এ-দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মরতা মহিলাদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে গবেষণাটি বলছে যে, এদেশের প্রতি তিনজনে একজন মহিলা নাইট শিফটে ডিউটি করতে ভয় পায়। কারণ, তাঁরা শারীরিক নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তবুও, সেসব উপেক্ষা করেই এদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মেয়েরা রাতে কাজ করে চলেন; অক্লান্তভাবে। আরজি করের এই নৃশংস ঘটনা হয়তো তাদের অনেককেই কুঁকড়ে দেবে, দুমড়ে দেবে তাদের স্বপ্ন দেখার সাহসকে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস।
‘…এবং তাঁর যোনির কাছ থেকে আমি একটি মাথার ক্লিপ ও ভাঙা চশমা পেয়েছি।
তাছাড়া, ১) তাঁর দু’চোখ দিয়ে রক্তপাত, ২)মুখ থেকে রক্তপাত, ৩) মুখে এবং নখে আঘাতের চিহ্ন, ৪) যৌনাঙ্গ থেকে রক্তপাত, ৫) বাঁ-পায়ে ক্ষত, ৬) পেটে আঘাতের চিহ্ন, ৭) বাঁ-পায়ের গোড়ালির ওপর আঘাতের চিহ্ন, ৮) ঘাড়ে আঘাতের চিহ্ন, ৯) ডান হাতের মধ্যমায় আঘাতের চিহ্ন, ১০) ঠোঁটের ওপর আঘাতের চিহ্ন। এছাড়াও, কার্পেটের ওপর অনেকগুলি চুল পাওয়া গেছে। তাঁর রক্ত গড়িয়ে পড়েছে নীল কার্পেটে। বিকেল ৪.৪০-এ প্রাথমিক পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ করে এই রিপোর্টটি তৈরি করা হল প্রত্যক্ষদর্শীদের সামনে।’
৯ আগস্ট, ২০২৪। আর জি কর মেডিকেল কলেজের এমারজেন্সি বিল্ডিং-এর চেস্ট ডিপার্টমেন্টে প্রাথমিক পর্যেষণার পর তৈরি ‘ইঙ্কোয়েস্ট রিপোর্ট’-এর পৃষ্ঠা তিন ও চারের বঙ্গানুবাদ এটি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে আরেকটু।
যাঁর রিপোর্ট, তিনি এমবিবিএস; এমডি (পিজিটি)। আর জি কর হাসপাতালের ডাক্তার ও ছাত্রী। টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পরও গত পরশু রাত দুটো অবধি রোগী দেখেছিলেন। মা-কে ফোনে বলেছিলেন, ‘তোমরাও খেয়ে নাও’। তারপর রাত দুটো নাগাদ খেতে গেছিলেন নিজে।
হাসপাতালে কর্তব্যরত (অন-কল) ডাক্তারদের আলাদা বিশ্রাম-এর জায়গা ছিল না। তাই ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করা ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে তিনি গেছিলেন তিনতলার সেমিনার হলে। শুয়ে পড়েছিলেন মেঝের নীল কার্পেটের ওপরেই। আসলে এই ঘরটিকে বড় নিরাপদ ভেবেছিলেন তিনি। কারণ, আলাদা ঘর নেই বলে হাসপাতালের মহিলা ডাক্তাররা এখানে এসেই বিশ্রাম নেন। এমনকী পোশাকও পরিবর্তন করেন এই ঘরেই। হয়ত সেইজন্যেই বেছে নিয়েছিলেন এই ঘরটিকে। ভেবেছিলেন, কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ভোর হলেই আবার যাবেন ডিউটিতে।
আচ্ছা, এতবড় মেডিকেল কলেজে কোনও বিশ্রামের জায়গা ছিল না কেন? মেডিকেল কলেজের জাতীয় নির্দেশিকা ঘেঁটে দেখলাম, কর্তব্যরত (অন-কল) ডাক্তারদের জন্যে আলাদা কোনও ঘরের ব্যবস্থা করার কথা তাতে বলাও নেই। দেখলাম, ডাক্তারদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে মোটের ওপর কোনও কথাই আসলে তাতে বলা নেই!
সকালবেলা ডিউটিতে তার খোঁজ পড়ল। খুঁজতে খুঁজতে সেমিনার ঘরে এসে দেখা গেল পড়ে আছে তাঁর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত দেহ। ওপরের পোশাক ছিন্নভিন্ন, নিচের পোশাক খোলা; অন্তর্বাসের সঙ্গে তা পড়ে রয়েছে পাশে।
বলা হল, ‘তিনি সুইসাইড করেছেন।’ হ্যাঁ, এমন অবস্থায় পাওয়ার পরও, ঠিক এমনটাই জানানো হল। হ্যাঁ, ‘ইঙ্কোয়েস্ট রিপোর্ট’-এর দু’নম্বর পাতায় যে অবস্থার বর্ণনা দিয়ে পরে বলা হবে, ‘শি ওয়াজ ইন হাফ নেকেড কন্ডিশন’, সেই অবস্থায় পাওয়ার পরও, প্রথমে ঠিক এমনটাই জানানো হয়েছিল। সহ-ডাক্তারদের ব্যাপক প্রতিবাদে বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা না-হলে সম্ভবত এটিই সত্যি বলে ধরে নেওয়া হত।
আচ্ছা, হাসপাতালে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না? ছিল, কিন্তু সেমিনার হলে নয়। কারণ মেডিকেল কলেজের জাতীয় নির্দেশিকায় সেমিনার হলে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর কথা বলা নেই। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ঘরটিতে মেয়েরা পোশাক পরিবর্তন করতেন বলে তাদের নিরাপত্তার খাতিরেই নাকি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়নি সেখানে!
এমন ‘নিরাপদ’ বলয়ের মধ্যেই তিনি খুন হলেন। সম্ভবত, ধর্ষিত হয়ে। আরও সম্ভবত গণধর্ষিত হয়ে।
তিনি বাবা-মা-র একমাত্র সন্তান।
তিনি মাত্র ৩১ বছরের যুবতী।
তিনি আরজি কর হাসপাতালের ছাত্রী ও ডাক্তার।
তিনি এমবিবিএস, এমডি (পিজিটি)।
তিনি শুধু ডাক্তারি ডিগ্রিই লাভ করেননি, বিশ্বাস করেছিলেন শপথ নেওয়া ‘হিপোক্রাটিক ওথ’-এও– ‘…into whatsoever houses I enter, I will enter to help the sick.’ (যেখানেই যাই, সেবা দিয়ে যাব)। তা না-হলে ৩৬ ঘণ্টা টানা চিকিৎসা করার পর রাত দুটোয় ডিনার সেরে মেঝেতে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে, ভোর থেকে আবার পেশেন্ট দেখার পরিকল্পনা করা যায় না। আসলে এমনটাই তাঁর স্বভাব ছিল। শান্ত, বিনয়ী অল্পেতেই খুশি আর সংসারের বিরুদ্ধে অভিযোগহীন।
…………………………………………………………
হাসপাতালে কর্তব্যরত (অন-কল) ডাক্তারদের আলাদা বিশ্রাম-এর জায়গা ছিল না। তাই ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করা ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে তিনি গেছিলেন তিনতলার সেমিনার হলে। শুয়ে পড়েছিলেন মেঝের নীল কার্পেটের ওপরেই। আসলে এই ঘরটিকে বড় নিরাপদ ভেবেছিলেন তিনি। কারণ, আলাদা ঘর নেই বলে হাসপাতালের মহিলা ডাক্তাররা এখানে এসেই বিশ্রাম নেন। এমনকী পোশাকও পরিবর্তন করেন এই ঘরেই। হয়ত সেইজন্যেই বেছে নিয়েছিলেন এই ঘরটিকে। ভেবেছিলেন, কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ভোর হলেই আবার যাবেন ডিউটিতে।
…………………………………………………………
এসব জানলাম তাঁর অর্থোডন্টিকের থেকে। ডাক্তারবাবু জানালেন, ওই বয়সী আর পাঁচটি মেয়ের মতোই দাঁতের সেটিং আরেকটু নিখুঁত করতে এসেছিলেন তিনি। ‘সামনে বিয়ে করবে নাকি? নইলে এত বছর পর দাঁতের এমন সামান্য ফাঁক তো কেউ বোজাতে আসে না!’– মনে মনে ভাবেন অর্থোডন্টিক। তবু পেশাদারিত্বের খাতিরে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেন না সে-সব কথা। তবে আজ এমন দিনে সেসব বেরিয়ে আসে অনর্গল হয়ে। বাঁধভাঙা জলের মতো।
আরজি কর হাসপাতালের সামনে ঠিক এমনই বাঁধভাঙা জনতার ভিড়। মিছিলে দাঁড়িয়ে আমার মতো তাঁরাও ভাবছে একটাই কথা, একজন কর্তব্যরত ডাক্তার, মাত্র ৩১ বছর বয়সী একটি মেয়ে, রাত দুটোর সময়, ৩৬ ঘণ্টা টানা ডিউটি শেষ করার পরও কি একটি নিভৃত বিশ্রামকক্ষের দাবি রাখেন না? দাবি রাখেন না একটু নিরাপত্তার? ভাবছে, এই নির্মমতা যে বা যারা করল, তারা এই একই আকাশের নিচে বাঁচে? শ্বাস নেয় এই বাতাসেই?
আচ্ছা, এদেশের ফ্যাক্টরি আইন ১৯৪৮- এ যে আলাদা বিশ্রামাগার, বসার জায়গা এমনকী প্রয়োজনে জামাকাপড় ধোওয়া, রাখা এবং শুকোতে দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে? ‘শপ অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট’-এ যে মহিলাদের জন্যে নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা, কাজের মাঝে বিশ্রাম-সহ একাধিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে, সেসব তবে কি?
সেসব কিচ্ছু না। বিশ্বাস করুন, কিচ্ছুটি না। ক-দিন আগে ‘অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বারস অফ কমার্স’ -এর একটি গবেষণাপত্র পড়ছিলাম। এ-দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মরতা মহিলাদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে গবেষণাটি বলছে যে, এদেশের প্রতি তিনজনে একজন মহিলা নাইট শিফটে ডিউটি করতে ভয় পায়। কারণ, তাঁরা শারীরিক নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তবুও, সেসব উপেক্ষা করেই এদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মেয়েরা রাতে কাজ করে চলেন; অক্লান্তভাবে।
………………………………………………..
আরও পড়ুন শতাব্দী দাশ-এর লেখা: আসুন, রাতের দখল নিই
………………………………………………..
আরজি করের এই নৃশংস ঘটনা হয়তো তাদের অনেককেই কুঁকড়ে দেবে, দুমড়ে দেবে তাদের স্বপ্ন দেখার সাহসকে। বিশেষত, এতকিছুর পরেও যখন আঙুল ওঠে সেই মেয়েদের দিকেই। প্রশ্ন ওঠে, রাতবিরেতে একা মেয়ে কেন বিশ্রাম নিতে যাবে নিভৃতকক্ষে?
এসব শুনে ভাষা হারাই। কবিগুরুর গান মনে পড়ে যায়;
‘এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে॥
হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে।’
রাজ্য, প্রশাসন, আইন সেসব কিছুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। কিন্তু সে সবকিছুর পাশাপাশি নিজেকেও আয়নার সামনে দাঁড় করান। প্রতিবিম্বের সামনে প্রশ্ন তুলুন; অন্তরের এই অসুরকে রুখবে কে, যদি অন্তরাত্মা না-জাগে প্রাণে?
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved