যদি কখনও অগোচরেই নিজের অন্ধকারের দিকে তাকাতাম, দু’-দণ্ড বসতাম, তাহলে ভয় কাহাকে? লুক্কায়িত, অবদমিত পাপকে কঠিন লড়াইয়ের ডাক দিতাম। অন্ধকারে বাসা বাঁধতে দিতাম না। আজ যখন ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের অন্ধকারে পা দেয়, তখন অনুশোচনা হয় কেবল। এ তো আমাদেরও করার কথা ছিল। কথা ছিল কৃত্রিম আলোর বশবর্তী না হওয়ার। আদিমতম আঁধারে দৃষ্টিকাতর হয়ে থাকার।
ছোটবেলায় আমাদের কোন্নগরের বাড়িতে বেশিরভাগ সময়ই আলো থাকত না। লোডশেডিং। জেনারেটর এসেছে অনেক পরে। ততদিন অন্ধকারের সঙ্গে আমাদের বড় ভাব হয়ে গিয়েছিল। আলো না থাকলেও কখনও মনে হয়নি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। বরং দিব্যি দেখতে পেতাম। জানতাম কোথায় জলের বোতল আছে, কোথায় মুড়ির কৌটো, কোথায়ই বা ঠামি চুপচাপ বসে আছে। আর পূর্ণিমা হলে তো কথাই নেই। চাঁদের আলোয় ভেসে যেতে যেতে এমনিই কেটে যেত সময়। আমাদের দোতলার বড় বারান্দায় জ্যোৎস্নায় গাছের ছায়াগুলো মেঝেতে কত যে নকশা কাটত। আমি আর বোন ওই গাছের আঁকিবুঁকিতে গড়াগড়ি খেতাম, আমাদের আহ্লাদ তখন থামায় কে! অন্ধকারে কোথায় কী আছে, ঠিক জানতাম আমরা। তারপর জেনারেটর চলে এল, রাস্তায় হ্যালোজেন আলো এল, আমরাও ধীরে ধীরে শহরে চলে এলাম। এখানে আর কারেন্ট যায় না। তাই আজকাল অন্ধকারে আর ঠাওর করতে পারি না। ছায়াতেও ভয় ধরে গিয়েছে।
আজ আমরা শিখে গিয়েছি অন্ধকারকে কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়। কৌশলী আমরা, জেনে ফেলেছি কারখানায় কৃত্রিম আলো তৈরি করার সূত্র। বাইরের অন্ধকার তাড়াতে গিয়ে নিজেদের ভেতরের অন্ধকারকে স্বীকার করিনি। ভেবে নিয়েছি, মানুষ জন্ম লাভ করেছি যখন, তখন আলোই আমাদের যাত্রাপথের দিশারি। কিন্তু অন্ধকারই তো আমাদের পুরনো বন্ধু, মেঠো পথে কবেই বা হ্যালোজেন ছিল। তবুও তো বাড়ির পথ কখনও ভুল হয়নি। মহাবিশ্বের অন্ধকারের দিকেই আমাদের যাবতীয় তাকিয়ে থাকা, নতুন কিছু দেখার আশা অন্ধকারকেই ভেদ করে। চাঁদেও আমরা পা ফেললাম অন্ধকার দিকেই। জড়িয়ে ধরলাম আঁধারকে, সাহস করলাম ওই ঘন কালোতে চোখ রাখার।
অথচ আমরা কৃত্রিম আলোকে আনন্দ ভেবে ভুল করেছি, যন্ত্রণাকে ভেবেছি ঈশ্বরের শয়তানি। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, হতাশা, গ্লানিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি অন্ধকারের দিকে। যেন অন্ধকারেরই কথা ছিল এদের আশ্রয় দেওয়ার, লালন-পালন করার। লুকিয়েছি, অবদমন করেছি। তৈরি হয়েছে নিষ্ঠুরতা, হিংসা, ঘেন্না, নারকীয় উল্লাস, কেটে নুন ছড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস। খেলাচ্ছলে সহপাঠীকে বারান্দা থেকে ফেলে দিয়েছি। মেরে প্রমাণ লোপাট করেছি। অন্য গোষ্ঠীর মেয়েকে ধর্ষণ করার বিধান দিয়েছি, ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দিয়েছি, আমরাই সেই ফুটেজ দেখেছি লালায়িত চোখে। নিচু জাতের মুখে মূত্রত্যাগ করেছি, দলিতদের বিবস্ত্র করে পাড়া ঘুরিয়েছি, দলিত ছাত্রকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছি, অন্য ধর্মের মানুষকে ঘরছাড়া করেছি, তাদের ঘরে আগুন জ্বালিয়েছি।
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।
(অন্ধকার, জীবনানন্দ দাশ)
