১৯৮০ সাল থেকে কাশ্মীরে সরকার ও সরকার বহির্ভূত এজেন্সির দ্বারা যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, কমিটি তার শুনানি ও বিচার করবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যবাদ অবসানের পর নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৬ সালে এইরকম একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি তৈরি করেছিলেন। যে কমিটিতে কালো ও সাদা দুই বর্ণের মানুষ অকপটে তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছিলেন। কালো মানুষরা তাঁদের ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সাদা মানুষরা এসে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে তারা অচ্যাচার করতে বাধ্য হয়েছিল। কমিটি শেষ পর্যন্ত সাদা মানুষদের ক্ষমা করে দিয়েছিল। সমাজের ক্ষত মেরামত হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট কাশ্মীরেও সেই ক্ষত মেরামতে উদ্যোগী হতে চায়।
সংবিধানে ৩৭০ ধারার পাশে ফুটনোট দিয়ে লেখাই রয়েছে যে, এটি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতি এই ধারা প্রয়োগ করবেন। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ সংবিধানের এই ফুটনোটকে হাতিয়ার করেই রায় দিল যে, ১৯৫৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে ৩৭০ ধারাও বাতিল হয়ে গিয়েছে। দেশের প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় রায়ে লিখেছেন, ৩৭০ ধারার দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত এটি একটি উত্তরণের সময় অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা ছিল। রাজা হরি সিং ও ভারত সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’-এ যে বিষয়গুলি বলা ছিল না, সেগুলি নিয়ে সিদ্ধান্তর জন্য এই ধারা তৈরি হয়। যতদিন না জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভা ভারতের সংবিধানকে স্বীকৃতি না দিচ্ছিল, ততদিন এই ধারার কার্যকাল ছিল। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই ধারা যুক্ত করা সংবিধানে।
আরও পড়ুন: চিকিৎসকরা পরিষেবা বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না কেন?
এই ধারার জন্মের সাত দশক পর দেশের শীর্ষ আদালতের আরও নিদান, ভারতে সংযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব চলে গিয়েছে। হরি সিংয়ের পুত্র যুবরাজ করণ সিং ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর একটি ঘোষণাপত্র দিয়ে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’-এর অষ্টম অনুচ্ছেদে বর্ণিত সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করেছিলেন। ৩৭০ ধারায় সার্বভৌমত্ব প্রদানের কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না। এতে ছিল অসংগতিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য।
১৯৪৭ সালে যখন ৫৬২টি রাজন্যশাসিত রাজ্য ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে রাজি হল, তখন জুনাগড় ও হায়দরাবাদের সঙ্গে বেঁকে বসেছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজা হরি সিং-ও। পাকিস্তান হামলা চালানোর পর হরি সিং ভারতের নিরাপত্তার বিনিময়ে শর্তসাপেক্ষে কাশ্মীরকে জুড়তে রাজি হয়েছিলেন। হরি সিংয়ের সঙ্গে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’ স্বাক্ষর করে ভারত। শীর্ষ আদালতে আবেদনকারীদের বক্তব্য ছিল, জম্মু ও কাশ্মীর অন্য রাজ্যগুলির মতো ভারতে মেশেনি। ওটা ‘মার্জার’ ছিল না। সীমিত সার্বভৌমত্ব নিয়ে হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে জুড়েছিলেন। কাশ্মীরের সেই সীমিত সার্বভৌমত্বই সংবিধানের ৩৭০ ধারার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। এখন প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর কি ৩৭০-এর স্থায়িত্ব ও সীমিত সার্বভৌমত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক চিরতরে বন্ধ হবে?
