Robbar

তুমি একা, সবার চেয়ে আলাদা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 11, 2025 1:50 pm
  • Updated:December 12, 2025 3:28 pm  

এই একুশ শতকেও যে-কোনও সময়ে, যে-কোনও জায়গায় মেয়েদের হাতের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগান থাকবে না কেন? এহেন প্রশ্নের উত্তরে কর্তৃপক্ষ যাঁরা, তাঁরা নিশ্চিত বলবেন, সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই তো দেশের প্রায় প্রতিটি এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, মায় স্কুল-কলেজে অবধি স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডর মেশিন বসানো হয়েছে। ব্যস! তাঁদের দায়িত্ব এখানেই ফুরিয়ে যায়। এগুলো আদৌ কাজ করে কি না, এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক

জয়িতা দাস

৫ ডিসেম্বর, দেশ জুড়ে ইন্ডিগো সংস্থা বাতিল করেছিল শতাধিক ফ্লাইট। ভারতের প্রায় প্রতিটি এয়ারপোর্টেই যাত্রীদের দুর্দশা ছিল চরমে। সবথেকে বেশি বিশৃঙ্খল ছিল বেঙ্গালুরু আর মুম্বই এয়ারপোর্ট। ইন্ডিগো সংস্থা তো বটেই, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষও যাত্রীদের প্রাথমিক সুবিধা দিতে ব্যর্থ তখন। ঘটনার আকস্মিকতায় নিরুপায়, বিভ্রান্ত যাত্রীরা তাঁদের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন স্লোগানে– ‘ডাউন, ডাউন ইন্ডিগো’।

এই পরিস্থিতিতেই বেঙ্গালুরুর কেম্পাগৌড়া এয়ারপোর্টের এক নম্বর টার্মিনাসের এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল একটি ‘অসহায়’ মেয়ে।

প্রতীকীচিত্র

মেয়েটির পা গড়িয়ে নামছে রক্ত। যেভাবেই হোক মেয়েটির এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন চাই-ই চাই!

এয়ারপোর্টের প্রতিটি ফার্মেসি ফিরিয়ে দিয়েছিল তাকে। (ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনগুলোও জবাব দিয়েছিল নিশ্চিত। তাছাড়া এগুলোর অধিকাংশই তো অকেজো! নতুন মেশিনগুলিতেও ন্যাপকিন ফুরিয়ে গেলে আদৌ ভরা হয় কি না সন্দেহ!)।

–‘নেই। নেই। নেই।’
–‘ফুরিয়ে গিয়েছে’।

এই একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত-বিপর্যস্ত মেয়েটি হয়তো রাগে ফুঁসছিল। তবে রাগ থেকেও তার লজ্জা যে প্রবল ছিল, সে নিশ্চিত। দু’-পা বেয়ে নেমে আসা রক্তধারাকে আড়াল করতে ব্যর্থ সে। এই লজ্জা সে রাখে কোথায়! মেয়েটির চারপাশে অস্বস্তি আর ফিসফাস। ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়। রজঃস্বলা নারী বরাবরই একলা। উপচে পড়া ভিড়েও নিঃসঙ্গ সে। জন-সমাগম তার স্পর্শ বাঁচিয়ে পিছলে-পিছলে যায়।

‘অসহায়’ মেয়ের এই হেনস্তা সহ্য করতে পারেননি তার বাবা। এবার তিনি নিজেই ছুটলেন ইন্ডিগোর কিয়স্কে। রাগ-ক্ষোভ-হতাশা চিৎকার করে উগরে দিলেন তিনি– ‘মেরি বেটি কো প্যাড চাহিয়ে…’!

বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অভিযোগকারী

পিতার এই ক্ষোভ-আর্তির দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘X’-এ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় গ্লোরিয়া স্টাইনেমের লেখা একটি লাইন,

‘So what would happen if suddenly, magically, men could menstruate and women could not?’

ধরুন, হঠাৎ করেই অলৌকিক কোনও জাদুবলে পুরুষদের মাসিক ঋতুচক্র আরম্ভ হল আর মেয়েদের বন্ধ হয়ে গেল! এমন হলে নিশ্চিত ‘menstruation would become an enviable, boast-worthy, masculine event’ হবে। বলছেন গ্লোরিয়া, তাঁর ‘ইফ ম্যান কুড মেন্সট্রুয়েট’ প্রবন্ধে।

তেমন হলে পিরিয়ড যে ঈর্ষণীয়, গর্ব করার মতো পৌরুষের চিহ্ন হয়ে উঠত, সে নিশ্চিত। ঋতুকালের দৈর্ঘ্য তখন হয়ে উঠত পুরুষের অহংকার। কার কত বেশি রক্তপাত হয়, সেটাও হয়ে উঠত জাঁকের বিষয়। আর কিশোররা! তাদের কাছে এ হত এক বিশাল পার্বণ। এ যে পুরুষত্বে দীক্ষা নেওয়ার মহোৎসব! পিরিয়ড নিয়ে তাদের মনে কোনও কুণ্ঠা থাকত না। সেনাধ্যক্ষ থেকে রাজনৈতিক নেতা, ধর্মগুরু– প্রত্যেকেই এই নিয়ে বিবৃতি দিতেন। মেডিকেল স্কুলগুলির দরজা তখন মেয়েদের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। কারণ, ‘they might faint at the sight of the blood.’ এবং অতি অবশ্যই “Men would convince women that sex was more pleasurable at ‘that time of the month.’ ” ক্ষমতার শিখরে পৌঁছে যাওয়া পুরুষদের পক্ষে পিরিয়ড-কালীন সময়ে কাজের চাপ সামাল দেওয়া কষ্টকর হত বলে সরকারি উদ্যোগেই হয়তো তৈরি হয়ে যেত ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ডিসমেনোরিয়া’। পিরিয়ড চলাকালীন খেলাধুলায় অংশ নিলে ছেলেরা যে ভালো ফল করবেই এবং অলিম্পিকেও বেশি মেডেল জিতবে– পরিসংখ্যান সেকথাও প্রচার করত। এবং অবশ্যই ‘Sanitary supplies would be federally funded and free.’ পথচলতি কোনও ছেলে হয়তো মাঝপথে তার বন্ধুর মুখোমুখি হলে তাকে তারিফ করে বলত, “Man you lookin’ good!”

–“Yeah, man, I’m on the rag!” গর্বের সঙ্গেই জবাব দিত ছেলেটি।

মেয়েদের ক্ষেত্রে উলটপুরাণ। পিরিয়ড তাদের কাছে লজ্জার। আজও। কাগজে মুড়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার দিন হয়তো ফুরিয়েছে। দোকানে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে কোন ব্র্যান্ডের প্যাড চাই, সেও হয়তো নিঃসংকোচে বলছে আজকালকার মেয়েরা। কিন্তু যদি প্রকাশ্যে দু’-পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে! এখনও লজ্জায় গুটিয়ে যায় মেয়েরা। যেন এ তার অপরাধ! এমন দু’-একজন আছেন হয়তো, যাঁরা এহেন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন। এমনই একজনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন গ্লোরিয়াই।

১৯৭৮-এ লেখা তাঁর ‘ইফ ম্যান কুড মেনস্ট্রুয়েট’ প্রবন্ধের শুরুতেই। এক সভায় উপচে পড়া ভিড়ের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তোড়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সেই মহিলার পিরিয়ড শুরু হয়ে গিয়েছিল। সভা জুড়ে অস্বস্তি তখন। গ্লোরিয়ার মতো ‘ফেমিনাৎসি’ মহিলাও স্বীকার করছেন, সেই মুহূর্তে তিনিও বিব্রত। আর সেই মহিলা? সুস্পষ্ট সুরে ফিসফিস করে তাঁর কানে খবরটি তুলে দেওয়া হলে, বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে সেদিন সভার পুরুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের অবশ্যই গর্বিত হওয়া উচিত এই ভেবে যে আপনাদের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন এক রজঃস্বলা রমণী।’ গ্লোরিয়া লিখছেন, ‘শি হ্যাড টার্নড আ নেগেটিভ ইনটু আ পজিটিভ।’ অর্থাৎ, গ্লোরিয়ার মতো মহিলাও স্বীকার করছেন যে, এমন মুহূর্ত মেয়েদের জন্য একটা নেগেটিভ পরিস্থিতি তৈরি করে। সেই নেগেটিভিটিকে পজিটিভ ভাইবের ছোঁয়া দেওয়ার জন্য সমাজ মানসিকতার পরিবর্তন চাই নিশ্চিত, কিন্তু এর আগে চাই একটা প্রয়োজনীয় কাঠামো।

এই একুশ শতকেও যে-কোনও সময়ে, যে-কোনও জায়গায় মেয়েদের হাতের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগান থাকবে না কেন? এহেন প্রশ্নের উত্তরে কর্তৃপক্ষ যাঁরা, তাঁরা নিশ্চিত বলবেন, সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই তো দেশের প্রায় প্রতিটি এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, মায় স্কুল-কলেজে অবধি স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডর মেশিন বসানো হয়েছে। ব্যস! তাঁদের দায়িত্ব এখানেই ফুরিয়ে যায়। এগুলো আদৌ কাজ করে কি না, এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

অতএব মেয়েদেরই প্রস্তুত থাকতে হয়। তাঁরা নিজেরা প্যাড ক্যারি করার চেষ্টা করেন। ইন্ডিগো-বিপত্তির ঘটনা এতটাই আকস্মিক যে, কেম্পাগৌড়া-এয়ারপোর্ট-কন্যা নিশ্চিত, এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই যত বিপত্তি। তাছাড়া পাঁজিপুথি মিলিয়ে সব নারীর নির্দিষ্ট তারিখে তো আর পিরিয়ড হয় না! কখন কোথায় কোন পরিস্থিতিতে যে তাদের দু’-পা গড়িয়ে রক্তস্রোত নামবে, তা আগে থেকে কে বলতে পারে! এই দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচতেই প্রস্তুত থাকা। লোকচক্ষুর সম্মুখে তেমন কিছু ঘটলেই তুমি একা সবার চেয়ে আলাদা। তুমি তখন অস্পৃশ্য। নিজের দোষেই।

সেক্সিজম এতটাই গভীর সমাজে। গ্লোরিয়া নিশ্চিত ছিলেন, যদি পুরুষদের পিরিয়ড হত তবে ‘Sanitary supplies would be federally funded and free.’ তেমন কিছু যে ঘটে না, এর কারণ এই সেক্সিজম। যা নির্দিষ্ট করে দেয় জেন্ডার রোল, জেন্ডারের অবস্থান। ‘পিরিয়ড’– জেন্ডার-বিভাজনের এই আদিমতম অস্ত্র আজও এর আদিম ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বলেই এই নিয়ে এত লজ্জা, এত সংকোচ।

‘ইফ ম্যান কুড মেন্সট্রুয়েট’-এ গ্লোরিয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, মেনস্ট্রুয়েশনকে কী চোখে দেখা উচিত ছিল সমাজের। তা হয়নি বলেই এক পিতাকে চিৎকার করে তাঁর কন্যার হয়ে প্যাড ভিক্ষা করতে হয়। সেই আর্তি ক্যামেরা-বন্দি হলে ফুঁসে ওঠেন তিনি। এই আক্রোশের উৎস– কন্যার লজ্জাকে আড়াল করতে না পারার ক্ষোভ। এই ক্ষোভ হয়তো স্পর্শ করেছে সমাজকে। আলোড়ন উঠেছে। কিন্তু আদৌ কিছু পাল্টাবে কি? কেন প্যাডের জোগান ছিল না, প্রশ্ন উঠেছে এই। কেন দু’-পা বেয়ে নেমে আসা রক্তস্রোত লজ্জার কারণ হবে, কেন এই নিয়ে ফিসফাস হবে– এই নিয়ে কি আদৌ ভাবছেন কেউ? কই, পাশের যাত্রীর অনর্গল কাশিতে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও এই নিয়ে তো কখনও ফিসফাস করি না! বা রোগীটিও অন্যকে বিরক্ত করছেন বলে কুণ্ঠিত হলেও লজ্জা বোধ করেন না। শারীরিক অসুখ লজ্জার নয়, মেয়েদের পিরিয়ড কিন্তু লজ্জার।

আর যদি উল্টোটা হত? গ্লোরিয়ার ভাষায়–

‘The truth is that, if men could menstruate, the power justifications would go on and on.’