যদি কখনও অগোচরেই নিজের অন্ধকারের দিকে তাকাতাম, দু’-দণ্ড বসতাম, তাহলে ভয় কাহাকে? লুক্কায়িত, অবদমিত পাপকে কঠিন লড়াইয়ের ডাক দিতাম। অন্ধকারে বাসা বাঁধতে দিতাম না। আজ যখন ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের অন্ধকারে পা দেয়, তখন অনুশোচনা হয় কেবল। এ তো আমাদেরও করার কথা ছিল। কথা ছিল কৃত্রিম আলোর বশবর্তী না হওয়ার। আদিমতম আঁধারে দৃষ্টিকাতর হয়ে থাকার।
আজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তারই সহপাঠীদের হাতে, ওই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল, বা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তারা কেউ এগিয়ে আসে না পুলিশের কাছে। উল্টে মৃতদেহ সামনে রেখে সবাই মিটিং করে, পুলিশের কাছে কী বয়ান দেবে তারা। ভেঙেচুরে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটা তখন অদূরেই পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি করে, পুলিশকে ঢুকতে দেয় না। পরদিন সবাই ফেরার হয়ে যায়। কেউ বিচার চায় না, সবাই প্রমাণ লোপাটে ব্যস্ত, কেউ এসে স্বীকার করে না। কত বয়স এই ছেলেগুলোর? এই তো সবে বাড়ির বাইরে পা রেখেছে, ইতিমধ্যে তারা জেনে গিয়েছে কীভাবে মেরে ফেলতে হয়, কীভাবে মিথ্যে বলতে হয়, কীভাবে মৃত সহপাঠীর লাশ দেখেও নির্লিপ্ত থাকতে হয়। তবুও আমরা বিচার চাই না, চাই ক্যাম্পাসে ঢুকে মাদকচক্র ধরতে, স্বাধীনচিন্তার প্রতি একধরনের ভয় ধরিয়ে দিতে, উচ্চশিক্ষাবিমুখ করতে পরবর্তী প্রজন্মকে। তদন্তের থেকে চোখ সরিয়ে, র্যাগিং-কে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে উদ্যত না হয়ে, উইচ হান্ট করতে নেমে পড়ি। অন্ধকারে পচন ধরে। কৃত্রিম আলো আমাদের চোখ ঝলসিয়ে দেয়, মন পুড়িয়ে দেয়।
কিন্তু ৮ বছরের আসিফাকে গণধর্ষণ আমাদের পুড়িয়ে মারে না, বরং প্রত্যক্ষ করি ধর্ষণকদের সমর্থনে মিছিল বের হয়েছে। বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মুক্তি পেলে তাদের মালা পরিয়ে বরণ করা হলেও নির্বিকারে তা দেখতে থাকি। মণিপুরের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জেতা-হারা নির্ধারিত হয় কোন গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ করেছে, তার বিচারে। এই নারকীয় উল্লাসে হয় আমরা অংশগ্রহণ করছি, নয়তো ভাবলেশহীন হয়ে দেখছি।
আজকে চাঁদের অন্ধকারকে যদি গ্রহণ করতেই পারলাম আমরা, তাহলে কেন গ্রহণ করতে পারব না নিজের অবদমিত অন্ধকারকে? অবদমনকে না লুকিয়ে, নিয়ে আসি বরং প্রকাশ্য রাস্তায়। আড়াল সরিয়ে তা বেরিয়ে আসুক, সাহায্য নিক অন্যের। প্রাকৃতিক আলোর সন্ধান পাক সে। অন্ধকারকে মুক্ত করি, আকাশে উড়িয়ে দিই, সে ফিরে পাক নিজের গরিমা। চাঁদের মতো আমরাও সেজে উঠি অন্ধকারের রূপে। ফিরে পাই পুরনো বন্ধুকে, চিরকালের আশ্রয়কে–
Hello darkness, my old friend
I’ve come to talk with you again.
ফ্রয়েডের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ‘eros and thanatos’ (১৯২০), বা সেক্স ড্রাইভ (life force/will to live) ও ডেথ-ড্রাইভ (self-annihilation/destruction)-এর দ্বিধা ছাড়িয়ে, ভ্রমর বা ভ্রমররা বাঁচতে চায়, এবং সেই বেঁচে থাকার কেন্দ্রে রয়েছে রক্ত-মাংস-মজ্জা দিয়ে তৈরি একটি শরীর।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এখন ৯০ বছরের। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, শতবর্ষ পালনটা ওঁর সঙ্গে আমরা একসঙ্গেই করব। এই যে নাটকের একটা আলাদা সংসার এবং সে সংসারে সদস্যদের সবার মন জুগিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজটা সুন্দর করে করলেন রুদ্রদা, সেটা ওঁর আজকালকার হাসি দেখেই বুঝতে পারি।