সংবিধানের ৩৭০ ধারা হল এমন একটি ধারা, যা নিজেই নিজেকে প্রয়োগ করেছিল। কীভাবে ধারাটি রদ হবে তাও ধারাটিতেই বলা রয়েছে। তাই এই ধারাকে প্রয়োগ করেই কেন্দ্র কাশ্মীরে ৩৭০ রদ করতে পেরেছে। ৩৭০ ধারা রদ করার উদ্দেশেই ২০১৮ সালে বিজেপি পিডিপি সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পথ প্রশস্ত করে। ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতির ডিক্রি জারি করে কেন্দ্র, যখন ৩৭০ ধারাকে রদ করে তখন আর জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কারণ, জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারটাই তখন চলছে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে। সুপ্রিম কোর্টে প্রশ্ন উঠেছিল, রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যে ৩৭০ ধারা রদের সিদ্ধান্ত কি বৈধ? আদালত জানিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রপতি শাসন জারির মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈধতাকে বিচার করার প্রয়োজনই নেই, কারণ রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বৈধতাকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
রাষ্ট্রপতি ৩৭০ ধারা রদ করার সঙ্গে সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠনের নির্দেশ জারি করেছিলেন। যার জেরে লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে অবনমন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩ নম্বর ধারা প্রয়োগ করেছেন। রাষ্ট্রপতির এই কাজকেও বৈধ বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ৩ নম্বর ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাজ্য পুনর্গঠনের সময় রাষ্ট্রপতি রাজ্য বিধানসভার সুপারিশ গ্রহণ করবেন। কিন্তু সেটা সুপারিশই। সংসদ তা মানতে বাধ্য নয়। যেহেতু জম্মু ও কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে রাজ্যের পরামর্শ গ্রহণের অর্থ নেই। সংসদের মতই রাজে্যর মত বলে ধরা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তবে্য সিঁদুরে মেঘ দেখছে রাজনৈতিক মহল। আশঙ্কা, এ বার সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত সামনে রেখে কেন্দ্র তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে যখন-তখন যে কোনও রাজ্য পুনর্গঠন করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে সহজে সেই কাজ সেরে ফেলা যাবে।
আরও পড়ুন: ‘রিজ’ কি ইংরেজি ভাষা এতদিনে জানল?
সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে, ২০২৪-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচন সেরে ফেলতে হবে। তার আগেই দেশে লোকসভা ভোট সম্পন্ন হয়ে যাবে। কেন লোকসভা ভোটের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচন হবে না, তার কোনও জবাব নেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। ভোটের আগে জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতেও বলেনি সুপ্রিম কোর্ট। যদিও কোর্টে সলিসিটর জেনারেল অাশ্বাস দিয়েছেন, দ্রুত রাজে্যর মর্যাদা পাবে জম্মু ও কাশ্মীর।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি সহমত হয়ে এই রায় দিলেও, রায়টি তিনটি ভাগে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কিষান কল দু’টি আলাদা রায় পাঠ করেছেন। বিচারপতি কল কাশ্মীরি। তিনি তাঁর রায়ে কাশ্মীরের জন্য একটা সত্যানুসন্ধান কমিটি গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। ১৯৮০ সাল থেকে কাশ্মীরে সরকার ও সরকার বহির্ভূত এজেন্সির দ্বারা যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, কমিটি তার শুনানি ও বিচার করবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যবাদ অবসানের পর নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৬ সালে এইরকম একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি তৈরি করেছিলেন। যে কমিটিতে কালো ও সাদা দুই বর্ণের মানুষ অকপটে তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছিলেন। কালো মানুষরা তাঁদের ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, অভিযুক্ত সাদা চামড়ার মানুষরা এসে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে তঁারা অত্যাচার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কমিটি শেষ পর্যন্ত সাদা চামড়ার মানুষদের ক্ষমা করে দিয়েছিল। এতে দু’দলের দূরত্ব কমে। সমাজের ক্ষত মেরামত হয়। সুপ্রিম কোর্ট কাশ্মীরেও সেই পথে ক্ষত মেরামতে উদ্যোগী হতে চায়।
কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, ৩৭০ ধারা রদ কি কাশ্মীরে আরও অশান্তির পথ প্রশস্তই করল না? বাস্তবে ৩৭০ ধারা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নামেই ছিল। জমির মালিকানা, চাকরি ইত্যাদি সামান্য যে ক’টি বিশেষ সুবিধা কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ছিল, তা ৩৭১ ধারায় উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতেও রয়েছে। হিমাচল প্রদেশেও এইরকম সুবিধা আছে। ৩৭০ ধারা রদ করেও ৩৭১কে সুরক্ষিত রাখা কি কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও বাড়াবে না? নানা প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আরও জোরালোভাবে উঠছে। কারণ, কাশ্মীরবাসীদের সিংহভাগের ধারণা ছিল, ২০১৯ সালে নেওয়া কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত ধাক্কা খাবে সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির বানানোর ছাড়পত্র পাওয়ার মতো ৩৭০ ধারা রদের মামলাতেও শীর্ষ আদালতে শেষ পর্যন্ত জয়ী হল নরেন্দ্র মোদির সরকার। এই রায়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জয় পেল কি না, তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।