Robbar

বাংলা ভাষা ভাগ হবে হিন্দু-মুসলমানে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 5, 2025 7:37 pm
  • Updated:August 5, 2025 7:59 pm  
Bangle as like bangladeshi language controversy

যখন ‘এসআইআর’ এবং ‘এনআরসি’ নিয়ে সমস্ত বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে, তখন তাঁদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করাটাই উদ্দেশ্য। এতদিন জানতাম বাঙালির ‘এক জাতি এক প্রাণ’ হয়ে থাকার চর্চা ছিল। সে উচ্চমানের চিন্তাভাবনায় সমৃদ্ধ ছিল। গোবলয়ের অশিক্ষা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। এই অনন্য গুণ দিয়ে বাঙালিকে পৃথক করা যেত। বাঙালি এইসব মামুলি ব্যাপারকে ধর্তব্যের মধ্যেও আনত না। মাত্র এক দশক আগেও এসব নিয়ে কেউ ভাবেনি। অথচ আজ বাঙালিকে এসব নিয়ে ভাবানো যাচ্ছে। কে ভাবাচ্ছে? বাঙালির একশ্রেণির লোকজন। যাদের মূল লক্ষ্য এই ভাষার হিন্দু-মুসলমান করে গোবলয়ের সঙ্গে তফাতটা আরও কমিয়ে আনা যাবে।

সুমন সেনগুপ্ত

শামসুর রহমান লিখেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে রৌদ্র, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর বাঁকে বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়’।

যে ভাষায় এই কবিতা লেখা হয়েছে, সেটা কি বাংলাদেশি? ‘বাংলাদেশি’ বলে কোনও ভাষা হয় নাকি? আমরা যারা রোজকার জীবনে বাংলা ভাষায় কথা বলি, সেটা কি বিদেশি ভাষা? দিল্লি পুলিশের একটি চিঠি আবার বাংলা ভাষার সম্মান-অসম্মানের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এতদিন, বাংলাদেশি সন্দেহ করে, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখা, মারধোর করা এমনকী, বাংলাদেশে পে লোডার দিয়ে ছুড়ে ফেলার ঘটনা সামনে এসেছিল এবং বিতর্ক চলছিল– কিন্তু এবার সরাসরি ‘বাংলা ভাষা’কেই একটি ‘বিদেশি ভাষা’ বলে দেওয়া হল, দিল্লি পুলিশের একটি চিঠিতে। যাঁর স্বাক্ষরিত এই চিঠি, সেই ‘অমিত দত্ত’ বাঙালি কি না, জানা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চলা দিল্লি পুলিশ যে সচেতনভাবে এই কাজটা করেছে, বাংলা ভাষাকে অপমান করতে, বিদ্বেষের বীজ বুনতে, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

যে চিঠি ঘিরে বিতর্ক

যাঁরা বিভাজনের রাজনীতি করে, তাঁরা বিভাজনের কোনও অজুহাত যাতে হাতছাড়া না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখে। কখনও তাঁরা ধর্মের বিভাজন করে, কখনও জাত, লিঙ্গ এমনকী, মানুষের কথা ভাষাও হয়ে ওঠে তাঁদের বিভাজনের অস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য লাঞ্ছিত, অপমানিত এমনকী, মারও খেতে হয়েছে বাংলাভাষী মানুষদের। রোজ নানা বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে বাংলাভাষী মানুষদের এই সংক্রান্ত লাঞ্ছিত হওয়ার খবর আসছে। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এমনকী, পাশের রাজ্য ওড়িশা থেকে মূলত বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আক্রান্ত হওয়া এখন প্রায় জলভাত হয়ে গিয়েছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর দেখে অনেকেই হয়তো চমকে উঠেছেন, এই দেশটা তো এইরকম ছিল না! এইরকম বিদ্বেষপূর্ণ পরিস্থিতি পরিবেশ কী করে তৈরি হল, সেই নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের, বিবেকানন্দের ভাষায় কী আজকাল তবে কথা বলা অপরাধ? এই প্রশ্ন যেমন অনেকে করেছেন, তেমন উল্টো যুক্তিও আসতে শুরু করেছে। যে সমস্ত বাঙালিরা জলকে ‘পানি’ বলেন, বন্ধুকে ‘দোস্ত’ বলেন, বাবাকে ‘আব্বা’ বলেন, অতিথিকে ‘মেহমান’ বলে, তাঁরা বাঙালি হলেও এই দেশের মানুষ নন। খুব ঠিক কথা, তা একই কথা তো বিভিন্ন উত্তর ভারতের মানুষ এমনকী, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁরা জলকে কি জল বলেন না পানি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছেন, সেটা কি কূটনৈতিক কারণে নাকি শেখ হাসিনা, গৌতম আদানিরও বিশেষ ‘দোস্ত’ বলে? আসলে এই শব্দগুলো নিয়ে প্রশ্ন যে উঠছে, সেই প্রশ্নগুলোও সচেতনভাবে তোলা হচ্ছে। এই ধরনের দাবি শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর অজ্ঞতার পরিচয়।

আসলে এই শব্দগুলো কোনও একটি দেশের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এই শব্দগুলোর শিকড় অনেক গভীরে– ফারসি, উর্দু, আরবি ভাষা থেকে এসেছে, আর তা এসেছে মুঘল-তুর্কি আমলের প্রভাবে। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই শব্দগুলো কথ্যভাষার অংশ হয়ে উঠেছে– বাংলাদেশে যেমন, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে, এমনকী ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও। সেই কথাগুলো না জেনে কোনও মন্তব্য করলে একটি ভাষার প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া কিছুই তৈরি হয় না। ভদ্রবিত্ত যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষায় বহু সাধারণ মানুষই। বহুকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের মানুষ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে আসছে। অজ্ঞতা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যাচ্ছে এখন। একটি গ্রাম বা জনপদের মানুষের কথ্যভাষা অন্য গ্রামের জনপদের কথ্য ভাষার তফাতের উদাহরণ অজস্র আছে এই বাংলাতেই। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের বা উত্তরাঞ্চলের তফাত তো ছিলই, এটাই তো বৈচিত্র।

ওঁদের ভাষ্য বা ন্যারেটিভ ওঁরা এমন করে সমাজের ভিতরে প্রবেশ করাতে পেরেছে যে ‘নাস্তা’, কিংবা ‘গোসল’ এমনকী, ‘বাবা’ শব্দ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আজকাল বহু বাঙালি ‘ব্রেকফাস্ট করে, শাওয়ার নেয়’। তাঁরাই হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তানের ভাষ্য অনুযায়ী কথা বলছেন। তাঁদের মাথাতে নেই, যে ‘ব্রেকফাস্ট’ কিংবা ‘শাওয়ার’ও বিদেশি শব্দ, কিন্তু তাঁদের ‘নাস্তা’ কিংবা ‘গোসলে’ আপত্তি হচ্ছে। হিন্দিভাষীরা ওই শব্দ বললে সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু বাংলার এক অংশের মানুষ কেন বলেন ওই শব্দ, তাই নিয়েই শুরু হয়েছে সমস্যা। আসলে ওঁরা বুঝে গিয়েছে, বাংলায় শুধু ধর্মীয় তাস খুব বেশি কাজ করবে না, এখানে শ্রেণিবিভাজনটাও ভাষার মধ্যে দিয়েই আসে। তাই বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে গেলে, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করতে গেলে ভাষার তাস তাঁদের কাজে লাগতে পারে। একাংশের বাঙালি যেহেতু মনে করেন, যে ‘ওঁদের খুব বাড় বেড়েছে এবং ওঁরা জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে’ তাই এই ভাষার মধ্যে দিয়ে বিভাজনের রাস্তা নেওয়া। এমনিতে সারা দেশে মুসলমান বিদ্বেষ তো ছিলই, তার সঙ্গে যদি বাঙালি মানেই ‘বাংলাদেশি’– এই ভাষ্য সমাজের মধ্যে প্রবেশ করানো যায়, এবং এই বাংলা থেকে যদি অবাঙালি কোনও মানুষের ওপর আঘাত নেমে আসে, তাহলে সারা দেশে মেরুকরণের সুবিধা হবে।

বাংলা ভাষায় এমন অনেক শব্দ আছে, যা উর্দু এবং ফারসি থেকে এসেছে, যা বাদ দিলে বাংলায় কথা বলা মুশকিল হয়ে পড়বে। ‘আইন’ কিংবা ‘আদালত’ এর দ্বারস্থ হতে গেলেও তো মনে হবে এই শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে এগুলো কেন শুধু মুসলমানের শব্দ হল না? যে কোনও ধর্মের বাঙালি ‘হামেশাই’ তো এই শব্দ প্রয়োগ করেন, ‘কলম’ দিয়ে লেখেন, না লিখলে তো ‘মুশকিল’ হবে। তাহলে কিছু শব্দ, কিছু ডায়ালেক্টকে কেন টার্গেট করা হচ্ছে? শব্দের এমন জাদু, যে তাকে ধর্ম দিয়ে বাঁধা যায় না। কেউ কেউ শব্দের রাজনীতিকরণ করে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু তাতে লাভ হবে না। তাতে তাঁদের অশিক্ষারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে, ভিতরের ঘৃণাটাই বাইরে আসছে, অবশ্য তাঁদের এতে লজ্জা‘শরম’ কিছু হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাঁরা বুক ফুলিয়ে মনের আনন্দে ঘৃণার চাষ করে চলেছেন। যে কি-বোর্ড দিয়ে টাইপ করে অমিত মালব্যের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, সেটাও তো এক মুসলমান বাঙালিরই আবিষ্কার। মেহেদি হাসান, ‘অভ্র’ কী বোর্ডের জনককে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?

মজার ব্যাপার এটাই যে হিন্দি ভাষাতে যে পরিমাণ উর্দু-ফারসি-আরবি শব্দ আছে, তা বাদ দিলে কথা বলার জন্য নতুন কোনও ভাষা খুঁজতে হবে। দিল্লির প্রভুরা তাঁদের ‘পলিসি’ অনুযায়ী হিন্দিপ্রীতি দেখালেও আরবি-উর্দু-ফারসি শব্দগুলি বাদ দিতে পারবেন না এবং তা সম্ভবও না। এই যে ‘সাইয়ারা’ ছবি নিয়ে এত হইচই হচ্ছে– এই শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে? আরবি-উর্দু থেকে এসেছে। তাহলে কী বোঝা গেল? ঘুরেফিরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, ভুল পথে পরিচালিত করে মূলত বাঙালি মুসলমানকেই টার্গেট করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সত্যিকারের বোকা বানানো হচ্ছে বাঙালি হিন্দুকেই। অথচ তাঁরা কিন্তু কেউ মাদ্রাসায় পড়া অশিক্ষিত নয়, তা সত্ত্বেও তাঁরা এটা বুঝছেন না, কিংবা বুঝতে চাইছেন না।

আসল কথা হল বাঙালিকে বিছিন্ন করো, মূল ইস্যু থেকে সরিয়ে রাখো। হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতি জিইয়ে রাখো। সংঘ পরিবারের বিভেদের মন্ত্র সুচতুরভাবে প্রবেশ করালে চাকরিবাকরি, কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি– সব ভুলে যাবে মানুষ। যখন এই SIR এবং NRC নিয়ে সমস্ত ধরনের বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে, তখন তাঁদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করাটাই উদ্দেশ্য। এতদিন জানতাম বাঙালির ‘এক জাতি এক প্রাণ’ হয়ে থাকার চর্চা ছিল। সে উচ্চমানের চিন্তাভাবনায় সমৃদ্ধ ছিল। গো-বলয়ের অশিক্ষা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। এই অনন্য গুণ দিয়ে বাঙালিকে পৃথক করা যেত। বাঙালি এইসব মামুলি ব্যাপারকে ধর্তব্যের মধ্যেও আনত না। মাত্র এক দশক আগেও এসব নিয়ে কেউ ভাবেনি। অথচ আজ বাঙালিকে এসব নিয়ে ভাবানো যাচ্ছে। কে ভাবাচ্ছে? বাঙালির একশ্রেণির লোকজন। যাদের মূল লক্ষ্য এই ভাষার হিন্দু-মুসলমান করে গো-বলয়ের সঙ্গে তফাতটা আরও কমিয়ে আনা যাবে। এমনিতেই গোরক্ষকবাহিনী দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে এই ভাষাতন্ত্র এসে হাজির হলে তো সোনায় সোহাগা।

সমস্ত মৌলবাদীই চায় একটা রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে। মানুষকে তাঁদের মনমতো ঢেলে সাজিয়ে একটা ছকে ফেলতে চায়। ভাষার মৌলবাদীরাও সেটাই চায়, একটাই ভাষা থাকবে। ধর্মীয় নীতির দোহাই দিয়ে সমাজ ও সরকারের সমস্ত বিষয়ে নিজেদের কতৃত্ব ফলানোর নাম যদি হয় ‘ধর্মতন্ত্র’, তাহলে সবাইকে সেই আদলে ফেলে শুধু হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়াকে কি ‘ভাষাতন্ত্র’ বলা যাবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মনে রাখা দরকার, ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক জিনিষ নয়। ও যেন আগুন আর ছাই। ধর্মতন্ত্রের কাছে ধর্ম যখন খাটো হয় তখন নদীর বালি নদীর জলের ওপর মোড়লি করিতে থাকে। তখন স্রোত চলে না, মরুভূমি ধু ধু করে।’

‘গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’-এর দৃশ্য

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো এইরকম কিছুই বলতেন, ভাষা সন্ত্রাস নিয়ে, ‘ভাষাতন্ত্র’ বলে কোনও একটি শব্দও হয়তো সংযোজিত হত বাংলা অভিধানে। সত্যজিৎ রায়, ‘গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’ ছবিতে বোধহয় এই সময়টা দেখতে পেয়েছিলেন, তাই দেখিয়েছিলেন…
‘এ যে সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা
তালেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
ভাষা এমন কথা বলে বোঝে যে সকলে
রাজা উঁচা-নিচা ছোট বড় সমান
মোরা এই ভাষাতেই করি গান
করি গান, মহারাজা তোমারে সেলাম।’

…………………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

…………………………..