
মাউস কিংবা কি-বোর্ড নড়াচড়ার মাধ্যমে যে কাজের পরিমাপ করা হয়, সেখানে কাজের আগে কাজের পরিকল্পনা কিংবা নানা উদ্ভাবনী ভাবনার সুযোগ কোথায়? ভাবনা, যা কি না মানবসভ্যতার কাণ্ডারী, যার জোরে সে বিশ্বের আর সকল প্রাণীর থেকে উন্নততর, সেই ক্রিয়াটিকেই ‘নিষ্ক্রিয়’ আর কেবলমাত্র কাজ সম্পাদনের সময়টাকেই ‘সক্রিয়’ ভাবার অর্থ কি মানুষের সঙ্গে মেশিনকে এক করে দেখা নয়?
বিশ্বসেরা বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থা ‘দ্য সার্কেল’-এ চাকরি পেয়ে মেই হল্যান্ড ভাবল, এতদিনে জীবনের একটা মানে দাঁড়াল তাহলে। কলেজ বন্ধু অ্যানি অ্যালারটোনকে আরও একবার মনে মনে ধন্যবাদ জানাল, সারাজীবন অ্যানির কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে সে। ওর সুপারিশ ছাড়া কিছুতেই এ চাকরি পেত না মেই।
প্রথম দিন অফিসে ঢুকে তার মনে হল, ‘ইউটোপিয়া’ শব্দটাকে চুন-বালি-সুরকি দিয়ে বাঁধলে বোধ করি এমনটাই দেখতে হবে। এলাহি সব ব্যবস্থাপনা, দেখলে চোখ টেরিয়ে যায়! কিন্তু তার মতো শান্ত, লাজুক মেয়ে কি পারবে এমন আপাদমস্তক টেকনোলজিতে মোড়া বিশ্বমানের কোম্পানিতে টিকে থাকতে? তার ওপর আবার মেই-র জীবনে এঁটুলির মতো জুড়ে রয়েছে মার্সার। প্রাক্তন প্রেমিক। যদিও সম্পর্কটা খাতায় কলমে ‘প্রাক্তন’, কিন্তু পুরোপুরি অতীত হয়নি এখনও।
মেই-র সঙ্গে সম্পর্ক চুকলেও মার্সার নিজে থেকেই আসে তার অসুস্থ বাপ-মার খোঁজ নিতে। আর আসলেই ‘দ্য সার্কেল’ নিয়ে দু’-চার কথা শুনিয়ে যায় সে। কোম্পানিটা নাকি আদ্যন্ত জালি; কর্মীদের কাজের পরিবেশ সুরক্ষিত করার নামে অফিসের সর্বত্র ক্যামেরা গুঁজে দিয়ে আসলে কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে চায়। কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি চালিয়ে, তাদের কাজকর্ম, গতিবিধি, চিন্তাভাবনা সবকিছু জেনে নিয়ে, তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা, কর্মীস্বাতন্ত্র্য, নাগরিক অধিকারের মতো যা কিছু মানুষকে যন্ত্রের থেকে আলাদা করে, তাই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কোম্পানিটি।

মে-র অবশ্য আপত্তি নেই এসবে। ‘দ্য সার্কেল’-এ ঢুকে নানা জাগতিক বাস্তবতা আত্তীকৃত করেছে সে। শিখেছে যে, আমার সবকিছু অন্য কেউ দেখতে চাওয়ার অর্থ হল, আমি ক্রমশই একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছি। বুঝেছে যে, বিশ্বায়নের যুগে মানুষের লক্ষ্যই হল, তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সভ্যতার উন্নয়নের পথটি সুগম করা। ঠিক যেমনটা তার কোম্পানি করছে ‘সোলসার্চ’ নামের সফটওয়ারটি বানিয়ে। এতে কারও অনুমতি ছাড়াই যে কোনও মুহূর্তে, যে কোনও মানুষের লোকেশন ট্র্যাক করে, তাকে ড্রোন দিয়ে ধরে ফেলা যাবে। ফলে গোটা পৃথিবীটা মানুষের আরও হাতের মুঠোয় চলে আসবে। মার্সার এসব বোঝে না। মেই ভাবে, সম্পর্কটা চুকে গিয়ে ভালোই হয়েছে। এই সব পুরনো দিনের বস্তাপচা মানসিকতার লোকজনের সঙ্গে কিছুতেই সে থাকতে পারত না।
‘সোলসার্চ’ লঞ্চিং-এর দিনটি ছিল ঝড়ের মতো। লাইভ ট্র্যাকিং-এর ডেমো দেখানোর জন্য মেই সেদিন বেছে নিল মার্সারকেই। মার্সার তখন বহু দূরে। তবু সফটওয়ার দিয়ে সহজেই ট্র্যাক করা গেল তাকে। ড্রোন ছুটল মার্সারের পিছনে। আর মার্সার এই আচমকা ধরপাকড় থেকে বাঁচতে, প্রাক্তন প্রেমিকার প্রযুক্তির নজরদারি থেকে বাঁচতে, একটা সর্বগ্রাসী, টোটালিটেরিয়ান ভবিষ্যৎ পৃথিবীর হাত থেকে বাঁচতে, খাড়াই থেকে গাড়ি চালিয়ে দিল নিচে। উঠল না আর!
মার্সারকে মারল কে? প্রাক্তন প্রেমিকা মেই হল্যান্ড? একটা আইটি কোম্পানির প্রোজেক্ট? নাকি অবিরাম মনিটরিংকেই স্বাভাবিক ভেবে ফেলা বর্তমান পৃথিবীর আপনি আমি সবাই? দু’দিন আগের সেই লাজুক, শান্ত মেই হল্যান্ড কিন্তু ব্যাপারটাকে দেখল নিছক কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবেই। ততদিনে কোম্পানির বলা ন্যারেটিভে অন্ধবিশ্বাস করেছে সে। তার জীবনে এখন আর ‘ব্যক্তিগত’ বলে কিছু নেই। নিরন্তর নজরদারিকেই আজকাল তার স্বাভাবিক মনে হয়। এই যে কেউ তাকে অবিরাম দেখছে, দেখছে আর দেখেই চলেছে– এটাই এখন তার বেঁচে থাকার প্রেরণা।

মেই-র বন্ধু অ্যানির জীবনটাও ঠিক এইরকমই ছিল। ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না কোম্পানির নজরদারি জেনে নিল তার গভীর গোপন কিছু পারিবারিক তথ্য। আর এই একটি ঘটনাই ছিন্নভিন্ন করে দিল অ্যানির জীবন। গল্পের শেষ দৃশ্যে তাই মেই বসে আছে হাসপাতালে, অ্যানির কোমায় চলে যাওয়া শরীরটার পাশে। যদিও ততদিনে তার মনুষ্যোচিত সকল চেতনা, অনুভূতি, আবেগ কিংবা বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। একটা টোটালিটেরিয়ান কোম্পানির দাসত্ব করতে করতে সে নিজেই আজ সর্বগ্রাসী সত্তার নিপুণ সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে। জার্মান লোকগল্প ফাউস্ট কিংবদন্তির শয়তানের দাস মেফিস্টোফিলিসের কাছে সে তার আত্মা বেচে দিয়েছে; ক্ষমতা আর নজরদারির নিত্যনতুন জ্ঞান আহরণের বিনিময়ে। হাসপাতালে মেই তাই আজ আর তার বন্ধুকে দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছে কেবল তার পাশে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে বন্ধুর ব্রেন ওয়েভটুকু। আর ভাবছে, অচিরেই তার কোম্পানির নজরদারির ক্ষেত্র হওয়া উচিত মানুষের ব্রেনের ভিতর। সরাসরি।

ডিসটোপিয়ান উপন্যাসের লেখকরা কী করে যে এমন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন কে জানে! নইলে মাত্র এক দশক আগে, ২০১৩ সালে ডেভ এগার্স-এর লেখা এই উপন্যাস ‘দ্য সার্কেল’ আজ অক্ষরে অক্ষরে এমনভাবে মিলে যায় কী করে? এগার্সের দ্য সার্কেল কোম্পানির ‘সোলসার্চ’ সফটওয়ারের মতোই, আজকের একটি বহুজাতিক আইটি কোম্পানি তার কর্মীদের ওপর কড়া নজরদারির উদ্দেশ্যে সম্প্রতি একটি সফটওয়ার চালু করেছে ‘প্রোহান্স’। কম্পিউটারের সামনে বসে কর্মীরা কাজ করছে কি না, এবার থেকে এই সফটওয়ার তা মেপে নেবে মাউস এবং কি-বোর্ডের নড়াচড়া থেকে।

টানা পাঁচ মিনিট মাউস বা কি-বোর্ড না নড়লে সেই কর্মীকে ‘নিষ্ক্রিয়’ এবং ১৫ মিনিট তা না নড়লে কর্মীকে ‘কাজের জায়গায় অনুপস্থিত’ ধরে নেওয়া হবে। আর এই ব্যবস্থা নিয়ে কর্মীরা যাতে বিক্ষোভ না দেখায়, তাই ডেভ এগার্সের কোম্পানিটির মতো এই সংস্থাটিও তার কর্মীদের মগজধোলাই করেছে। বুঝিয়েছে, যে এই নজরদারি আদৌ কর্মীদের কাজের মূল্যায়নের জন্য নয়, বরং কোম্পানির নিজের সম্ভাব্য উন্নতির ক্ষেত্রগুলিকে খুঁজে বের করার জন্যেই! সঙ্গে এ-ও বলেছে যে, পূর্বসম্মতি ব্যতীত কোনওভাবেই এই সফটওয়ারটি কোনও কর্মীর ওপর ব্যবহার করবে না তারা। কী ভাবছেন, তাহলে আর চিন্তা কী? হ্যাঁ, উক্ত কোম্পানিটি এ-বিষয়ে তার কর্মীদের সম্মতি নিচ্ছে ঠিকই, তবে কি না ট্রেনিংয়ের সময় একটি অত্যাবশ্যক ফর্ম ফিলাপে এই সম্মতিপ্রদানকে বাধ্যতামূলক করেছে তারা।
এই দ্বিচারিতার পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রশ্ন জাগে মনে। যেমন, মাউস কিংবা কি-বোর্ড নড়াচড়ার মাধ্যমে যে কাজের পরিমাপ করা হয়, সেখানে কাজের আগে কাজের পরিকল্পনা কিংবা নানা উদ্ভাবনী ভাবনার সুযোগ কোথায়? ভাবনা, যা কি না মানবসভ্যতার কান্ডারি, যার জোরে সে বিশ্বের আর সকল প্রাণীর থেকে উন্নততর, সেই ক্রিয়াটিকেই ‘নিষ্ক্রিয়’ আর কেবলমাত্র কাজ সম্পাদনের সময়টাকেই ‘সক্রিয়’ ভাবার অর্থ কি মানুষের সঙ্গে মেশিনকে এক করে দেখা নয়?

দ্বিতীয়ত, প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর কর্মী-হাজিরা কর্মক্ষেত্রে যে চূড়ান্ত অবিশ্বাসের কর্মসংস্কৃতির জন্ম দেয়, তা কি আদৌ আমাদের লক্ষ্য হতে পারে, না হওয়া উচিত? নিয়োগকর্তা এবং কর্মচারীর মধ্যে এই পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক কী করে কোনও সংস্থাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের দিকে নিয়ে যাবে, সেও এক বিরাট প্রশ্ন। সঙ্গে এ-ও প্রশ্ন জাগে যে, এই ধরপাকড় প্রক্রিয়া কি আদপে কাজ করার বদলে কাজের ভান করাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছে না?
তৃতীয়ত, বেশি কাজ মানেই যে ভালো কাজ নয়, একথা আমরা বুঝব কবে? কাজের পাশাপাশি কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত অথবা যুক্ত নয়, এমন নানা বিষয়ে পড়াশুনা, আলোচনা, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কর্মবিরতি এবং কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাও যে কর্মক্ষেত্রের নিতান্ত প্রয়োজনীয় শর্তাবলি, শত গবেষণালব্ধ প্রমাণের পরেও আমরা তা মানতে চাই না।

আর সর্বোপরি, আজকের পৃথিবীর এই সারবত্তাহীন, সর্বগ্রাসী নজরদারির কর্মসংস্কৃতি কি মেধা, মনন এবং উৎকর্ষতার বদলে ‘দ্য সার্কেল’ গল্পের প্রোটাগনিস্ট মেই হল্যান্ডের মতোই শ্রমনিষ্ঠ কর্মীবৃন্দের আড়ালে বস্তুত কিছু আবেগহীন রোবটেরই জন্ম দেয় না? যারা প্রেমিককে সফটওয়ার টেস্টিং-এর গিনিপিগ ভাবে, আর বন্ধুকে পরবর্তী প্রজেক্টের রিসোর্স? যারা কোম্পানির উন্নতির লক্ষ্যে মানবসভ্যতার মানবতাটাকেই খুন করে ফেলে, সেই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে এরপরেও কি আমরা নির্মাণ করে চলব?
………………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন প্রহেলী ধর চৌধুরী-র অন্যান্য লেখা
………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved