অফিস থেকে ফিরে পরিচ্ছন্ন হয়ে সন্তানের কাছে যাওয়া। তার আঙলে আঙুল দিলে সে আঙুলটা খেলনা ভেবে মুঠি পাকিয়ে নেয়। কখনও মাথার ওপর ঘোরা দম দেওয়া চরকি দেখে আনন্দে পা ছোড়ে, আবার কখনও সেদিকে খেয়াল নেই। তার গায়ের মানবশিশুর গন্ধ লেগে থাকে জামাকাপড়ে। তুলতুলে গন্ধ। সেই গন্ধ কাটতেই চায় না। তাও সে আমার উপস্থিতিটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। আমি যেন তার অবসর। বিনোদন।
আমাদের দেশে সন্তান জন্মানোর পর মায়েরা কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি পেলেও বাবারা তা পায় না। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। কিন্তু মোটের ওপর ছবিটা এটাই।
অপারেশন থিয়েটার থেকে প্রথম যখন আমার সন্তানটিকে সিস্টার কাপড়ে মুড়ে বাইরে নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন– আমি দেখেছি, সে কী বিস্ময়ে আমাকে দেখছে। আমাকে দেখছে, নাকি এই নতুন পৃথিবীটাকে দেখছে? চোখ ঘোরাচ্ছে সে। নিজের মুখের কাছে সিক্ত আঙুলগুলো নিয়ে যাচ্ছে, আর বারবার হাই তুলছে। মানবছানার এই বিস্ময় ভোলার নয়। এই বিস্ময় একজনকে ‘বাবা’ হওয়া শিখতে সাহায্য করে। প্রতিমুহূর্তে সেটা চর্চা করতে হয় ওইটুকু ছানার সঙ্গে। সে ভুল ধরিয়ে দেয়। আবার তা শুধরে নিতে হয়। তার ইঙ্গিতগুলোকে বুঝে তার সঙ্গে সংলাপে এগিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার না।
অফিস থেকে ফিরে পরিচ্ছন্ন হয়ে তার কাছে যাওয়া। তার আঙুলে আঙুল দিলে সে আঙুলটা খেলনা ভেবে মুঠি পাকিয়ে নেয়। কখনও মাথার ওপর ঘোরা দম দেওয়া চরকি দেখে আনন্দে পা ছোড়ে, আবার কখনও সেদিকে খেয়াল নেই। তার গায়ের মানবশিশুর গন্ধ লেগে থাকে জামাকাপড়ে। তুলতুলে গন্ধ। সেই গন্ধ কাটতেই চায় না। তাও সে আমার উপস্থিতিটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। আমি যেন তার অবসর। বিনোদন। পিতৃতান্ত্রিক এমনই এক ব্যবস্থা যে ছানাটাকেও বুঝিয়ে দেয় ‘মা’ হল জরুরি। খিদে, শরীর-খারাপ, এমনকী বেঁচে থাকার জন্য যা-কিছু অত্যন্ত দরকারি– সেগুলোর জন্য সে নির্ভর হতে শিখে যায় মায়ের কাছে।
বাবারা তখন দ্বিতীয়।
রাতে তার ভেজা কাঁথা পাল্টে পুনরায় শুকনো কাঁথা পেতে দেওয়ার পর ঘুম চলে আসে, সে কি তখন পিটপিট চোখে বাবার অকর্মণ্যতাকে মাপে? তা না হলে সুযোগ পেলেই মায়ের বুকের ওমে চলে যায় কেন?
তারপর সাইকেল। সে কিছুতেই উঠবে না। উঠলেও বাবাকে সাইকেলটা পিছন থেকে ধরে থাকতে হবে। সে প্যাডেল দিতে দিতে পিছনে তাকায়। বাবা রয়েছে– সে প্যাডেল চালায়। বাবা রয়েছে, তারপর একদিন আর বাবারা থাকে না। সন্তানটি পিছনে না তাকিয়ে সারা মাঠ ঘুরপাক খায়। দু’-হাত ছেড়ে সাইকেল চালানোর পারদর্শিতা দেখায়। ধীরে ধীরে সূর্য নেমে আসবে। এবার অ-আ-ক-খ। তার আগে ললিপপের লোকানো স্বাদ প্রকাশ পাবে মায়ের কাছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবু কিছু বাবা মুখে স্প্লিন্টারের কাঁটা দাগ নিয়ে হন্যে হয়ে ফেরে। তাদের সন্তান এখন কোথায়? কোন ধ্বংসস্তূপের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের লিকলিকে পায়ে বন্দুকের গুলি। ভয়ে কাঁপছে কেউ। কানে বোমা ফাটার তীব্র আওয়াজ। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। খাবার নেই। প্রতিদিন খবরে ভেসে আসে তাদের সংখ্যা। দুই হাজার। তিন হাজার। চার হাজার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাবাদের জন্য ছানারা বকুনি খায়।
কালবৈশাখী এল, পশ্চিমে কালো মেঘ, সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাত। জানলার ফাঁক দিয়ে শিশুটি দেখে রাস্তা দিয়ে রোগা লোকটা চলে যাচ্ছে। ছাউনির নিচে বাইক দাঁড়িয়ে পড়েছে। আচমকা লোডশেডিং।
সে ডাকে সাড়া দিল না। অন্ধকার ঘর, বারান্দা, বাথরুম, সিঁড়ির নিচটা মোবাইয়ের আলো জ্বেলে খোঁজা হল। নাম ধরে ডাকা হল আরও কয়েকবার। তারপর যখন পাওয়া গেল বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো ভিজে গিয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে– আর সে প্রথমবার ঝড় দেখে অভিভূত। ভয়, না আনন্দ? গা ছমছম, না গায়ে কাঁটা দেওয়া?
বাবারা অনুমান করতে পারে না। সে মায়ের কোমর জড়িয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ শোনে। বাজ পড়ল নারকেল গাছটার মাথায়, আলো এল প্রায় মধ্যরাতে। তার আগে ছায়া দিয়ে হরিণ, পাখি, রাক্ষস বানিয়েছে। সে নিজের ছায়াকে ধরতে গেছিল। বারবার ফস্কে যাচ্ছিল বলে রাগ করে আমার পাশে এসে বসে থাকল। নিজে হাঁস বানাল, মুখে চইচই শব্দ করে।
সেই শব্দ শুনে টিকটিকিরা দেয়ালঘড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সন্তানকে খাওয়ানোর মতো সঙ্গতি এখনও বহু অভিভাবকের নেই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আকাশের রং সবুজ, বৃষ্টির রং নীল, নদীতে যে নৌকো বইছে তাতে রাখা মাছটাকে দেখা যাচ্ছে এপার থেকে। মোটা ভ্রু কুঁচকে হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চাটার নাম সিনচান। সে এখন বন্ধু হয়েছে। কুকুরটা খয়েরি। ঘাসগুলো লাল। কৃষকের মাথার ওপর টুপিটা হলুদ। সূর্যটা কমলা। কিন্তু সেটার চারদিক দিয়ে যে রশ্মিগুলো বেরচ্ছে, সেগুলো বিভিন্ন রঙের।
জিজ্ঞেস করলাম, সবুজ রঙের মাছ আঁকলি কেন? নদীর মাছ কি সবুজ হয়?
সে উত্তর দিল না। ভাঙা প্যাস্টেলে আঁচড় কাটতে কাটতে বলল, তুই খালি গায়ে রয়েছিস কেন?
–কী গরম পড়েছে বল!
–কিন্তু গরম তো মায়েরও হচ্ছে। মা তো খালি গায়ে থাকতে পারে না। তাহলে তুই খালি গায়ে কেন?
‘বাবা’ হতে পারা নেহাত মুখের কথা না। প্রতিনিয়ত চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ছোট্ট ছানাটা কখন লাল কালিতে চাঁদ এঁকে ফেলবে– তা কেই বা বলতে পারে!
তবু কিছু বাবা মুখে স্প্লিন্টারের কাঁটা দাগ নিয়ে হন্যে হয়ে ফেরে। তাদের সন্তান এখন কোথায়? কোন ধ্বংসস্তূপের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের লিকলিকে পায়ে বন্দুকের গুলি। ভয়ে কাঁপছে কেউ। কানে বোমা ফাটার তীব্র আওয়াজ। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। খাবার নেই। প্রতিদিন খবরে ভেসে আসে তাদের সংখ্যা। দুই হাজার। তিন হাজার। চার হাজার।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর একপ্রান্তে বাবারা তাদের সন্তানকে খুঁজছে। আর অন্য প্রান্তে অন্য বাবারা সেই সন্তানদের খুন করতে বদ্ধপরিকর।
কত অবরোধের পর খাবার এসেছে। যা-কিছু হাতের কাছে পাওয়া গিয়েছে, তা নিয়ে ছুট লাগিয়েছে বাবা-মা-সন্তানেরা। কিছু জুটতে পারে। নাও জুটতে পারে। মাথার ওপর ছাউনি নেই। চাং চাং সিমেন্ট আর ইটের ওপর আস্তানা। সেখানে রাত্রি নামে। ফসফরাসের সাদা আলোয় তাদের দেখে নেয় অন্য বাবারা। তারপর নিশানা। এমনকী পথের কুকুরটিও ডাকে না আর। সেটিও নিখোঁজ।
মেয়ের সর্দি হয়েছে। নাক ফোঁতফোঁত করছে। আমি খেতে বসেছি। সে আমার পাশে। খেতে খেতেই অবলীলায় বাম হাত দিয়ে তার নাক পরিস্কার করে ফেলি। খাবার পর বেসিনে হাত ধুতে যাই। সে আমার পিছনে। আমার জামা ধরে টানছে। আচমকা মনে হল– ছাদটা ভেঙে পড়েছে। মাথার ওপর আকাশ। আমরা দু’জন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে। মাথার ওপর বাবারা ড্রোন উড়িয়ে দিয়েছে।
আমি ওর মা-কে ডাকি। প্রয়োজনীয় কিছু নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। আমরা তিনজনে ছুটি। ছুটতে থাকি। কোথায় যাব? মাথার ওপর ড্রোন। সার্চলাইটের যাওয়া-আসা। কোথায় লোকাব?
মেয়ে বলল, আয়।
আমরা যে ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করলাম সেখানে সিনচান থাকে। সেখানে গোলাপের রং সবুজ। আকাশের রং হলুদ। বৃষ্টি এল। নীল রঙের বৃষ্টি।
এই ঘরে হত্যাকারী বাবাদের প্রবেশ নিষেধ।