স্বাদের স্মৃতি নিয়ে বেশিক্ষণ রগরানো উচিত নয়, বরং রিভিশন দেওয়া উচিত। দেখে নেওয়া উচিত, এই দ্রুত বদলে যাওয়া ভারতে কচুরি-ছোলার ডালটা আগের মতোই আছে তো? তাছাড়া ও-জিনিস সামনে পেলে ইদানীংকালের অতি নিষ্ঠাবান নেতারাও নির্ঘাত অনশন ভেঙে ফেলবেন। এরপর একজোড়া গরম রসগোল্লাই যদি না খাওয়া হয়, তাহলে বাংলায় কথা বলাই উচিত নয় মশাই। এত কনট্রোল ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া কেউ করতে পারেন বলে মনে হয় না। মনে রাখবেন– দেহ সংঘের মতো, প্রতিটি অংশকে সম্মান করতে হয়। সেখানে সংঘাত কাম্য নয়।
পুজো এলেই সযত্নে গড়ে তোলা ভুঁড়িখানা একটু ইস্ত্রি করে সমান-সমান করতে ইচ্ছে করে বাঙালির। নেহাত আগুনের পরশমণি গোছের ছ্যাঁকা পেটে লাগবে, তাই উপায় একটাই: ডায়েট। কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ভারি সিরিয়াস, সারা বছরই ডায়েট করে থাকেন। গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলা ভালো, এতে বিশ্বাস করেন। ফুটবল খেলার থেকে রোজ জিম করা ভালো– এইসব সিরিয়াস গোছের শরীরচর্চারতদের কথা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু এই বৃত্তের বাইরে আর কেউ কেউ আছেন, যাঁরা গীতাপাঠ কিংবা ফুটবল খেলা– দুটোতেই নিমরাজি হয়ে কোথাও একটা এলিয়ে পড়ে জীবনের সারমর্ম টের পেয়ে যান। এবারও নিশ্চিতভাবে পুজোর দিন পনেরো আগে কেউ কেউ টের পেয়েছেন– যাহ শালা! শ্রীভূমির পুজোর উদ্বোধন হব হব করছে, এবার পুজোর আগে ওজন কমানো হল না তো!
বেটার লেট দ্যান নেভার। তবে এই অতিব্যস্ত ল্যাদ-লাইফে জিমে ভর্তি হওয়া বিলাসিতারই সমার্থক। তাছাড়া দিন পনেরোর ক্রাশ কোর্সে কারাই বা ভর্তি নেবে! কে না জানে, ডায়েটের মূল ব্যাপার বাইরের জিনিস বন্ধ। অতএব বাইরের জিমও না। ঘরেই কসরত। সঙ্গে ওই মহার্ঘ ডায়েট! তিনবেলা আধপেটা খেয়ে ৫৫ গ্রাম এবং ১৫ মিলিগ্রাম ওজনের ধসকে স্বাগত। কিন্তু এই মহা যুগসন্ধিক্ষণে দেখবেন, কেউ না কেউ বাগড়া দিতে খাবার নিয়ে হাজির হবেই। হাঁ-গাল আর মধ্যপ্রদেশের বিতণ্ডায় হঠাৎই সেই হাজিরায় বাঙালির নিজেকে পরাজিত সৈনিক মনে হবে, তবে আলেকজান্ডারের কাছে যেমন পুরু– সেইরকমই, তার বেশি না। অনেকসময়ই দেখা যায়, এই মোক্ষম হালে, ভরসন্ধেয় চাইনিজ হাজির। পাড়ার চাইনিজ, মানে ঝুরো চাউমিন। খুন্তিতে বটের ঝুরি। চিনের চেয়ারম্যান আমাদের, অতএব চাউমিনও আমাদের। বিতর্ক এড়াতে আর ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’য়ের দিকে যাচ্ছি না। তবে অন্য চিন্তা হয়, পাড়াতুতো ৯০ শতাংশ দোকানেরই চাউমিন তেল-জবজবে! আমেরিকা এই তেলের গল্প জানে না বলেই রক্ষে, নইলে পারমাণবিক অস্ত্র রাখার ভুয়া অভিযোগ তুলে এসব ভারত থেকে ঝেড়ে দিত। তেল আমেরিকা নিলে নিক, বাঙালি নিক চাউমিন। এই জিনিসকে ‘না’ বলা মানে জিভের সঙ্গে গদ্দারি। আর বিশ্বায়নের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে, পাড়ার দোকান তো ‘ঘরোয়া’ই। আস্ত পৃথিবীটাই ছোট হয়ে হাতের মুঠোয় যখন!
আরও পড়ুন: ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা ইংরেজরা তৈরি করেনি
ডায়েট আর ডায়েটভঙ্গ, যেন দিন-রাত্রির লুকোচুরি। দু’-পাচ মিনিটের ডন-বৈঠক-যোগা। তারপর কোত্থেকে যেন হাজির হয় পেটাই পরোটা-ঘুগনির ব্রেকফাস্ট। ওই যে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন: তেরা এক ঝলক মিল যায়ে তো দিন বন যায়ে। খানার ব্যাপারে ব্যাপারখানা সেইরকমই। তবে মাঝেমধ্যে তেড়ে দৌড়। দৌড় শেষ হয় বাজারে। সকাল-সকাল কচুরি আর ছোলার ডাল! বাঙালির আসলে জিভের কোনও দোষ নেই। সে গাদা গাদা উপাদেয় দুরন্ত সব খাবার যদি চোখের সামনে দেখে, কী করবে বলুন তো! স্বাদের স্মৃতি নিয়ে বেশিক্ষণ রগরানো উচিত নয়, বরং রিভিশন দেওয়া উচিত। দেখে নেওয়া উচিত, এই দ্রুত বদলে যাওয়া ভারতে কচুরি-ছোলার ডালটা আগের মতোই আছে তো? তাছাড়া ও-জিনিস সামনে পেলে ইদানীংকালের অতি নিষ্ঠাবান নেতারাও নির্ঘাত অনশন ভেঙে ফেলবেন। এরপর একজোড়া গরম রসগোল্লাই যদি না খাওয়া হয়, তাহলে বাংলায় কথা বলাই উচিত নয় মশাই। এত কনট্রোল ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া কেউ করতে পারেন বলে মনে হয় না। মনে রাখবেন– দেহ সংঘের মতো, প্রতিটি অংশকে সম্মান করতে হয়। সেখানে সংঘাত কাম্য নয়।
ক’দিনের কসরতেই বাঙালির মনে হয় এত ব্যায়ামট্যায়াম হচ্ছে, খাওয়াটাও বাড়াতে হবে। নইলে কেমন দুবলা লাগছে! ক্রমে পুজো উপস্থিত, তায় বিশ্বকাপের মরশুম। বেরব না বেরব না করে গোঁ ধরা বাঙালি আজকাল মণ্ডপে না গেলেও বাড়ির বাইরে পা ঠিক ফেলেই। ‘ঠেকে শেখার কথা’ সেই চুয়ার বিদ্রোহের সময় থেকেই কত না মানুষ বলেছেন! মুচমুচে চিকেন ফ্রাই। কাবাব। আর অলৌকিক জলযান। ওদিকে পুরুতমশাই বসেন পূজায়, এদিকে লিকার খেয়ে ডিগবাজি যায় হাল।
আরও পড়ুন: হাংরি আন্দোলনের সালতামামি
অতএব বাড়ি ফিরে অনুশোচনা। একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছে। আগামিকাল এক্কেরে ঘরের খাবার। নইলে ওজনোস্ফিয়ারে বিস্ফোরণ রুখবে কে! কথার খেলাপ করলে সে তো রাজনৈতিক নেতা। সে অনর্থ হতে দেওয়া যায় না। কিন্তু কোথায় কী! দুম করে নিজতুতো, মাসতুতো, পিসতুতো, পাড়াতুতো কোনও বদ চোখের সামনে রোলে কামড় দিতে দিতে হাজির হবে ঠিক। সেই সুগন্ধ নাকে সুড়সুড়িও দেবে। মনে মনে বাঙালি তখন ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো ‘হতভাগা, বেল্লিক’ বলবে বটে, কিন্তু একখানা রোলে কামড়না বসালে তার মনে হবে জীবনটা স্রেফ জীবনবিজ্ঞান, সাহিত্য-টাহিত্য নেই। অতএব জোমাটো কিংবা পাড়ার দোকান– ঝটপট কাগজের আবরণ সরিয়ে কামড়! ডিম, চিকেনের ককটেল! পেঁয়াজকুচি-লঙ্কার দুরন্ত পার্টনারশিপ। আহা স্বর্গ!
রোল খাওয়া ব্যক্তির রোলে সে সন্ধেয় দারুণ পারফর্ম করে বাঙালি। রোল, ঝালমুড়ি, আদা দেওয়া চা, আর তৎসঙ্গে বিশ্বকাপের টানটান উত্তেজনার ম্যাচ। এর মধ্যেই যদি কানাঘুষো শোনা যায় নৈশভোজে চিংড়ির মালাইকারি। সঙ্গে বেড়ে আইটেম, ধরে নেওয়া যাক– মুগডাল, ঝুরো আলুভাজা, স্যালাড, বাড়তি ভাত। সে খ্যাঁটনপর্বও যেন একটা দুরন্ত ইনিংস। তবে হতভাগা বাসি ও ন্যাদস গোছের কোনও একটা সবজিটাকে হালকা করে ডাক করতে হবেই।
আরও পড়ুন: ধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট
দু’দিন যখন ঘটেই গিয়েছে, তখন আর চিন্তা নেই। দু’দিন খাওয়া, দু’দিন ডায়েট। কে না জানে, জগৎ তো ভারসাম্যতেই চলছে। তবু ভোগের খিচুড়ি আসে, সেই জাগতিক মায়া ত্যাগ করে খানিকটা তো খেতেই হয়। সন্ধেবেলা মন খচখচ করে। ফলে আড্ডা। সকালের ভোগের খিচুড়ি তো প্রসাদ, প্রসাদের খাবার কখনও গায়ে লাগে না। ও ডায়েটরই ভগ্নাংশ। ফলে সান্ধ্য আড্ডায় হাজির বাইরের খাবার। বাটার চিকেন, চিকেন ভর্তা, মাটন চাপ, তন্দুরি-রুমালি রুটিতে মাখামাখি। একটু কাঁচালংকার ঝালের আমেজ, সুড়ুৎ করে ঝোল টেনে নেওয়া। পুজোর আড্ডা না খাদ্যমেলা বোঝা দায় বটে!
নবমীতে এই ডায়েট-ব্যর্থ বাঙালি দেখবেন ঠিক রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যাবে। কলকাতার প্রসিদ্ধ বিরিয়ানির আখড়ায় না হলেও, পাড়াগাঁয়ের শান্ত-নিবিড় বিরিয়ানি নিকেতনে সে যাবেই। মুখোমুখি বসে, একটু চোখাচোখি হবে। আলুর পিসটা ড্যাবড্যাব চেয়ে থাকবে সেই পেটুক বাঙালির দিকে। এদিকে আশা ভোঁশলে গাইছেন, ‘আও হুজুর…।’ বিরিয়ানির প্লেটের তলা থেকেই যেন সেই গান ভেসে আসছে। জিভের ডগায় বিরিয়ানির স্বাদ। মাংসের পিসটা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কেটে পেটে চালান করতেই একটা বিষয় স্পষ্ট হবে, খাসিটা জীবদ্দশায় খুব নরম প্রকৃতির ছিল।
এভাবে বিসর্জন কাটে, একটু জলপথে ভ্রমণ, একটু মিষ্টিমুখ। পুজোও অবশেষে ফুরায়ে যায়! ওজনখাতা মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, ওজন কমাতে গিয়ে উল্টে বেড়ে গেছে! কী আর করা যাবে! ভগবান যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ছানাপোনা নিয়ে মা বছরে একবারই আসেন, সেই আনন্দের দিনগুলোয় আধপেটা খাওয়া কি মানায়?
যাই হোক, আগামী পুজোয় অন্ততপক্ষে দু’মাস আগে ওজন কমানোর চেষ্টা করতে হবে। হবে না হয়তো, কিন্তু লেগে থাকতে হবে। পেটের দিকে থাকা জামার বোতামের যেন কষ্ট না হয়– এই বলে আপাতত প্রবল খাওয়া ও প্রবেল ডায়েট দুয়ের থেকেই বিরতি নেয় বাঙালি।