Robbar

প্রচ্ছদ থেকে শিক্ষা নিলে তো মিশনের বই দেখেই মানুষ সন্ন্যাসী হয়ে যেত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 10, 2025 4:59 pm
  • Updated:December 10, 2025 4:59 pm  

যে ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটেছে, অরুন্ধতী রায়ের ‘মাদার মেরি কাম্‌স টু মি’, বইটার প্রচ্ছদে লেখকের ধূমপানের ছবি থাকায় আদালতে মামলা হয়েছে– এ ঘটনাটি নিঃসন্দেহে হাস্যকর। প্রচ্ছদ কি এভাবে মানুষের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে? তাহলে তো বলতে হয়, উদ্বোধন কার্যালয় থেকে যে সব বই বেরয়– তার প্রচ্ছদে যে ধ্যান করার ছবি থাকে, তার মানে, সেই বই পড়ে সবাই ধ্যান করতে শুরু করবে! তেমন হয় কি? প্রচ্ছদ দেখে কি মানুষ শিক্ষা নেয়? তা হলে এত ইশকুল-কাছারি রয়েছে কেন! রামকৃষ্ণ মিশন তো নিয়মিত বই বের করেন। তাঁদের প্রচ্ছদ দেখে মানুষ যদি সত্যিই শিক্ষা নিত, তবে সাধু-সন্ন্যাসী বেড়ে যেত কলকাতায়।

অজয় গুপ্ত

‘মাদার মেরি কাম্‌স টু মি’। লেখিকা অরুন্ধতী রায়। সম্প্রতি বইটিকে নিয়ে বেশ একচোট বিতর্ক হয়ে গেল। বিতর্ক হল বইটির প্রচ্ছদ নিয়ে, প্রচ্ছদে ছাপা তাঁর একটি ছবিকে ঘিরে। কেন? কারণ সেই ছবিতে তিনি ধূমপান করছেন। বইয়ের প্রকাশক অবশ্য এ বিষয়ে একটি সতর্কীকরণ বার্তা দিয়েছেন। বইটির ব্যাকফ্ল্যাপে। তবু অভিযোগ উঠেছে, এই ছবি বিড়ি-সিগারেট খাওয়াকে প্রোমোট করছে। যুবসমাজ, বিশেষত কিশোরীদের (লেখক যেহেতু মহিলা) ধূমপানে মদত দিচ্ছে।  এবং এই প্রচ্ছদ COTPA-র নিয়ম অমান্য করেছে।

‘প্রচ্ছদ’ কথাটাকে একটু ভেঙে লিখলে দাঁড়ায় ‘পরিচ্ছদ’। আমরা যেমন জামাকাপড় পরি আর কী! বইয়ের মলাটও তো সেইরকম। বইয়ের মুখ। একজন প্রচ্ছদশিল্পী যখন প্রচ্ছদের ডিজাইন করেন, আলাদা আলাদা করে প্রথম থেকে চতুর্থ– সবক’টি প্রচ্ছদই তাঁকে করতে হয়। প্রথম প্রচ্ছদ অর্থাৎ বইটা সামনে তুলে ধরলে যেটা দেখা যায়, সেটাই প্রধান। চতুর্থ প্রচ্ছদেও অনেক সময় তার কন্টিন্যুয়েশন রাখা হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রচ্ছদে সাধারণত মূল প্রচ্ছদের রংটাকেই রাখা হয়; কিংবা হয়তো একটা অন্য রঙে সেটা রাখা হল, অথবা সেখানে কিছু লেখা থাকতে পারে, বই সম্পর্কে একটা পরিচয় থাকতে পারে। সেটা প্রকাশক বা লেখক দেখেন, প্রচ্ছদশিল্পীর সেখানে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু প্রথম প্রচ্ছদ যেটা, অর্থাৎ যেটাকে আমি ‘পরিচ্ছদ’ বলছি, সেটা তো প্রকাশক কিংবা শিল্পীর যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে হতে পারে।

ছাপাখানার ইতিহাস শুরু হয়েছিল সেই বটতলা থেকে; এবং তখনকার ছাপাছাপি হত কাঠের ব্লক দিয়ে– কাঁঠালগাছের কাঠের উপর আগে উল্টো করে ছবিটা আঁকা হত নরুন দিয়ে কুঁদে, কত নিখুঁতভাবে করতেন সেই খোদাইশিল্পীরা। এখনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোনও কোনও বিশেষ বইতে সেই পদ্ধতিতে ছাপাছাপি দেখা যায়। ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতীর কথা’য় ওরকম কাঠের ব্লক ব্যবহার হয়েছে। তখনকার দিনে প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে অনেক টেকনিক্যাল সীমাবদ্ধতা ছিল। আবার বিশ্বভারতীর বইপত্রের প্রচ্ছদ– রবীন্দ্রনাথের কাছে তো নন্দলাল, রামকিঙ্কর এমন অনেক শিল্পীই ছিলেন– কিন্তু তিনি তাঁদের ব্যবহার না করে বোলপুরের মাটির রঙের প্রচ্ছদে বইপত্র করলেন। সেই প্রচ্ছদ কিন্তু বহুকাল চলেছে, এখনও চলছে। অর্থাৎ যেকথা বলতে চাইছি, বইয়ের প্রচ্ছদ কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকাশকের ইচ্ছেমতো হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিল্পীর ইচ্ছেমতো।

বটতলার ছাপাইচিত্র

প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে বইয়ের বিষয়বস্তু একটা বড় বিষয়। কোন বইয়ের প্রচ্ছদ হচ্ছে– সেটা গল্পের, না প্রবন্ধের, না কবিতার তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। আমাদের বাংলা বইয়ের বাজারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাওয়াই যায় না। একমাত্র সাহিত্য অ্যাকাডেমি ছাড়া অন্য কেউই আমায় প্রচ্ছদ করার আগে বই পড়তে দেয়নি। এমনও হয়েছে যে, টেলিফোনে কেবল বইয়ের নামটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা যে কীসের বই তাও বলেনি।

আমি তো সেই অর্থে ‘আঁকিয়ে’ নই। আমি মলাট আঁকি, তা-ও দায়ে পড়ে। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প আছে না– ‘দায়ে পড়ে দারগ্রহণ’– আমার অবস্থাও সেইরকম। কলেজে যখন পড়তাম তখন একটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, ‘মানস’ নামে, ত্রৈমাসিক পত্রিকা। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ভাই, শঙ্কর নন্দী, উনি একটা ব্রাশে টেনে ‘মানস’ শব্দটা সুন্দর করে লিখে দিয়েছিলেন। এখন লিটল ম্যাগাজিনে তো কাউকে টাকাপয়সা দেওয়া হয় না। লেখকরাই পায় না, প্রচ্ছদশিল্পী তো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই ধীরে ধীরে বইপত্রের প্রচ্ছদ করা শুরু করলাম।

শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের করা প্রচ্ছদ

আমার বন্ধু ছিল শিল্পী পৃথ্বীশ গাঙ্গুলি। সে মূলত শিল্পীই ছিল। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে পরে গোলমাল করে ছেড়ে দিয়েছিল। পৃথ্বীশ আমাকে প্রচ্ছদ করার বিষয়ে খুব প্রেরণা দিয়েছিল। সে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করত। আমরা যখন একসঙ্গে স্কটিশচার্চ স্কুলে পড়তাম, অনেক সময়েই ট্রামলাইনের ওপর বোতল ফেলে রেখে গুঁড়ো করে, তার ছাপ তুলে নানারকম কিছু করার চেষ্টা করত। প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে অনেকরকম নতুন কাজ পৃথ্বীশ করে দেখিয়ে গিয়েছে। আরেকটা মজার জিনিস পৃথ্বীশ আমায় শিখিয়েছিল। প্রকাশকরা কখনওই একটা প্রচ্ছদে খুশি হন না। বেশ কয়েকটা করে রাখতে হবে। একটা পছন্দ না হলেই অন্যটা দেখিয়ে দিতে হবে। 

