পেটে যত টান পড়ে, সংস্কৃতির বিপন্নতা তত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! ‘সৈনিক’ নিজের অবিশ্বাসেই একদিন ভাবতে শুরু করে, বহিরাগত রোহিঙ্গারা এসে সব বরবাদ করে দেবে না তো! সংখ্যালঘুদের কি বেশি বাচ্চা হচ্ছে! দেশটা তাদের হয়ে গেলে বাকিরা তো ‘খতরে মে হ্যায়’। এই সব মুহূর্তেই দিক্ভ্রান্ত ‘সৈনিক’ মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, পাকিস্তানকে ঠিক কতখানি ঘৃণা করা উচিত? অন্তত দুধের সাধ ঘোলে, ঘৃণা তবে পড়শি কোনও সংখ্যালঘুকে! না করলেই হয়। রাষ্ট্র তো জনকল্যাণকামী, অর্থনীতি উদারনীতিবাদী। খামোখা মানুষ মানুষের প্রতি দ্বেষ পুষে রাখবে কেন! তাতে তো না পাকা রুইয়ের দাম কমবে, না ঝিঙের দাম ৮০-র নিচে নামবে! তবুও বিদ্বেষ।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
যুদ্ধ হবে?
একটু মেটে হবে না! চেনা আবদার, চেনা দোকানদার। খাবলা মেরে হাতের কায়দায় অল্প একটু তুলে আনা মেটে উঠে কালো প্লাস্টিকে চলে এলে, যুদ্ধজয়ের গৌরবে ‘সৈনিক’ বাঁক নেয় বাজারের বাঁ-দিকের গলিতে। আলুর দাম চড়া-বাঁধা। ‘সৈনিকের’ নিয়ন্ত্রণে নেই। চন্দ্রমুখী আর জ্যোতির বর্ণবাদে ভাগ ভাগ ঝুড়ি। আজকাল আবার ভেজাল চন্দ্রমুখী বেরিয়েছে, সেদ্ধ হতে বেশি সময় নেয়, তবে জ্যোতির থেকে কম। চেনা যায় না সহজে। কী করা যাবে! আলুর কোনও আধার কার্ড নেই। পেঁয়াজের দামও আপনি ওঠে, আপনি নামে। দরদাম চলে না। তবে লেবু, পাতি বড়। ১০ টাকায় দুটোর জায়গায় তিনটে হয় না? হয় না, হয় না; আবার কখনও হয়েও যায়। ভরা ব্যাগ সবজির উপপাদ্যে এক্সট্রা লেবু পাতি-জীবনে মস্ত প্রাপ্তি। যুদ্ধজয়।
এরপর এক কাপ চা। বাজারের ব্যাগ বেঞ্চির পায়ায় ঠেসান দিয়ে রাখে ‘সৈনিক’। হিসাব চলছে। যথেচ্ছ চা-ধূমের নেশা নৈব নৈব চ। মাসকাবারি, এলআইসি, মেডিক্লেম। গেল পয়লা বৈশাখে নতুন পোশাকের খরচখরচা। তাছাড়া পুজো এবার এগিয়ে এসেছে, দস্তুরমতো তাই আগেভাগে হিসেবি। ‘সৈনিক’ শুনেছে, যুদ্ধ লাগলে বাজার আক্রা! তাহলে কি এককালীন অনেকটা বাজার করে রাখা উচিত! করোনার সময় মানুষ যেমন করে রেখেছিল। অনেকে খেতে পায়নি, অনেকের জমানো খাবার নষ্ট হয়েছিল। মারিকালে এসব হয়। যুদ্ধ তো আদিম মহামারি। ভাইরাস ছড়াতে ছড়াতে বিশ্বের ও-প্রান্ত থেকে এসে এখন দেশে, দুয়ারে। যুদ্ধ যতক্ষণ কাগজে-টিভিতে ততক্ষণই ভালো। ইউক্রেন দেখো। গাজা। ‘মানবতা’ বলে এ-পৃথিবীতে যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, তা চায়ের ঠেক জানে, মেট্রো জানে, ট্রেনের তাস-পেটানো গোষ্ঠী জানে। বাজারও জানে। যুদ্ধ হলে কালোবাজারি। সঞ্চয় কী আছে! রেকারিং হিং-টিং-ছট। ওটুকু দিয়ে আর কী হবে! যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়– আজকাল তো আর যুদ্ধের শেষ হয় না, রাশিয়া জিতল না হারল বোঝাই যায় না– এই সঞ্চয়ে কি চলবে? আয়ুর সঞ্চয়ই বা কতটুকু! বেঁচে থাকার মতো অনিশ্চয় আর কিছু নেই। মৃত্যু নিশ্চয়তা। সম্-এ ফেরার মতো। বেঁচে থাকা রঙচঙে পোশাক গায়ে এক আজব দুঃখী। পা ফেলার আগে অবধি সে জানে না কোথায় পা পড়বে। রাস্তা এবড়োখেবড়ো। উঁচু-নিচু। অথচ সারানোর তো কথা ছিল। সারিয়েও ছিল। কালো পিচে ফিরে এসেছিল ভারী চাকা। তাতেও বোধহয় করাপশন। এক বর্ষায় পিচ উঠে ছ্যাতরা। অথচ পাড়ার পাঁচিলে পাঁচিলে এখনও ভোটের দেওয়াল-লিখন। এখন অন্যমনস্ক হলে হোঁচট। এক ব্যাগ বাজার নষ্ট। টোটো লাফায়। রিকশা আর একটু বেশি। ভোট না এলে রাস্তা শুধরোয় না। রাস্তা কারও একারও নয়। ‘সৈনিক’ জানে, তাকে সমঝে চলতে হবে, পড়লে কেউ তুলবে না, এমনই দেশ।
…………………………….
নোটবন্দির সময় তখন লম্বা লাইন এটিএমের বাইরে। কী হয় কী হয়! সে এক অদ্ভুত ভয়। স্বাধীন দেশে মানুষ এত ভয়ে ভয়ে থাকার কথা নয়। থাকে, কেন-না তাতে মানুষের ভালো হয়। কত সংখ্যক মানুষের? সে-প্রশ্ন করাই উচিত নয়। কেন-না ক’টা মানুষকে ধরে-বেঁধে যখন কোটি মানুষের ভালো রাখার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে মানুষ নিশ্চিন্তে থাকে, তাহলে আর প্রশ্ন কীসের! অতএব ‘সৈনিক’ চুপ করে যায়।
……………………………
তবে, সিয়াচেনে গিয়ে দাঁড়ালে না কেন? প্রশ্নের মুখে পড়ে থতমত খেয়েছিল ‘সৈনিক’। নোটবন্দির সময় তখন লম্বা লাইন এটিএমের বাইরে। কী হয় কী হয়! সে এক অদ্ভুত ভয়। স্বাধীন দেশে মানুষ এত ভয়ে ভয়ে থাকার কথা নয়। থাকে, কেন-না তাতে মানুষের ভালো হয়। কত সংখ্যক মানুষের? সে-প্রশ্ন করাই উচিত নয়। কেন-না ক’টা মানুষকে ধরে-বেঁধে যখন কোটি মানুষের ভালো রাখার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে মানুষ নিশ্চিন্তে থাকে, তাহলে আর প্রশ্ন কীসের! অতএব ‘সৈনিক’ চুপ করে যায়।
রাষ্ট্র তো জনকল্যাণকামী। চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিশ্চিতই কিছু কল্যাণ এখনও গড়িয়ে আসে। নইলে এত লোক খেয়ে-পরে বাঁচছে কী করে! অথচ খেঁকুটেরা বলে, সে দিনকাল আর নেই। বলে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! কী করে কাটাইবে! আগে কি বিদেশি জিন্স ছিল না, না নামী ব্র্যান্ডের সানগ্লাস! ভাগ্যিস ভুবনায়ন! সে দিল শচীন তেণ্ডুলকর আর শাহরুখ খান। জ্যান্ত অবতার। ধর্ম যার যার, এঁরা সবার। দেশের ভিতর অন্য এক দেশ। হাজার চোখের সামনে একজন সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন। অন্যজন আধুনিক মদনদেব, বসন্ত যেথায় ফুরয় না। অতএব ঈর্ষা নেই, দ্বেষ নেই, অসাম্য নেই, বৈষম্য নেই– আলোর নিচে অপূর্ব এক আলো! স্বীকার করতেই হয়, মানিয়েও ছিল ভালো। সত্যি বলতে, এর আগে অনেক দিন শ্রেণি শ্রেণি করে জুড়ে জুড়ে কী লাভই বা হল! বিপ্লবের প্রগতি প্রকাশনে যা দেখা যায়, প্রকাশে তা বড় একটা নয়। যতটুকু হয়, খেসারত দিতে হয় তারও বেশি। তার থেকে এই-ই ভালো। শ্রেণি নেই; সংগ্রাম আছে। তা এককের। কৃতিত্বও এককের। বেশ তো চলার কথা ছিল। রক্তকরবীর নন্দিনী যাকে ‘রাক্ষসের তত্ত্ব’ বলে, চলছিল সেই মাফিকই। ছোটরা ছাই হয়, বড় শিখা জ্বলতেই থাকে। রাজার অদ্ভুত শক্তির পরিণাম। অদ্ভুত হল জমা, কিম্ভূত হল খরচ। কিম্ভূতে ছয়লাপ হলে বোঝা যায়, অদ্ভুতের শক্তি কেমন প্রবল। কতখানি লোভ তার ভিতরে জমা হয়ে আছে। অধ্যাপকরা এসব নিয়ে সতর্ক করেন। শঙ্খ ঘোষ ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘রক্তকরবী’ দেখার পর নেহরু বলেছিলেন বটে, ‘ডিজিজ অফ জায়গানটিজম’-এর ভোগান্তি, এখন দেশের গভীর অসুখ– ‘দিস ইজ আ ডেঞ্জারাস আউটলুক ডেভলপিং ইন ইন্ডিয়া… দি আইডিয়া অফ বিগ’। কিন্তু কার্যকারণ সূত্রে ‘রক্তকরবী’ আর নেহরুবাণীকে শঙ্খবাবু বাঁধবেন কী করে, নেহরুকেই তো সেই বড়র তত্ত্বেই ফিরতে হয়েছিল বাঁধপ্রকল্পে। বড়র তত্ত্ব আরও বড় ৫৬ ইঞ্চি কিংবা ৫৬ ভোগ হয়ে প্রকাশ পেলে ‘সৈনিক’ আর কী করে! ৫ লিটার সরষের তেলের সঙ্গে ১ কেজি চিনি ফ্রি পেলেই বেচারি বর্তে যায়।
তবে কি না লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পুঁজির রাক্ষুসে লোভ যত বাড়ে, ‘সৈনিক’ সব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যত বিচ্ছিন্নতা, তত শাসনের আধিপত্য যক্ষপুরীতে। ধর্মে ধর্মে তখন পুরনো বিবাদে চকমকি। প্রমাণ করতে হয়, কে বেশি ধার্মিক। ধর্মভেদে আবার প্রমাণ করতে হয়, কে বেশি দেশপ্রেমিক! কোনও প্রশ্ন নয়। প্রশ্নহীন অবাধ গণতন্ত্র। প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন, সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াওনি কেন? শুনে অপ্রস্তুত ‘সৈনিক’। দেশকে আর কতটুকু ভালোবাসে! দেশের জন্য গুলি খায়নি, বারুদ খায়নি। জিডিপি বাড়লে দেশের মঙ্গল। নতুন এই শাস্ত্রবাক্য সে মুখস্থ করেছে– জিডিপি স্ট্রং, নইলে দেশের ‘রং’। ‘মা তুঝে সালাম’ বলে সে শিখে নিয়েছে জিডিপি-জাতীয়তাবাদ। তাতে অবিশ্যি জিনিসের দাম কমে না। দাম যত বাড়ে, তত বেতন বাড়ে না। মূল্যবৃদ্ধি আর মূল্যবোধ সমানুপাতে চলে না। একটার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে অন্যটিকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। পেটে যত টান পড়ে, সংস্কৃতির বিপন্নতা তত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! ‘সৈনিক’ নিজের অবিশ্বাসেই একদিন ভাবতে শুরু করে, বহিরাগত রোহিঙ্গারা এসে সব বরবাদ করে দেবে না তো! সংখ্যালঘুদের কি বেশি বাচ্চা হচ্ছে! দেশটা তাদের হয়ে গেলে বাকিরা তো ‘খতরে মে হ্যায়’। এই সব মুহূর্তেই দিক্ভ্রান্ত ‘সৈনিক’ মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, পাকিস্তানকে ঠিক কতখানি ঘৃণা করা উচিত? অন্তত দুধের সাধ ঘোলে, ঘৃণা তবে পড়শি কোনও সংখ্যালঘুকে! না করলেই হয়। রাষ্ট্র তো জনকল্যাণকামী, অর্থনীতি উদারনীতিবাদী। খামোখা মানুষ মানুষের প্রতি দ্বেষ পুষে রাখবে কেন! তাতে তো না পাকা রুইয়ের দাম কমবে, না ঝিঙের দাম ৮০-র নিচে নামবে! তবুও বিদ্বেষ। পুঁজির লোভ যত বাড়ে, তত বাড়ে বিদ্বেষ সরবরাহ। বিদ্বেষী পৌরুষ তখন আস্ফালন করে সর্বত্র। জাতীয়তাবাদের প্রমাণ চায়। নারী-প্রান্তিক মানুষকে অত্যাচার করে। ‘সৈনিক’ প্রতিবাদ করতে চাইলে, তার কথা বলার স্বাধীনতার উপর ফাঁস টেনে দেওয়া হয়। বলা হয়, আন্দোলন সব কীসের আন্দোলন? দেশ ভাঙার চক্রান্ত যত আরবান নকশালের, অতএব, দেশদ্রোহী। হতোদ্যম ‘সৈনিক’ বসে থাকে নিজেরই অজান্তে ঢুকে পড়া চক্রব্যূহে। বেরনোর মন্ত্র অজানা। অথচ জানে, ফ্যাসিবাদের পায়ের শব্দ আর বেশি অস্পষ্ট নয়। সে-ফ্যাসিবাদ গিলে ফেলছে ব্যক্তিকে। দোসর হয়ে আছে ধর্মীয় মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদ।
‘সৈনিক’ সেক্যুলার কি না জানে না। ‘সেক্যুলার’ শব্দটা ক্রমাগত অর্থ বদলাতে বদলাতে এগিয়েছে। কেউ কেউ ভাবেন, সেক্যুলারিজম সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। কেউ ভাবেন, রাষ্ট্রের কাজকর্মের সঙ্গে সব ধর্মের সমান দূরত্ব ইত্যাদি। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, ‘জগৎ-সংক্রান্ত’– গোড়ার এই অর্থ থেকে ধরলে উনিশ শতক যে-অর্থে তা থিতু হয়েছিল, অন্তত বিদ্যাসাগর যে-অর্থে সেক্যুলার, তা হল– ‘সেই মতবাদ যাতে নীতিবোধ শুধু মানবজাতির ইহজীবনের ভালো থাকার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে; ঈশ্বর বা পরকালে বিশ্বাস-সংক্রান্ত সব বিবেচনা তার থেকে বাদ দেওয়া হয়।’ সেই সঙ্গে শিক্ষা হবে অ-ধর্মীয়। রাষ্ট্র সেদিন এই সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করে একরকম অন্য বাস্তবতা নির্মাণ করতেই চেয়েছিল। ‘সমাজপ্রগতির অপরিহার্য শর্তগুলি’ প্রযুক্ত হলে ধর্ম-পরকাল ইত্যাদি নিয়ে মাথাব্যথা কমারই কথা। তবু সবটা আর হল কই! বরং পশ্চিমা ধাঁচের সেক্যুলারিজম অন্য প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিল। আশিস নন্দী সেইসব কারণ বিশ্লেষণ করেই দেখাবেন– প্রতীচ্য মানব, পাশ্চাত্যভাবাপন্ন নেটিভদের সঙ্গেই জন্ম নেবে ধর্মীয় কট্টরপন্থী। রাজনীতি পড়বে উভসংকটে। ধর্মের শক্তির দিকগুলো রাজনীতির খারাপ দিকগুলো দূর করতে পারল না। বরং ধর্মের খারাপ দিকগুলো রাজনৈতিক অভিব্যক্তি পেয়ে গেল।
‘সৈনিক’ জানে, তার দেশে জাতিদাঙ্গা এক ধারাবাহিক ইতিহাস। মসজিদ ভাঙে। মসজিদ খোঁড়া হয়। অতীতের মন্দির-ভাঙা দিয়ে তার ঢাল তোলা হয়। এই ধর্মদ্বেষ জেগে থাকল সমাজের অন্ধিতে-সন্ধিতে। আর কট্টরপন্থা যা পশ্চিমি সংস্কৃতির বিপক্ষে, আধুনিকতার বিপক্ষে, তা আঘাত হানতে শুরু করল ‘সৈনিকেরই’ ওপর। এই উভমুখী সংকট নয়া-উদারনীতিবাদেরই ফসল। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নয়া উদারনীতিবাদ তাই নিজেই এখন আস্ত সংকট! কিন্তু ‘সৈনিক’ এত ভেবে কী করবে? সে জানে, পহেলগাঁওতে একেবারে ধর্ম বেছেই মারা হয়েছে। তা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাতে আছে অন্য রাষ্ট্রের মদত। সুতরাং, ‘সৈনিকের’ রাষ্ট্রের দায় আছে এই জবাব দেওয়ার। হতে পারে দেশ সকলের, তবু মৃত্যু হিন্দুর বলেই, ধর্ম-হত্যার জবাব হবে ‘সিন্দুর’। তাতে সহযোগিতা করাই বিরোধীর কর্তব্য, নাগরিকের দায়। অতএব, সাইরেন…।
যুদ্ধ-দেশভাগ না-দেখা একটা প্রজন্ম হয়তো যুদ্ধ দেখতে পারে। পেকে-ওঠা ঘা-পুঁজ এই সময়ের ভিতর ‘সৈনিক’ একা একা হাঁটতে থাকে। ভাবে, যুদ্ধ কি তাকে আরও তৃপ্তি দেবে! যেমন তৃপ্তি মেলে যুদ্ধের সিনেমা দেখে। এক-দু’-ঘণ্টার গল্পে বিধর্মী মৌলবাদী খতমের উত্তুঙ্গ উত্তেজনা যেভাবে তাকে বুঁদ করে রাখে, তেমনই কি হবে সত্যিকার যুদ্ধে! ধনতন্ত্র যে-পথে চলতে শুরু করেছিল, যে-পথে উদারনীতিবাদ এগিয়ে গেল, তাতে এই মৌলবাদ আর সন্ত্রাস অবধারিতই ছিল। ধনতন্ত্রের মূলে তবু আঘাত হানা সম্ভব হল না। ভাবনার সেই শিকড়ে আবার কি ফিরে যাওয়া যায়– পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে এতটা এগিয়ে যাওয়ার পরেও, গেলেই বা কোন পথে! ‘সৈনিক’ জানে না। প্রতিদিন বিদ্বেষ, ক্রনিক দারিদ্র, মৌলবাদ, সন্ত্রাস আর রাজনৈতিক নাটুকেপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রণক্লান্ত তাকে আবার নতুন করে বেঁধে নিতে হয় বর্ম। যুদ্ধ লাগলে দাম বেড়ে যেতে পারে জিনিসপত্রের। অন্তত বাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। যুদ্ধের খরচ, এমনকী, মহড়ার খরচ। জিডিপিতে শক্তিশালী দেশ, তবু ধাক্কা কি তার জীবনেও এসে লাগবে না! বেতন বাড়ুক না-বাড়ুক, আধিপত্য নিপাত যাক না-যাক, উদারনীতিবাদের সংকট মোচনে কেউ সত্যনারায়ণ দিক না-দিক, তাকে বাঁচার যুদ্ধে নামতেই হবে। একদিন, প্রতিদিন।
উঁচুনিচু রাস্তায় শক্ত করে বাজারের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে ‘সৈনিক’। ভাবে, যুদ্ধ লাগলে যে ছেলেটা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করল তার পড়া এগবে তো, তার অভিভাবকের চাকরি থাকবে তো! একচিলতে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখেছে যে যুবক-যুবতী, তারা পারবে তো স্বপ্ন সাকার করতে? যে মেয়েটা চাকরি করে পেয়েছে প্রথমবার স্বাধীনতার স্বাদ, তার এগিয়ে যাওয়া থমকে যাবে না তো! পরিযায়ী, গিগ-শ্রমিকরা যুদ্ধ হলে কী করবে, কোথায় থাকবে! মন্দির-মসজিদ যুদ্ধের আঘাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারবে! আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ হাল্লায় বাজারে এসে মেটে-র আবদার কি নেহাতই সুবিধাভোগী স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে যাবে! ভাবতে ভাবতে চেনা রাস্তা ফুরিয়ে আসে, জীবনের ছোট ছোট যুদ্ধ তবু কিছুতেই ফুরোতে চায় না।
এই ‘সৈনিক’ গান স্যালুট পায় না। শহিদ হয় না। জীবনের যুদ্ধে যদিও সে হার মানে না কোনও দিন। মৃত্যু আর আগুনের উপহাসের বিরুদ্ধে জেগে থাকে সৈনিকের নাভিকুণ্ড– তার শেষ যুদ্ধজয় হয়ে।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
সম্প্রতি যোধপুর পার্কে প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষের ওপর পাড়া-প্রতিবেশীর আক্রমণ। হেলমেট দিয়ে মেরে, মাটিতে ফেলে ধর্ষণের হুমকি। কোনও বচসার সময় যৌন সম্পর্কিত গালাগাল হচ্ছে তীব্রতম আক্রমণ, এবং ট্রান্স কুইয়ার সম্প্রদায়ের প্রতি এই আক্রমণের উদ্দেশ্য তাঁদের অন্যরকম যৌনতাকে অস্বাভাবিক, অসুস্থ প্রমাণ করা।