গ্রেটাদের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায়? গ্রেটারা দেখতে পাচ্ছে পৃথিবীর ও তাদের ভবিষ্যৎ– বিবর্ণ, অনিশ্চিত। গ্রেটার জেনারেশনের সামনে বৈজ্ঞানিকদের তথ্য, তাদের সামনে একটু একটু করে বদলে যাওয়া পৃথিবী, গলে যাওয়া গ্লেসিয়ার, ভয়াবহ সাইক্লোন, হ্যারিকেন, দাবানল, খরা, বন্যা– প্রত্যেক দিন শেষ হয়ে যাওয়া সংরক্ষিত প্রাণীকুল, বাড়তে থাকা তাপমাত্রা– তাও প্রশ্ন তুলবে না তারা? যাদের বাঁচতে হবে ওই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?
২২ বছরের মেয়েটি আবার ফিরে এসেছে খবরের শিরোনামে। ফ্লোটিলা কোয়ালিশন। এই অক্টোবরেই, প্যালেস্টাইনে খাবারের অভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষদের কাছে জলপথে ৪২টি জলযান (খাদ্য ও রসদপূর্ণ) পৌঁছনোর চেষ্টা করছিল। বহু দেশের নাগরিক শামিল ছিল এই অভিযানে। ইজরায়েলি সৈন্যবাহিনীর কাছে গ্রেফতার হয়ে সেখানকার জেলে কয়েক দিন কাটিয়ে ফিরে এসেছে তারা। এদের মধ্যে অন্যতম নাম গ্রেটা থুনবার্গ।
ফিরে এসে এক মুহূর্ত থামেনি সে, প্রতিবাদ করে চলেছে জেনোসাইডের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক তাকে ব্যঙ্গ করেছেন, দমাতে পারেননি। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চির ছোটখাটো মেয়েটি, যার চোখের একাগ্রতা ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না, তার বিরুদ্ধে স্বয়ং আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করতে হয়। কেন? কারণ, ২২ বছরে সে অতিক্রম করেছে এতখানি পথ, যা বহু সংখ্যক মানুষ, অনেকগুলো জীবন ধরেও অতিক্রম করার কথা ভাবতে পারে না! গ্রেটা থুনবার্গের যাত্রাপথের কথা আমরা জানি, তবুও পৃথিবীর এই আকালে, গ্রেটার কথা বলা যেন নিজেদের প্রতিবাদের স্বপ্নকে একটু হলেও বাঁচিয়ে রাখা।
প্রত্যেক বছর পৃথিবীতে নেমে আসছে প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক বিপর্যয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ, অন্য প্রাণীরা ক্ষতিগ্রস্ত, ভূমিচ্যুত। প্রাণ হারাচ্ছে মুহুর্মুহু। সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছুদিন খুব লেখালেখি হয়, প্রকৃতির ভয়াবহ দুর্যোগের মর্মান্তিক ছবি দেখে শিউরে উঠি আমরা। গলে যাওয়া হিমবাহর ছবি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তারপর? যাই বেমালুম ভুলে! আবার কিছু ঘটলে সচেতনতার ভান করি হই– ঘরে-বাইরে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ– এসব নিয়ে তক্ক-বিতক্ক করি। অথচ কিছু মানুষ আছেন এমনও, যে তারা, যখন এই খবরগুলো শোনে বা দেখে– ভুলে যায় না।
কয়েক বছর আগে, সুইডেনের স্টকহোম শহরের অধিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ, তার যখন বয়স ৮, তখন প্রথম গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কথাটার সংস্পর্শে তার উপলব্ধি হয়– তার দেশ সুইডেনের গভর্নমেন্ট, ইউরোপের তার প্রতিবেশী দেশগুলো, পৃথিবীর উন্নত এবং উন্নতিশীল দেশ, বিগ কর্পোরেশন, অয়েল এন্ড গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি, ইউনাইটেড নেশনস– এক কথায় যারা এই পৃথিবীর ভবিষ্যতের নিয়ন্তা তাঁরা বৈজ্ঞানিক, পরিবেশবিদদের এত গবেষণা থেকে বের হয়ে আসা তথ্য এবং পরিসংখ্যানগুলোর থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয় স্বল্পমেয়াদি তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক উন্নতিতে। তার মনে হতে থাকে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে পৃথিবীর যে ভয়ংকর ক্ষতি হবে, সেটা তাঁরা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করছেন না।
কী হতে পারে এইরকম হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে?
পৃথিবীর বহু সমুদ্র-তীরবর্তী শহর, গ্রাম সম্পূর্ণ ডুবে যাবে, বন্যা এবং খরাপ্রবণ জায়গায় আরও অনেক বেশি বন্যা আর খরার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাত্রা কমে যাবে অনেক গুণ। পানীয় জলের জন্য হাহাকার ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত পৃথিবীতে বায়োডাইভার্সিটি ধ্বংস হতে চলবে। গ্রেটার কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য যে, বড়রা এত বেশি চিন্তিত স্কুলে ভালোভাবে পড়াশোনা করা ও সুনাগরিক হয়ে ওঠার জন্য হওয়ার জন্য– মোদ্দা কথা, ভবিষ্যৎ-চিন্তায়। কিন্তু গ্রেটাদের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায়? গ্রেটারা দেখতে পাচ্ছে পৃথিবীর ও তাদের ভবিষ্যৎ– বিবর্ণ, অনিশ্চিত। গ্রেটার জেনারেশনের সামনে বৈজ্ঞানিকদের তথ্য, তাদের সামনে একটু একটু করে বদলে যাওয়া পৃথিবী, গলে যাওয়া গ্লেসিয়ার, ভয়াবহ সাইক্লোন, হ্যারিকেন, দাবানল, খরা, বন্যা– প্রত্যেক দিন শেষ হয়ে যাওয়া সংরক্ষিত প্রাণীকুল, বাড়তে থাকা তাপমাত্রা– তাও প্রশ্ন তুলবে না তারা? যাদের বাঁচতে হবে ওই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে? ছোটবেলা থেকে সোশ্যাল ইন্টারেকশনে সমস্যা ছিল গ্রেটার, সে ছিল অত্যন্ত চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। সে-সময় বন্ধুদেরকে নিজের চিন্তা-ভাবনা বুঝিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অনেক ভেবে, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের এক শুক্রবার, একটা হাতে লেখা ব্যানার নিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে বসেছিল গ্রেটা, যাতে লেখা ছিল ‘No school for Climate Strike’!
ছোট্টখাট্টো চেহারার দুটো বিনুনি বাঁধা একটা স্কুলের মেয়ে তার ব্যাগপ্যাক আর একটা ব্যানার নিয়ে যখন বসে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে, প্রথম কয়েক দিন কিছুই সাড়া পায়নি। যা পেয়েছিল, তা হল বাবা-মা-র নিষেধ, বন্ধুদের উপেক্ষা, পথচলতি কিছু মানুষের কৌতূহল। ধীরে ধীরে এই কৌতূহল ডেকে আনে মিডিয়াকে, মনোযোগ আকর্ষণ করে অন্য ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টদের,পরিবেশ সংরক্ষণবিদদের, সচেতন করে তোলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের। তারা গ্রেটার কথা শুনতে আসে এবং ধীরে ধীরে গ্রেটার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাকিটা ইতিহাস। ‘ক্লাইমেটের জন্য শুক্রবার’ এই ট্যাগলাইনে প্রত্যেক শুক্রবার ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমে আসে– প্রথমে তার শহরে, পুরো দেশে, ইউরোপের প্রতিবেশী দেশগুলোতে– তারপর সারা পৃথিবীতে। তার নাম ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। ১৫ বছর বয়সে, কয়েক মাস আগের চুপচাপ শান্ত মেয়েটা নির্দ্বিধায় কথা বলে ইউনাইটেড নেশনসে, ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’-এ। তার দেওয়া স্পিচ পৌঁছে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। ২০১৯-এর ১৯ মার্চ, এক শুক্রবার পৃথিবীর ১৫০টি দেশের স্কুলের অজস্র ছাত্রছাত্রী পথে নেমে আসে তাদের নিজেদের গভর্মেন্ট এবং বাকি সমস্ত দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত পলিসিদের আমূল পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে। সেপ্টেম্বর মাসের এক শুক্রবার পথে নামে সারা পৃথিবীতে প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ।
গ্রেটার অবদানকে বলা হয়, ‘ইউরোপের পরিবেশ আন্দোলনে ঘটা এ শতকের শ্রেষ্ঠ ঘটনা’।
আমরা এবং আমাদের পূর্ববর্তী বেশ কয়েক জেনারেশন আমাদের বাসভূমি এই গ্রহকে কখনও রোজকার প্রয়োজনে, কখনও ছোট আরাম, নিশ্চিন্তির জন্য, আবার কখনও– যখন আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে ‘একটাই তো জীবন– বাঁচার মতো করে বাঁচি’ এই আদর্শে শুষে, কামড়ে, ছিঁড়ে,পুড়িয়ে শেষ করে এনেছি– সম্পূর্ণ অপরিণামদর্শিতায়। কখনও কারণে, কখনও সম্পূর্ণ বিলাসিতায়। আমরা গত প্রায় অর্ধেক শতক ধরে জানি, ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর, উষ্ণতা বাড়ছে, জল এবং হাওয়া– দুটোই দূষিত, কিন্তু এখনও অবধি পৃথিবীর সমস্ত দেশে সম্মিলিতভাবে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা আসলে মারণব্যাধির ওপরে ব্যান্ড-এইড লাগানো ছাড়া আর কিছুই না! তাহলে কি আমরা আসলে স্বার্থপর? যেহেতু আমরা থাকব না আগামী ৫০-১০০ বছর পর্যন্ত, তাই টিভিতে দেখা বিজ্ঞাপনের মতো, ছুটে আসা দৈত্যের মতো ট্রেনের সামনে থেকে আমি দৌড়ে পালিয়ে যাই, কিন্তু পড়ে থাকে আমার সন্তান, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? নাকি আমাদের বয়স, অভিজ্ঞতা আমাদের ভেতর থেকে প্রথমেই বলে দেয় যে, আসলে এই ‘ক্লাইমেট ক্রাইসিস’ সমস্যাটার এত মাত্রা, এত স্তর, এত গভীর, দেশভেদে এটা এত আলাদা যে, সেটার সমাধান নিয়ে চিন্তা করাটাই একটা সম্পূর্ণ অপরিণামদর্শিতা? তবে ব্যক্তিগতভাবে গ্রেটাকে দেখে আমার মনে প্রশ্ন উঠেছিল যে, কীভাবে একটা ছোট্ট মেয়ে তার সমস্ত মনোসংযোগ, একনিষ্ঠতা এবং তার সমস্ত সময় এই একটা বিষয়কে দিয়ে দিয়েছে যখন তার স্কুল, বন্ধু, হবি, স্পোর্টস, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় কাটানোর কথা।
গ্রেটা, ‘টেড টক’-এ দেওয়া তার স্পিচে এই বিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল। গ্রেটার ব্রেন সাধারণ মানুষের মতো কাজ করে না, যেহেতু গ্রেটার ‘অ্যাসপারগার্স সিনড্রোম’ আছে, যেটা কি না অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডারের একটা অংশ। এই সিনড্রোমের মানুষরা, গ্রেটার মতে, সাধারণত খুব একাগ্র হয় এবং তার মতো মানুষরা যখন একটা সমস্যা দেখতে পায়, সেটা তাদের কাছে খুব সাদা-কালো সমস্যা। তারা জীবনের ধূসর অঞ্চলটা প্রায় বোঝে না। সে একটি বক্তৃতায় বলে যে, তার মতো মানুষ, যার এই সিনড্রোম আছে, তাদের কাছে বেঁচে থাকা বা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামটা সম্পূর্ণ সাদা-কালো। এর মধ্যে কিছু ধূসর নেই, মাঝামাঝি কোনও পথ নেই। হয় আমরা পারব সভ্যতার এই সংকট থেকে রক্ষা পেতে, নয় পারব না– বিলুপ্ত হয়ে যাব। তাই যখন সে একটা ব্যানার সম্বল করে স্কুল না গিয়ে, সকলের অমতে একা সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে পড়ে– তার কাছে আর কোনও পথ ছিল না।
এখনও তার সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। একটা ভূখণ্ডকে ক্রমাগত আক্রমণ করে, খাদ্যের উৎস বন্ধ করে দিয়ে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে তার অধিবাসীদের। মৃত মানুষদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু। আর বাকি পৃথিবী সাক্ষী থাকছে এই ভয়ানক ঘটনার। গ্রেটার কথায়, পৃথিবীর জলবায়ু দূষিত করে দেওয়ার জন্য এর থেকে বেশি সংকটপূর্ণ কী আর হতে পারে? তাদের ফ্লোটিলা ধরা পড়েছে ইজরায়েলি সেনার হাতে, ইজরায়েলের জেলে থাকাকালীন ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জল চাইলেও দেওয়া হয়নি বন্দিদের, গ্রেটাকে সবসময় ইজরায়েলের পতাকা জড়িয়ে রাখতে বাধ্য করা হয়েছিল। খাদ্য,পানীয়হীন জেলে তাকে নিরন্তর অশ্লীল সম্বোধন করা হয়েছে, তার সুটকেসে লিখে দেওয়া হয়েছে কদর্য শব্দ– গ্রেটার কথায় সুইডিশ পাসপোর্টধারী শ্বেতাঙ্গ মহিলার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে, প্যালেস্টাইনের বন্দিদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে!
তার নিজের দেশের সমর্থন যদি না-ও থাকে, গ্রেটা এই লড়াই চালিয়ে যাবেন, কারণ সেই একই। রাজনীতি, কূটনীতির চোখে এই সমস্যা ধূসর– কিন্তু গ্রেটার কাছে সাদা-কালো। একটা জাতিকে না খেতে দিয়ে মারতে দেওয়ার মধ্যে কোনও ধূসর জায়গা নেই। সেটা সম্পূর্ণ অন্ধকারময়। গ্রেটা আর তার মতো মানুষরা যেন আমাদের মনুষ্য জাতির অবশিষ্ট বিবেক-সমস্ত সংকীর্ণতা, ভীরুতা, আত্মমগ্নতার অন্ধকারের সামনে দীপ্ত মশালের মতো জ্বলজ্বল করছে। আমরা যদি না পারি, সেই আলোয় এগোক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। প্রশ্নে, প্রতিবাদে-নিজেদের মতো করে। আমরা তো ধূসর থেকে ধূসরতর করে তুলেছি আমাদের পৃথিবী, এবার পৃথিবী একটু সাদা-কালো হোক।
…………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা
…………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved