও ট্রাম্পের বন্ধুত্বের রসায়নের ভিত্তি হিসেবে যেটাকে ধরা হয়। ট্রাম্পের জয়ে তাই ভারতের সাউথ ব্লকের উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ার মধ্যে অভাবনীয় কিছু নেই। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের জয়কে অনেকে ভারতের কাছে খুব ইতিবাচক বলে দেখছেন। কয়েকদিন আগেই ট্রাম্প বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন নিয়ে বেশ কঠোর মন্তব‌্য করেছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্র‌্যাটদের সুসম্পর্ক সুবিদিত। ফলে মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্প আসায় সমীকরণের কিছু অদলবদল ঘটতে পারে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর শেখ হাসিনাও তাঁর বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়েছে বাইডেনের আমেরিকাই। হাসিনার দাবি যদি সঠিক হয়, তাহলে ট্রাম্পের কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে করা মন্তব্যের ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে যে, ইউনূসকে হয়তো স্বস্তি দেবে না মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের এই পরিবর্তন।

Former President Donald Trump speaks during an election night event in West Palm Beach, Florida, on November 6, 2024.
ভোটের ময়দানে ট্রাম্পের ‘টেক্কা’

একইভাবে ট্রাম্পের জয়ের পর মনে করা হচ্ছে দীর্ঘ আড়াই বছর বাদে অবসান হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সখ‌্যতা নিয়ে কোনও মহলে কোনও গোপনীয়তা নেই। ভোটের প্রচারেও ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলে ইউক্রেনের পিছনে গাদা গাদা টাকা খরচ বন্ধ করবেন। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে থাকলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হত না বলেও ট্রাম্প জানিয়েছেন। এবার ট্রাম্প এসে যদি ইউক্রেনকে সাহায্য বন্ধ করেন এবং পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি করান, তাহলে তা অবশ্যই গোটা বিশ্বের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে। মনে রাখতে হবে ট্রাম্পের প্রথম দফার প্রেসিডেন্সিতে সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত‌্যাহারের চুক্তি হয়েছিল। ট্রাম্প গাজাতেও যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে কিছুদিন আগে বার্তা দিয়েছেন। ইজরায়েল-গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর খোদ আমেরিকাতেই বাইডেনের গায়ে যুদ্ধবাজ তকমা লেগেছে। ট্রাম্পকে সেই অর্থে যুদ্ধবাজ বলা যায় না।

Image
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিশা দেখাতে পারবেন ট্রাম্প?

ট্রাম্পের জয়ের খবরে ভারতের শেয়ার বাজার চাঙ্গা হলেও আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের দিক থেকে আগামী চার বছর ভারত কতটা স্বস্তিবোধ করবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয়ও রয়েছে। বাইডেনের আমলে ভারত-মার্কিন বাণিজ‌্য সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্টোদিকে  ট্রাম্প সবসময় ভারতের চড়া হারে আমদানি শুল্ক নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট পদে বসে তিনি ভারতকে শুল্কের রাজা আখ‌্যা দিয়েছিলেন। কেন মার্কিন  হার্লে ডেভিডসন বাইকের ওপর ভারত ১৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল। তিনি বিনামূল্যে মার্কিন প্রযুক্তি বিলিবণ্টন করতেও নারাজ। এদিক থেকে তিনি কট্টর ব‌্যবসায়ী। ট্রাম্পের এই ব‌্যবসায়ী মনোভাব  ভারতকে কতটা বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করতে দেবে তা নিয়ে বণিকমহলে প্রশ্ন রয়েছে।

Image
‘সিংহাসন’ পুনরুদ্ধারের পর

ট্রাম্প খুব কট্টরভাবে ‘আমেরিকার স্বার্থ প্রথম’ নীতিতে বিশ্বাসী। তবে ট্রাম্পের কট্টর চিন বিরোধিতার সুযোগ ভারত নিতে পারবে। ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যিই আবার চিনের পণ্যের উপর চড়া হারে শুল্ক বসান, তাহলে ভারতের ব‌্যবসায়ীদের সুবিধা হবে। রাশিয়ার থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল-সহ অন্য যেসব সুবিধা ভারত পাচ্ছে, তা ট্রাম্পের আমলে নির্বিঘ্ন হতে পারে। কারণ বাইডেনের মতো ট্রাম্প মোদি-পুতিনের সখ্যে ঈর্ষান্বিত হবেন না। ট্রাম্পের অভিবাসী নীতি বরাবরই কঠোর। এবারও ভোটে জেতার পর তিনি বলেছেন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের তিনি আমেরিকা থেকে তাড়াবেন। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসী নীতির ফলে আমেরিকায় বসবাস করতে ইচ্ছুক বহু ভারতীয় সমস‌্যায় পড়েন। তাঁরা এবারও একটু উদ্বেগে।

……………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………..

সর্বোপরি ট্রাম্পের নানাবিধ খামখেয়ালিপনা নিয়ে কূটনৈতিক মহল সতর্ক রয়েছে। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট পদে বসেও তিনি নানা খামখেয়ালিপনা দেখিয়েছেন। যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের চেয়ারের সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়। ২০২০ সালে ভোটে হেরে গিয়ে মার্কিন সংসদে সমর্থকদের দিয়ে হামলাও চালিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেসবের জন্য তাঁর কোর্টে শাস্তিও হতে পারে। ফলে প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের দ্বিতীয় পর্বও যে নানারকম বিতর্কে ভরা থাকবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।