Robbar

‘বাংলাদেশি’ শব্দের আড়ালে ভারতীয় বাঙালির উপরই নেমে আসছে অত্যাচার

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 28, 2025 8:00 pm
  • Updated:July 29, 2025 2:08 pm  
Bengali speaking citizens are being harassed in india

অভূতপূর্ব ভাষা-অত্যাচারে সেরার সেরা হয়ে উঠছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। দেশের পরবর্তী আদমশুমারিতে অসম রাজ্যের কোনও বাসিন্দা বাংলাকে নিজের ‘মাতৃভাষা’ উল্লেখ করলে তাঁকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে– এমনটাই তাঁর আদেশ। এতে নাকি সেই তথ্য দিয়ে অসমে বসবাসকারী মোট বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে। তিনি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, তাঁর অন্যতম লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা ধরে নিতে পারি, অসমে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানের শিয়রে শমন হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন সেই রাজ্যের বিজেপি পরিচালিত সরকার।

শুভাশিস চক্রবর্তী

‘আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সেই বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি হয়ে যেতে হবে!’– তীব্র ক্ষোভ, অসহায়তা, অস্তিত্বের সংকটের আশঙ্কা ঝরে পড়ছিল নাজিমুল সর্দারের গলা থেকে। সুদর্শন যুবক। বনগাঁর বাসিন্দা। হরিয়ানায় কাজের সূত্রে থাকা। তাঁকে ১৯ জুলাই পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। বারবার পুলিশ জানতে চায়– কবে সে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছে? নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়েও রেহাই মেলেনি। নাজিমুলকে থাকতে হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে জেরার নামে অকথ্য গালিগালাজ, রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা– শারীরিক অত্যাচার বাদে বাকি যা কিছু করণীয়, সব‌ই করেছে হরিয়ানা পুলিশ।

If NRC is deployed across India, how will you prove your citizenship? - Are you an Indian? | The Economic Times

মালদহের আমির শেখকে পে-লোডারে উঠিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে বাংলাদেশের সীমান্তে কার্যত ছুড়ে ফেলেছে বিএসএফ-এর তৎপর ‘দেশব্রতী’রা– এই অভিযোগে উত্তাল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আমির শেখের বাড়ি কালিয়াচকে, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে তিনি রাজস্থানে কাজ করছিলেন। সেখানকার পুলিশের অভিযানে তাঁকে বাংলাদেশি সন্দেহে দুই মাস ধরে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বিনা অপরাধে জেলবাসের পর হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে পে-লোডারে চড়িয়ে ‘পুশব্যাক’ করার এই ছবি কল্পনা করলে গা শিউরে ওঠাই স্বাভাবিক। এখানেই শেষ নয়, বিবস্ত্র করে তল্লাশি বা ভয়ানক মারধরের সংবাদ রোজ‌ই পড়তে হচ্ছে আমাদের।

চাঁচলের মহম্মদ নাসিম, দক্ষিণ দিনাজপুরের রমজান আলি চৌধুরী, উত্তর ২৪ পরগনার পারভিনা খাতুন, কোচবিহারের মোজাফফর মিঞা ও হালাল মিঞা– এরা কেউ বিদেশি নন। প্রথম পরিচয় ভারতীয়, তারপর তাঁদের জোরালো অস্মিতা– তাঁরা বাঙালি। হ্যাঁ, ভারতীয় বাঙালি। কয়েক পুরুষ ধরে এই পশ্চিমবঙ্গের জল, মাটি, হাওয়া তাঁদের লালন করেছে। এক‌ই বৃন্তে দু’টি কুসুম নিয়ে যে মিডিয়া, যে বশংবদ সংবাদকুশলী যা বলেই থাকুক না কেন– এই মানুষগুলো বিশ্বাস করেছে ধর্ম নয়, মাতৃভাষা আমাদের প্রথম পরিচয় তৈরি করে দিয়েছে। মাতৃভাষার বৃন্তে দু’টি নয়, তার‌ও অধিক পুষ্প বিকশিত থাকে এই রাজ্যে। গর্বের সঙ্গে তাই এতদিন বলে এসেছে: ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা’।

India renders 4 million people in Assam without citizenship - Vatican News

সেটাই যেন এই শ্রমিক ভাই ও বোনেদের জীবনে নিয়ে এসেছে চরম অভিশাপ। কাজের জন্য হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র রাজস্থান, অসম, ওড়িশায় তাঁরা কেউ কেউ আছেন ২০ বছরের‌ও বেশি সময় ধরে। সঙ্গে আছে বৈধ পরিচয়পত্র। তবুও তাঁরা চূড়ান্ত হেনস্তার শিকার। সর্বোপরি কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজভূমে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন এমন শত শত ভারতীয় বাঙালি নাগরিক! কাজ হারিয়ে এখন তাঁরা কার্যত বেকার। কীভাবে সংসার চলবে, কীভাবে পেটের ভাত উপার্জন করবেন তাই ভেবে কূল পাচ্ছেন না নিম্নবিত্ত মানুষগুলি।

এই অভূতপূর্ব ভাষা-অত্যাচারে সেরার সেরা হয়ে উঠছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। দেশের পরবর্তী আদমশুমারিতে অসম রাজ্যের কোনও বাসিন্দা বাংলাকে নিজের ‘মাতৃভাষা’ উল্লেখ করলে তাঁকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে– এমনটাই তাঁর আদেশ। এতে নাকি সেই তথ্য দিয়ে অসমে বসবাসকারী মোট বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে। তিনি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, তাঁর অন্যতম লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা ধরে নিতে পারি, অসমে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানের শিয়রে শমন হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন সেই রাজ্যের বিজেপি পরিচালিত সরকার।

This nation is made with our blood, not some paper: Anti-CAA, NRC protest hits Kolkata Derby | Football News - The Indian Express

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট কথা হচ্ছে। ‘ভারত সরকার সম্প্রতি অবৈধভাবে শত শত বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে পুশইন করছে’– এমনটাই অভিযোগ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটির দাবি, এসব মানুষকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। নিউ ইয়র্কের এই সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছে, রীতিমতো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এই বাঙালি মুসলিমদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ এঁরা অনেকেই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলোর কয়েক প্রজন্মের বাসিন্দা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতের শাসক দল বিজেপি নির্বিচারে বাঙালি মুসলিমদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে বৈষম্যের আগুনে ঘি ঢালছে; এমনকী যাঁরা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক, তাঁরাও বাদ পড়ছেন না। সংস্থাটির এশিয়া শাখার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেছেন, ‘‘যেভাবে সরকার ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ ঠেকানোর কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ এতে তারা ন্যূনতম আইনগত অধিকার বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডও মানছে না।” এই সংস্থা গত জুন মাসে নয়টি ঘটনার ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের ১৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন এমন ভারতীয় নাগরিকরাও, যাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে তারা আবার ভারতে ফিরে আসেন। সংস্থার পক্ষ থেকে গত ৮ জুলাই এ বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও কোনও সাড়া মেলেনি।

This may contain: two women holding up signs in front of a group of people with their mouths open

হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের অভিপ্রায়ে এই দুর্বুদ্ধির উদয়, এই নিয়ে কার‌ও মনে সংশয় থাকার কথা নয়। নেই‌ও। তা না হলে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা করা হচ্ছে তাঁরা কেন শুধুই একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ হবেন! এই দেশে মুসলমানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলাটাই যদি রাষ্ট্রের একমাত্র ‘কাজ’ হয় তবে গণতন্ত্রের পক্ষে তা শুভ হতে পারে না। আশার আলো একটাই, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাদের ইদানীং কালের নানা কাজ নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ইতিবাচক। প্রত্যাশার থেকেও অধিক। আর তার সঙ্গে যোগ করতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় প্রতিরোধ-প্রতিজ্ঞার কথা। এগুলিকে আশা বলা হচ্ছে এই কারণে, পুরো বিষয়টি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। ভাষা ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এই দেশের ভোটতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। সেই অস্ত্রের ধার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে। তাই রাজনীতি দিয়ে তাকে প্রতিরোধ না করলে খুব দ্রুত বাঙালিকে আর‌ও একটি রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথে নামতেই হবে। সেই আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান পাশে পাবে বাঙালি হিন্দুকে– এটা জানান দেওয়ার সময় আসন্ন।