প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে আমাকে বিস্মিত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর একটা কাজ ছিল, মনে পড়ছে, ‘দেবী’ ছবির পোস্টার। ‘দেবী’ শব্দটার লেটারিং যে ওইভাবে করা যায়, সেটা উনিই ভাবতে পারতেন। লেটারিং করার ক্ষেত্রে আমি লক্ষ রাখি, কতগুলো অক্ষরে মাত্রা আছে, কতগুলো অক্ষরে নেই। ‘এক্ষণ’ নামে একটা পত্রিকা আছে, এই শব্দটার একটা অসুবিধে হচ্ছে ‘ক্ষ’ বাদে বাকি অক্ষরদুটোয় কোনও মাত্রা নেই। সেই অসুবিধেটাকেই বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে সত্যজিৎ রায় কীভাবে অপূর্ব সব প্রচ্ছদ করেছেন! এটা কিন্তু সকলের দ্বারা হত না।

সত্যজিৎ রায়ের করা ‘এক্ষণ’ পত্রিকার প্রচ্ছদের লেটারিং

এঁদের কাজ দেখেই আমার কাজ শেখা। আমি তো আঁকতে জানি না। আমি যেটা করতাম– বইটা কী সেটা জানতে পারলে, বইয়ের ভেতরের বিষয়বস্তুটা যাতে বাইরের মলাটটা দেখলেই একবারে পাঠক বুঝতে পারেন, সেইটা ফুটিয়ে তুলতে চাইতাম। সবটা তো বোঝানো যায় না, অন্তত আমার মনেরব প্রচ্ছদে বইয়ের মূল কথাটুকু যা ফুটিয়ে তুলছে– সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটাই তো মলাটের উদ্দেশ্য। বিষয়বস্তুটাকে ফুটিয়ে তোলা। প্রকাশকেরও এখানে একটা বড় ভূমিকা থাকে। থাকা উচিত বলে অন্তত আমি মনে করি। কোন সাইজ, কোন আকারে বই হচ্ছে সেটা যদি আগে থেকে জানানো হয়, তাহলে প্রচ্ছদশিল্পীর সুবিধে হয়। তখন বিজয়বাবু ছিলেন, আমি তিনটে রঙের বেশি উঠতে পারতাম না, উনি রং মিশিয়ে অদলবদল করে অনেকরকম রং তৈরি করে দিতেন। ওঁর দেখে দেখে আমিও করার চেষ্টা করতাম। কখনও হত, কখনও হত না। এভাবেই আমার প্রচ্ছদের কাজ শেখা।

আমি মূলত প্রবন্ধ, কবিতা, সংকলন এইসব বইয়েরই প্রচ্ছদ করতাম। উপন্যাসের প্রচ্ছদ করতাম না। একবারই করেছিলাম, নবনীতার (দেবসেন) একটা বইয়ের প্রচ্ছদ। খুব পীড়াপীড়ি করেছিল, তাই। তারপর প্রচ্ছদ হওয়ার পর আমায় জিগ্যেস করেছিল, এর চেয়ে খারাপ প্রচ্ছদ আমি আর করেছি কি না! তারপর থেকে আমি আর উপন্যাসের প্রচ্ছদ করি না।

যাই হোক, প্রকাশক যদি প্রচ্ছদের বিষয়ে আলাদা করে কোনও নির্দেশ না দেন, তবে প্রচ্ছদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব শিল্পীর। তিনিই আঁকবেন, লে-আউট ভাববেন। কিন্তু সেই লে-আউট প্রকাশকের পছন্দ না-ও হতে পারে, সেক্ষেত্রে তিনি বলতেই পারেন, ‘আরেকখানা আঁকুন’। তখন কিন্তু শিল্পীকে আরেকখানা প্রচ্ছদ বানাতে হবে।

সাধারণত প্রকাশক বা লেখক প্রচ্ছদে রং পছন্দ না হলে বদলাতে বলেন। কেউ হয়তো ডিজাইন বদলাতে বললেন। কিন্তু এরকম আপত্তি আমি নিজে অন্তত কখনও শুনিনি। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, মনে আছে। কলকাতার শেরিফ ছিলেন তখন অমিয় গুপ্ত। ‘যুগান্তর’ পত্রিকা থেকে প্রকাশিত বিবেকানন্দ বাবুর একটা বইতে ম্যাপ এঁকে দিয়েছিলাম। ওঁরা বাড়িতে চেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি রিফিউজ করেছিলাম। কারণ কাজটা ওঁদের ভালো লাগেনি। আরেকবার, অম্বুজ বসুর একটি বই, জীবনানন্দ বিষয়ক– ‘একই নক্ষত্র আসে’, ওঁরা প্রচ্ছদটা পছন্দ করেননি। আমি ছবিটা ফেরত নিয়েছিলাম, এবং জানিয়েছিলাম যে এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

আবার একটু অন্যরকম আরেকটা ঘটনাও বলি। নিতাই ঘোষ নামে আমার এক বন্ধু ছিলেন। অনেককাল আগের কথা, তখন শ্যামবাজারের মোড়ে একটা কফিহাউস ছিল। সেখানে আমরা মাঝেমাঝে বসতাম। নিতাই উপন্যাসের প্রচ্ছদ করত। ও একটা কথা খুব বলত। বলত, ‘বলুন তো আর কতকাল ধরে মেয়েদের মুখ আর বুক আঁকব!’ আসলে প্রকাশক বলে দিতেন, এই ধরনের বই হবে, একটু রগরগে করে আঁকতে হবে।

তবে অরুন্ধতী রায়ের ‘মাদার মেরি কাম্‌স টু মি’ নিয়ে যে আদালতে মামলা হয়েছে– এ ঘটনাটি নিঃসন্দেহে হাস্যকর। প্রচ্ছদ কি এভাবে মানুষের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে? তাহলে তো বলতে হয়, উদ্বোধন কার্যালয় থেকে যে সব বই বেরয়– তার প্রচ্ছদে যে ধ্যান করার ছবি থাকে, তার মানে, সেই বই পড়ে সবাই ধ্যান করতে শুরু করবে! তেমন হয় কি? প্রচ্ছদ দেখে কি মানুষ শিক্ষা নেয়? তা হলে এত ইশকুল-কাছারি রয়েছে কেন! রামকৃষ্ণ মিশন তো নিয়মিত বই বের করেন। তাঁদের প্রচ্ছদ দেখে মানুষ যদি সত্যিই শিক্ষা নিত, তবে সাধু-সন্ন্যাসী বেড়ে যেত কলকাতায়।

আমার ৮৭ বছর বয়েস এখন। পড়াশোনা এখন আর তেমন করা হয় না, কিন্তু প্রচ্ছদ তো দেখি টুকটাক। ভালোমন্দ বিচারও করি। কিন্তু এই ৮৭ বছরের জীবনে আমার কখনও মনে হয়নি যে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে চরিত্রগঠন করব। এ-ও যেমন হয় না, তেমন দেওয়ালে দেওয়ালে ‘মদের নেশা ছাড়ান’ পোস্টার মারলেই কেউ নেশা ছেড়ে দেয় না। বইয়ের প্রচ্ছদ তো মূলত বইয়ের ভেতরের বিষয়টাকেই তুলে ধরে। ফলে প্রচ্ছদে অনেক সময়েই এমন চরিত্ররা আসে– ধূমপান বা মদ্যপান যাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য। শার্লক হোমস কিংবা কিরীটী, এমনকী ব্যোমকেশের প্রচ্ছদেও পাইপ কিংবা সিগারেট এসেছে বারবার। যে বয়সের পাঠক এই বইগুলো পড়ে, তাদের শিক্ষার কথা ভাবলে তো এই প্রচ্ছদগুলো রাখাই যাবে না। আসলে এই বিষয়টা তর্ক করার মতো কোনও বিষয়ই নয়। কাজ না থাকলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ বা সময় থাকলে মানুষ এইসব করে। সুপ্রিমকোর্ট যে এই অভিযোগটি খারিজ করেছে এবং অভিযোগকারীকে ভর্ৎসনা করেছে– তাতে আমি আনন্দিত।