Robbar

একটি বানান ভুল কেড়ে নিতে পারে মানুষের জীবনও

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 3, 2025 7:52 pm
  • Updated:November 3, 2025 9:13 pm  

কোচবিহারের দিনহাটার খাইরুল শেখ দেখেছেন, তাঁর নাম ২০০২ সালের কমিশন প্রদত্ত নির্বাচক তালিকায় আছে, কিন্তু সেই নামের বানানে ভুল আছে। কেউ যদি অভিযোগ করেন, বা কমিশনের বিএলওদের মধ্যে এই প্রশ্ন ওঠে যে ২০০২ সালের খাইরুল শেখ আর আজকের ২০২৫ সালের ব্যক্তি এক নন, তাহলে তো তাঁর নাম নতুন খসড়া তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে। এই আতঙ্কে তিনি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এখন কেউ বলতেই পারেন, যে এই আশঙ্কা অমূলক এবং এইরকম হওয়ার কোনও কারণ নেই, কিন্তু চারিদিকের যা পরিবেশ পরিস্থিতি, তাতে এই আশঙ্কা অমূলক বলা যায় কি?

সুমন সেনগুপ্ত

বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেছে। বিহারের পরে বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধনের কাজ শুরু হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা জুড়ে। সমস্ত গণমাধ্যম বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যতই আশ্বাসবাণী দেওয়া হোক না কেন, এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে কোনও বৈধ নাগরিকের কোনও ভয়ের কারণ নেই, কিন্তু মানুষের মনের ওপর তো কারও নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই সে কীভাবে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা কেউ জানে না। চায়ের দোকান, অফিস, আদালত, দোকান-বাজারে একটাই আলোচনা– ‘কিছু হবে না তো?’ ‘আমার নাম থাকবে তো?’ সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, কে আর অন্যের কথা ভাবে।

মিউনিসিপালিটি অফিস, গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তর কিংবা আদালতের চত্বরে শুধু একটাই আলোচনা, একই কাজ চলছে। কেউ নতুন করে জন্মের শংসাপত্র করাচ্ছেন, কেউ বানান ভুল ঠিক করাচ্ছেন, কেউ কেউ জন্মের শংসাপত্র যাতে ডিজিটাইজড হয়, সেই প্রযুক্তির খোঁজ করছেন। অনেকে হয়তো রাজনৈতিক প্রচার শুনে ভাবছেন নির্বাচন কমিশনের এই সংশোধনীতে সবচেয়ে বিপাকে পড়বেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং মুসলমান মানুষজন, কিন্তু ঘটনাচক্রে যাঁরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাঁদের গরিষ্ঠাংশ কিন্তু সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়েরই মানুষ। যাঁরা এই নির্বাচন কমিশনের নতুন ফরমানে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছেন মহিলারা এবং তা দু’-সম্প্রদায়েরই এবং তাঁদের বেশিরভাগই অত্যন্ত গরিব এবং পিছিয়ে পড়া মহিলা। বীরভূমের বিভিন্ন স্কুলে রীতিমতো ভিড় হচ্ছে, স্কুলে যে তাঁরা ওই সময়ে পড়েছিলেন, সেই সংক্রান্ত শংসাপত্র যদি এখনকার প্রধান শিক্ষক লিখে দেন। এই ভিড়ের কিন্তু কোনও ভেদাভেদ নেই। এঁদের বেশিরভাগই মাধ্যমিক পাশ করেননি। এ দেশে সেই সংখ্যাটা কত, নির্বাচন কমিশন তার হিসেব রাখে? কতজন মহিলা সম্পত্তির মালিক, কতজনের জন্ম সার্টিফিকেট আছে, কেউ খবর রেখেছেন বা রাখতে চান? কতজনের জাতিগত সংশাপত্র আছে? কী বলবেন এই মেয়েদের, সবাই ঘুসপেটিয়া! সবিতা বাউরি, সাজিদা খাতুন, বুদিন মুর্মু– সবাই?

পার্লামেন্টে এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এঁদের কিছু নেই। শুধু আছে হাড়ভাঙা খাটুনি, ঘরে এবং বাইরে, এই মহান সভ্যতা টিকে আছে তার ওপর।‌ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়– কী দিয়েছেন এই মানুষদের, যে আজ কাগজ চাইছেন? শুধু মহিলাই বা বলি কী করে! পুরুষদেরও তো বহুবিধ সমস্যা। কোচবিহারের দিনহাটার খাইরুল শেখ দেখেছেন, তাঁর নাম ২০০২ সালের কমিশন প্রদত্ত নির্বাচক তালিকায় আছে, কিন্তু সেই নামের বানানে ভুল আছে। কেউ যদি অভিযোগ করেন, বা কমিশনের বিএলওদের মধ্যে এই প্রশ্ন ওঠে যে ২০০২ সালের খাইরুল শেখ আর আজকের ২০২৫ সালের ব্যক্তি এক নন, তাহলে তো তাঁর নাম নতুন খসড়া তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে। এই আতঙ্কে তিনি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এখন কেউ বলতেই পারেন, যে এই আশঙ্কা অমূলক এবং এইরকম হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু চারিদিকের যা পরিবেশ পরিস্থিতি, তাতে এই আশঙ্কা অমূলক বলা যায় কি?

ছোটবেলা থেকে ব্যাকরণ বইতে লেখা থাকে, প্রপার নাউন বা নামবাচক বিশেষ্যর ক্ষেত্রে বানানের বদল করা যায় না; কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটা পরিহাসের পর্যায়ে চলে গেছে। যাঁরা এই বিভিন্ন সরকারি কাজের নাম তোলার ক্ষেত্রে যুক্ত থাকেন, তাঁদের বেশিরভাগের কোনও একটি নাম, তার বানান বা অর্থ সম্পর্কে এতটাই কম জ্ঞান যে, যাই হোক কিছু লিখে তিনি তাঁর দায়িত্ব খালাস করেন। পরবর্তীতে এই সংক্রান্ত নানা জটিলতা তৈরি হয়, তারপরে আদালত থেকে হলফনামা বের করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাতে হয় যে, একই ব্যক্তির নামের দুটো বানান আছে। সাধারণত এই বিষয়ে তেমন কোনও অসুবিধা এতদিন হয়নি, কিন্তু আজকের এই ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর আবহে, প্রতিটি মানুষের নামের বানান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিহারে চলছে এসআইআর-এর কাজ

যাঁরা মূলত এই কাজে যুক্ত থাকেন, তাঁরা ঠিকা কর্মী, মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষদেরই এই কাজে বেছে নেওয়া হয়। এমনিতে তাঁদের দায়িত্বও কম, লক্ষ্যমাত্রাও থাকে দ্রুত কাজ শেষ করার। সুতরাং কোনও নামের বানানে যে ভুল থাকবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তার মধ্যে ‘হিন্দু’ নামের সঙ্গে যাও বা পরিচিতি আছে, মুসলমান বা দলিত নামের সঙ্গে সেই সমস্ত করণিকদের পরিচিতি কম থাকার কারণে, তাঁদের নামের ক্ষেত্রে বানান ভুল হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। তাই ‘খাইরুল শেখ’ অজান্তেই ‘খায়রুল শেখ’ হয়ে যান। আসলে হিন্দু মধ্যবিত্তের মুসলমানদের নামের মানে, নামের বানান সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। তাঁরা জানেই না, তাঁর এতদিনের প্রতিবেশী মুসলমান শিশুর নামকরণের একটি অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সন্তানদের মুখেভাতের অনুষ্ঠানের অনেকখানি মিল পাওয়া যায়। শিশুর জন্মের ৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। একটি শিশুর জীবনের সম্ভাব্য সব রকমের বিপদ থেকে মুক্তির জন্য, একটি পশু বলি দিয়ে তার ৩ ভাগের ১ ভাগ অতি দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার নাম ‘আকিকা’। প্রতিবেশী মুসলমান মানুষের জীবনের এই সমস্ত ছোটখাটো আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে মধ্যবিত্ত মানুষের স্বেচ্ছা অজ্ঞতা থেকেই শুরু হয় অপরায়নের প্রক্রিয়া। ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ রোপণ হয়ে যায় এক অংশের মানুষের মধ্যে। তাই জেনে অথবা না জেনে খাইরুল শেখের নাম লেখার ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যায়। সেই মানুষটিকে তখন দোরে দোরে ঘুরতে হয়, নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে। কীটনাশক খেতে হয় আতঙ্কে।

অথচ খাইরুল নামের অর্থ হল শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম বা কল্যাণকর। এটি একটি আরবি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ভালো’ বা ‘কল্যাণ’। প্রায়শই এটি ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ’ বা ‘শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তার সঙ্গে খায়রুল নামের হয়তো ফারাক নেই, শুধু উচ্চারণ এবং বানানের তফাত আছে। কিন্তু যাঁরা নির্বাচনের নাম তোলার কাজে যুক্ত তাঁদের কতজনই বা জানেন এই বিষয়টা? আমাদের মধ্যে কতজনই বা জানি এই নামের অর্থ? আচ্ছা, মুসলমান নামের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। ‘বর্ণশ্রেষ্ঠ’ ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই ‘মুখার্জি’ লেখেন, আবার অনেকেই ‘মুখোপাধ্যায়’ লেখেন, কেউ বা ‘ব্যানার্জি’-কে ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ বা ‘চ্যাটার্জি’-কে ‘চট্টোপাধ্যায়’ লিখে থাকেন। কিন্তু একজন ব্যক্তির অনেক নাম বা পদবি হলে তো মানুষটাও আলাদা হয়ে যেতে পারেন। কেউ ‘দাস’ লেখেন, আবার কেউ ‘দাশ’– তাহলে কি দুটো মানুষ আলাদা হয়ে যাবেন রাষ্ট্রের চোখে?

কোচবিহারের চাষি খাইরুল শেখ

কোচবিহারের খাইরুল শেখের তাঁর নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার ভয় যে গ্রাস করেছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এই ভয়ের কোনও নাম কি মনস্ত্বত্ত্ববিদেরা এখনও দিতে পেরেছেন? রাষ্ট্র কি তা মেনে নিয়েছে? তাহলে এই ভয়ের প্রতিকার কী? একজন মানুষ তাঁর রক্ত, ঘাম দিয়েছেন এই মাটির জন্য, জীবনের উপান্তে এসে যদি তিনি জানতে পারেন, যে এই দেশটা তাঁর নয় এবং তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি এই দেশের নাগরিক, তাহলে তাঁর কেমন লাগতে পারে? রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারক বা নির্বাচন কমিশনের আমলারা কি এই মনের সূক্ষ্ম দিকটা পড়তে পারেন? দেশ তো শুধু মাটি, জল আর জমি নিয়ে নয়। সেই মাটিতে, জমিতে যাঁরা থাকেন বা থেকেছেন সেই মানুষদের নিয়েও তৈরি। সেই মানুষদের বাদ দিয়ে কি দেশের অগ্রগতি হতে পারে? সেই মানুষদের বাদ দিয়ে কি শুদ্ধ ভোটার তালিকা তৈরি করা সম্ভব, নাকি তাঁদের কাছে উদাহরণ বিহার বা আসাম? যেখানে এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে এবং নাগরিক পঞ্জীকরণের প্রক্রিয়াতে যথাক্রমে ৮০ লক্ষ এবং ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে? সুতরাং শুধু ভীত হবেন না বললে কি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?