
এমন একটা সময় ছিল যখন গ্লেনারি’স-এর পানশালা ছিল ইংলিশ পাব। মৃদু সংলাপে কিংবা নীরবে, কিংবা বিমর্ষ বেদনায় মদ খাওয়ার অনন্য জায়গা। ঢুকলে মনে হত, এলস হোয়ার! এখানে নয়। অন্য কোনওখানে! মনে হত লন্ডন খুব কাছেই। যেদিন থেকে নাচ-গান ঢুকল, নষ্ট হল নিবিড়তা, গ্লেনারি’স তার বার-বার্তা হারাল আমার কাছে।

দু’-দুটো শীত চলে গেল। বাড়ি ফিরতে পারিনি। পাইনি কুয়াশার গন্ধ। পাইনি ঘরের মধ্যে মেঘ ঢুকে আসার আকাশ-শৃঙ্গার। পাইনি তুষার-গুঁড়ি নিঃসঙ্গ ক্রিসমাস। পাইনি ছুরিমারা শীতের সন্ধ্যায় ফায়ারপ্লেস থেকে কিছু দূরে শুঁড়িখানার বিষণ্ণ কোণে সস্তা হুইস্কির বুকজ্বলা তাপন। এই শীত আসতে-না-আসতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে। অথচ এ বছরেও বাড়ি ফেরা হবে কি না, জানি না। বাড়ি ফিরতে চাওয়ার অসহ্য তাড়না। বাড়ি ফিরতে না-পারার অসহনীয় বেদনা। এই দুয়ের সংবেদী সংরাগে তৈরি হয় রোম্যান্টিক নস্টালজিয়া, বুঝিয়েছেন অসামান্য ব্যাখ্যায় মিলান কুন্দেরা, তাঁর ‘ইগনরেন্স’ উপন্যাসে: Nostos is the Greek word for return. Algos means suffering. So nostalgia is the suffering caused by an unappeased yearning to return.

বুকের শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার শীতের বাড়িতে ফেরার জন্য। কবে যে ফিরতে পারব, কোনও হদিশ নেই এখনও! সেই হতাশ বেদন ও মনকেমনের মধ্যে খবর পেলাম, তিন মাসের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল শৈলশহর দার্জিলিংয়ের হার্ট: গ্লেনারি’সের একাংশ! দার্জিলিংয়ের কুয়াশা গায়ে মেখে। প্রবল শীতের বিষণ্ণ মেঘ ও আকাশ জানলায় নামিয়ে এনে। কখনও কখনও হুইস্কির টেবিলে রাঙা ছাতার ওপর তুষার-গুঁড়ির ক্রিসমাস গিফ্ট উপুড় করে দিয়ে। দার্জিলিংয়ের কত শীত এসেছে আমার এত বছরের জীবনে!

গ্লেনারি’স বন্ধ আবগারি আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগে! এই নারকীয় ধাক্কা খুলে দিল আমার এত বছরের কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি! হুড়মুড় করে শীতের দার্জিলিঙে ঢুকে পড়ল আমার একান্ত, সরানো জীবনের কত কোহল! কত হলাহল। আমার দার্জিলিং-স্মৃতিতে তারা সাপের সঙ্গমের মতো জড়িয়ে। আলাদা করা যায় না কেন? এত ভালোবাসি শীতের দার্জিলিং? কেন ভালোবাসি ছুরিমারা হাওয়া? কেন ভালোবাসি ডিসেম্বরের দার্জিলিংয়ের ঘন কুয়াশা? জানলায় নেমে এসে, সন্ধেবেলায় ভিজে অসতীর মতো জড়িয়ে ধরে ডিসেম্বর-কুয়াশার শেমিজপরা মেঘ শোওয়ার ঘরের বিছানায়। আমি যে এই অসতী যাচনায় হুইস্কি প্রণয়নে খুলে রেখেছি চিলতে শার্শি!

মধ্য-জানুয়ারির দার্জিলিং অনেক অন্যরকম। ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার– সব গত। আর কোনও উৎসব নেই। বাচ্চাদের নিয়ে ফ্যামিলি আহ্লাদের হিড়িক শেষ হয়েছে। দার্জিলিংয়ের কুয়াশা আর কুহক চিনতে আসতেই হবে জানুয়ারির দার্জিলিংয়ে। কিছুক্ষণ আগেই আমার অতি প্রিয় এক সতীর্থকে বলছিলাম, তোমার সঙ্গে জানুয়ারিতে দার্জিলিং যাবই, যাব। কেন বারবার মধ্য জানুয়ারির দার্জিলিং?
প্রেম-বিয়ে-প্রেম-বিয়ে ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে অবশেষে বুঝলাম, এই সঙ্গহীনতার বিউটি বুঝতে আরও একবার, না, না, বহুবার, যেতেই হবে, মধ্য জানুয়ারির দার্জিলিংয়ে। একা হওয়ার মধ্যে বেদনার যে নিহিত ঐশ্বর্য আছে, সেটা বুঝিয়ে দেয় দার্জিলিংয়ের মাঝ-জানুয়ারি। লন্ডনেও ঠিক তাই। রবীন্দ্রনাথ কেন লেখেননি ইংল্যান্ড এবং দার্জিলিংয়ের শীতের কুয়াশায়, নিঃসঙ্গতার বেদনার মধ্যে, জেগে উঠতেই পারে ঘন মেরুন লিপস্টিকের ঠোঁট? এতবার গিয়েছেন লন্ডনে, দার্জিলিংয়ে, মংপুতে। কখনও লেখেননি তো জুতোর ফিতে বাজেটের সরাইখানা এবং শুঁড়িখানায় মধ্যে শীতের উজানে তপ্ত আদরের কথা! হয়তো পাননি জীবনের সেই পরম দান? সে যে কী সুন্দর, কী করে বোঝাই!

আরও একবার ফিরছি বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্লেনারি’স প্রসঙ্গে। এমন একটা সময় ছিল যখন গ্লেনারি’স-এর পানশালা ছিল ইংলিশ পাব। মৃদু সংলাপে কিংবা নীরবে, কিংবা বিমর্ষ বেদনায় মদ খাওয়ার অনন্য জায়গা। ঢুকলে মনে হত, এলস হোয়ার! এখানে নয়। অন্য কোনওখানে! মনে হত লন্ডন খুব কাছেই। যেদিন থেকে নাচ-গান ঢুকল, নষ্ট হল নিবিড়তা, গ্লেনারি’স তার বার-বার্তা হারাল আমার কাছে। আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ে, যে সময়ে হিমশীতল দার্জিলিং থেকে কুয়াশার পর্দা সরিয়ে ঢুকে যেতাম কেক আর প্যাটিস আর কফি আর মদের গন্ধে মম করা শব্দহীন মগ্ন পানশালায়, যেখানে যে যার নিঃসঙ্গ নিলয় পেত টেবিলে একা কিংবা মুখোমুখি। এখন দার্জিলিংয়ে গেলে, সে যত শীতের দার্জিলিং হোক না কেন, সকালে জিন অ্যান্ড টনিক, সন্ধ্যায় হুইস্কি নিয়ে প্রিয় পানশালার ছাদে বসি রঙিন ছাতার তলায়। যে স্মৃতি কলকাতায় রাবার দিয়ে মুছে ফেলা পেনসিলের দাগ, সেই স্মৃতি মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে কী স্পষ্ট অবয়বে জেগে ওঠে। ডিপ ফ্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে রক্তমাংসে জীবন্ত হয়ে ওঠে আমার অতীত দার্জিলিংয়ের পানশালায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তাকে। সেই হাসি। সেই দীপিত আঁখিপাত। শুনতে পাই সেই কণ্ঠস্বর, সংলাপ। টেবিলের নিচে অনুভব করি সেই ফুটসি, সেই শিহরন।
মনে আছে সেই দুপুর। আমরা গ্লেনারি’স-এর ছাদে জানুয়ারির শেষের দিকে। হু হু শীত নীল করে দিচ্ছে আঙুলের ডগা। হঠাৎ সে বলল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ছাদে শুধু আমরা দু’জন। আর কেউ নেই। সবাই চলে গিয়েছে নিচে রুম-হিটারের ওমে। শুধু একটা মিশ কালো বেড়াল আকাশ পানে তাকিয়ে ছাদে। এই উদ্বিগ্ন নিঃসঙ্গতার সুযোগে তার ক্রপকরা চুলের ঘাড়ে একটা চুমু খাই। তখনও বিয়ে করিনি তাকে। তবু এই মেয়ের সবটুকু চেনা। কিন্তু মনে হয় এই প্রথম চুমু খেলাম তাকে। এই হল দার্জিলিংয়ের মহিমা!

পুরনো নতুন হয়ে যায় এই শৈলশহরে। আচ্ছা, শহরেও কি বিয়ে বাসি হয়ে যায়? ভেঙে যায় মনের সখ্য?
দুপুর তিনটে হবে। হঠাৎ নামে মধ্যরাত। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আকাশের সব আলো। কেমন যেন ভয় করে আমাদের। আমি চুমুক দিই জিন অ্যান্ড টনিকে। সে ব্র্যান্ডিতে। আর ঠিক তখনই ঘটে ঘটনাটা। আলোহীন কালো আকাশ ফেটে পড়ে ধবল তুষারে। লক্ষ লক্ষ শিউলি নিঃশব্দে নেমে আসতে থাকে ছাদের ওপর, রাঙা ছাতার ওপর। কালো বিড়ালটা মুহূর্তে সাদা হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড কিছু ভাবে। তারপর উধাও হয় সিঁড়ি দিয়ে।
আমরা হাতে হাত রাখি। আমাদের বিয়েটা বাসি হয়ে মরে গেল একদিন। দার্জিলিংয়ের সেই তুষারপাত আমার মধ্যে এখনও মরেনি।
…………………….
রোববার.ইন-এ পড়ুন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা
…………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved