ইতিমধ্যেই বিহারের বিশেষ নির্বাচনী সংশোধনী সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর যা পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। একে তো প্রাথমিক ধাপে ৬৫ লক্ষ মানুষের বাদ পড়ার বিষয়টা আছে, যার মধ্যে অধিকাংশই মহিলা। জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে বাদ দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। রাজনৈতিক দলের বুথ-স্তরীয় কর্মীদের উপেক্ষা করা হচ্ছে সেই অভিযোগও এসেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নির্বাচন কমিশন একরকম বলছে, আর বাস্তবে করছে অন্যরকম। তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী যাঁরা নথিপত্র জমা করেছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে কমিশনের তরফ থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। যাঁদের পাঠানো হয়েছে, তাঁরা মূলত সংখ্যালঘু মহিলা। বোঝাই যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন প্রায় হিসেব করে মূলত কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরোধীদের জেতা আসনগুলোর ভোটারদের বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে এই কাজটা করে চলেছেন।
রুবিনা বিবি, বিয়ের আগে নাম ছিল রুবিনা খাতুন, গত কয়েকদিন ধরে ভোর না হতেই বহরমপুর কোর্টে লাইন দিচ্ছেন– একটা দশ টাকার স্ট্যাম্প-পেপার কেনার জন্য। তাঁর উকিলও চেষ্টা করছেন ওই দশ টাকার স্ট্যাম্প-পেপার বেশি দামে কেনার জন্য, কিন্তু পাওয়াই যাচ্ছে না। রুবিনা বিবি যে বিয়ের আগে রুবিনা খাতুন ছিলেন এবং দু’জনে যে একই ব্যক্তি, তার জন্য একটি দশ টাকার স্ট্যাম্প-পেপারে প্রথম শ্রেণির বিচার বিভাগীয় ম্যজিস্ট্রেটের কাছ থেকে শংসাপত্র জোগাড়ের জন্য দিন নেই রাত নেই খাওয়া নেই দাওয়া নেই চেষ্টা করে চলেছেন রুবিনা খাতুন কিংবা রুবিনা বিবি; কারণ নির্বাচন কমিশনের নতুন ফরমান। শোনা যাচ্ছে, বিহারের মতো বাংলাতেও নাকি বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হবে এবং সেখানে যে ভোটারদের নতুন তালিকা তৈরি হবে, তাতে যদি নাম না থাকে তাহলে বে-নাগরিক হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে রুবিনার মতো বহু মানুষের।
শুধু বিষয়টা রুবিনা বিবিদের মতো সংখ্যালঘু মহিলাদের হবে এমনটাও নয়। এই একই ছবি দেখা যাচ্ছে, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসত জেলা দায়রা আদালতে। সেখানে যাঁরা মূলত ওই শংসাপত্রের জন্য ছোটাছুটি করছেন তাঁরা বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী জেলার মতুয়া বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যেও মহিলাদের সংখ্যা বেশি। মালদা এবং মুর্শিদাবাদের জেলা আদালতে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভিড় চোখে পড়ছে, বারাসত এবং কৃষ্ণনগরে তেমনই মতুয়া মানুষজনদের দেখা যাচ্ছে। সোমা ঠাকুর বা দীপক মিত্রদের মতো মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে এই দেশে এসেছেন এবং পরবর্তীতে এই দেশে থেকে গেছেন। কোনও কোনও মহিলারা এসে এখানে বিয়ে করেছেন, তাঁদের সন্তান হয়েছে। কিন্তু আজকে তাঁরাই অত্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। বুঝতে পারছেন না নির্বাচন কমিশনের এই নতুন ফরমানে আদৌ তাঁদের নাগরিক বলে গণ্য করা হবে কি না।
মিউনিসিপালিটি অফিস, গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তর কিংবা আদালতের চত্বরে শুধু একটাই আলোচনা, একই কাজ চলছে। কেউ নতুন করে জন্মের শংসাপত্র করাচ্ছেন; কেউ বানান ভুল ঠিক করাচ্ছেন; কেউ বা আবার জন্মের শংসাপত্র যাতে ডিজিটাইসড হয়, সেই প্রযুক্তির খোঁজ করছেন। অনেকে হয়তো ভাবছেন, রাজনৈতিক প্রচার শুনে ভাবছেন– নির্বাচন কমিশনের এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে সবচেয়ে বিপাকে পড়বেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং মুসলমান মানুষজন। কিন্তু ঘটনাচক্রে যাঁরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন তাঁদের গরিষ্ঠাংশ কিন্তু সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়েরই মানুষ। যাঁরা এই নির্বাচন কমিশনের নতুন ফরমানে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছেন মহিলারা এবং তা দু’-সম্প্রদায়েরই। এবং তাঁদের বেশিরভাগই অত্যন্ত গরিব এবং পিছিয়ে পড়া মহিলা।
ইতিমধ্যেই বিহারের বিশেষ নির্বাচনী সংশোধনী সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর যা পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। একে তো প্রাথমিক ধাপে ৬৫ লক্ষ মানুষের বাদ পড়ার বিষয়টা আছে, যার মধ্যে অধিকাংশই মহিলা। জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে বাদ দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। রাজনৈতিক দলের বুথ-স্তরীয় কর্মীদের উপেক্ষা করা হচ্ছে সেই অভিযোগও এসেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নির্বাচন কমিশন একরকম বলছে, আর বাস্তবে করছে অন্যরকম। তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী যাঁরা নথিপত্র জমা করেছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে কমিশনের তরফ থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। যাঁদের পাঠানো হয়েছে, তাঁরা মূলত সংখ্যালঘু মহিলা। বোঝাই যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন প্রায় হিসেব করে মূলত কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরোধীদের জেতা আসনগুলোর ভোটারদের বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে এই কাজটা করে চলেছেন।
এই আবহাওয়ার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলার মানুষদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছেন, ‘কাউকে কোনও তথ্য দেবেন না’। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের যে কাজটি করে চলেছে বিহারে, তা যে ত্রুটিমুক্ত নয়, তা শাসক থেকে বিরোধী কিংবা যে কোনও সাধারণ মানুষও একবাক্যে স্বীকার করবেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই বিষয়ে মামলা চলাকালীন বিচারপতিরাও নানা অসংগতি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু যেহেতু এই প্রক্রিয়াকে আদালতের তরফে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়নি, তাই এই প্রক্রিয়া চলছে। যদিও বারবার তাঁরা বলেছেন, যদি বহু মানুষ এই প্রক্রিয়ায় বাদ যান তাহলে তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করবেন, কিন্তু এখনও অবধি নানা অভিযোগ উঠলেও তাঁরা বাতিল করেননি এই প্রক্রিয়া। শেষ দিন তাঁরা বলেছেন, এই অভিযোগ নেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত নয়, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, তাই এই কাজ চলবে।
সব মিলিয়ে মানুষের উৎকন্ঠা উদ্বেগ রোজ বেড়েই চলেছে এবং তা শুধু বিহারে নয়, এই বাংলাতেও যে তা বাড়ছে তার উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দার আত্মহত্যা করে মৃত্যু এবং তাঁর পরিবারের বয়ান দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিটি মানুষই উদ্বেগে আছেন। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের একেকদিন একেক ফরমান অন্যদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই বয়ান, এর মাঝে রাজ্যবাসীর কী করণীয়? যদিও কোনও কাগজেই যে কিছু প্রমাণ করা যাবে না, তা সবাই বুঝতে পারলেও সারা রাজ্যে ‘কাগজ’ তৈরি করার এই হিড়িক দেখে সত্যিই ভয় হচ্ছে, আরও কত আত্মহত্যা দেখতে হবে এই রাজনৈতিক চাপানউতোরের মাঝে! তার মধ্যেই আবার কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সব রাজ্যে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ তৈরি করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে বিপদ বাড়ল ‘বাংলাভাষী শ্রমিক’দের। বলা হয়েছে, শুধুমাত্র যদি সন্দেহ হয়, একজন বাংলায় কথা বলা মানুষ ‘বাংলাদেশী’ তাহলে একজন কনস্টেবল পর্যায়ের পুলিশ আধিকারিকও সেই ব্যক্তিকে ওই ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ আটকে রাখতে পারেন। এর ফলে যে এই বাংলা থেকে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া অসংখ্য শ্রমিকেরা আরও অসুবিধায় পড়বেন তা বলাই বাহুল্য।
বিহারে বিরোধীরা এই নির্বাচনী সংশোধনী প্রক্রিয়ার একভাবে বিরোধিতা করছেন, এই রাজ্যের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন বারবার বলে চলেছেন যে এই প্রক্রিয়া আসলে ঘুরপথে নাগরিকত্ব হরণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার বিরোধ যদি করতেই হয় তা বিরাট গণ আন্দোলন করেই করতে হবে, কিন্তু সেই রাজনৈতিক গণ আন্দোলনের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হবে না তো? এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণ দেশবাসী তো পাশার ঘুঁটি নন, তাঁরা তো ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হতে পারেন না। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে সাধারণ মানুষকে সেই তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে না। বিদেশিদের শনাক্ত করার নামে, দেশের মানুষদের নাম যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে, সেটাই নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা। বিহারে যেমন হয়েছে, তেমনটা যদি বাংলাতে হয়, তাহলে রুবিনা খাতুন কিংবা কোনও সীমান্তবর্তী জেলার মানুষদের হয়রানি বাড়বে ছাড়া কমবে বলে মনে তো হচ্ছে না। তাই শুধু কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের শাসক নয়, সমস্ত রাজনৈতিক দলের উচিত এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করা। শাসক ও বিরোধীদলগুলোর কি উচিত নয়, মানুষের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের অবসান করার মতো সদর্থক কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved