প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার মূলে জায়নবাদী আন্দোলন। যে আন্দোলন লাগাতার প্যালেস্তিনীয়দের ভিটেমাটি ছাড়া করছে। যার সাম্প্রতিকতম বহিঃপ্রকাশ হল, হামাস হামলার পর ইজরায়েলের রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হুংকার, ‘এবার আমরা পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্রটাই বদলে দেব।’ এর মানে, গাজা ভূখণ্ডের হয়তো অস্তিত্বই থাকবে না। ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে হয়তো চলে যেতে হবে সব প্যালেস্তিনীয়কে।
জেরুজালেমে পৌছনোর পর ওখানকার তৎকালীন মেয়র আমাদের অর্থাৎ ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘কেমন লাগছে বিচিত্র এই শহরটিকে? আপনারা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই টের পেয়েছেন যে, এই শহরের প্রতিটি মানুষ পিঠে তিন হাজার বছরের একটি ইতিহাস নিয়ে ঘোরে! আপনারা হয়তো লক্ষ করেছেন যে-কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই সে কীভাবে ‘কিং ডেভিড’ এবং ‘কিং সলোমন’-এর প্রসঙ্গ তুলে কথা শুরু করে! এইরকম শহর বিশ্বে আর কোথাও পাবেন?’’
জেরুজালেমে এক সপ্তাহ কাটিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম কতটা সত্যি মেয়রের কথা। বাইবেলে বর্ণিত খ্রিস্টপূর্ব ১০১০ বছর আগে ইহুদিদের রাজা ডেভিড ফিলিস্তিনি দানব গোলিয়াথকে হত্যা করে জেরুজালেমের পত্তন করেছিলেন। ডেভিডের পুত্র সলোমনের হাত ধরে জেরুজালেমকে ঘিরে উন্মেষ ঘটেছিল ইহুদি জাতীয়তাবাদের। জেরুজালেমে যাঁর সঙ্গেই ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যা নিয়ে কথা হত, তিনি সেই শুরু করতেন তিন হাজার বছর আগের ইতিহাস থেকে, রাজা ডেভিডের প্রসঙ্গ টেনে। এক শুভানুধ্যায়ী বলেছিলেন, এটাই হল জায়নবাদ। এই জায়নবাদ যতদিন না নির্মূল হবে, ততদিন ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান খুঁজতে না যাওয়াই ভালো।
কাশ্মীরে গিয়ে শুনেছিলাম কাশ্মীরিয়তের কথা। বলা হয়, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মূলে উপত্যকার বাসিন্দাদের এই কাশ্মীরিয়তের ভাবধারাই কাজ করে। প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার মূলে জায়নবাদী আন্দোলন। যে আন্দোলন লাগাতার প্যালেস্তিনীয়দের ভিটেমাটি ছাড়া করছে। যার সাম্প্রতিকতম বহিঃপ্রকাশ হল, হামাস হামলার পর ইজরায়েলের রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হুংকার, ‘এবার আমরা পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্রটাই বদলে দেব।’ এর মানে, গাজা ভূখণ্ডের হয়তো অস্তিত্বই থাকবে না। ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে হয়তো চলে যেতে হবে সব প্যালেস্তিনীয়কে।
জেরুজালেমে পৌঁছনোর পর আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য হিসেবে দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিখ্যাত ‘ইয়াদ ভাসেম’ মিউজিয়াম। হলিউডের কিংবদন্তি পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গের পরিকল্পনায় যে মিউজিয়ামে হিটলারের নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিপীড়নের ইতিহাস অবিশ্বাস্যরকম জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। কার্যত ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ধরা হয়েছে ইহুদি নিধনযজ্ঞ তথা হলোকাস্টকে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকে পুনর্নিমাণ করা হয়েছে অসম্ভব দক্ষতায়। এই মিউজিয়াম থেকে বেরতে হয় এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে। গ্যাস চেম্বারের মুখে পড়ে থাকা শিশুদের ছোট ছোট জুতো আক্ষরিক অর্থেই দর্শনার্থীদের মধ্যে কান্নার রোল তোলে। যে রাষ্ট্র প্রতি মুহূর্তে এইভাবে হলোকাস্টের স্মৃতি উসকে দিতে চায়, আজ তারাই যখন গোটা গাজা ভূখণ্ডকে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করেছে, তখন বড় বিস্ময় লাগে!
আরও পড়ুন: সেই চুম্বন আজও গালে লেগে রয়েছে
৭ অক্টোবরের হামাসের হামলাকে ইজরায়েল হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করছে। বলা হচ্ছে, হিটলারের হলোকাস্টের পর আর কখনও নাকি একসঙ্গে এত ইহুদিকে হত্যা করা হয়নি। হয়তো এই দাবি সত্য। হামাসের হাতে একদিনে ১৪০০ ইজরায়েলি তথা ইহুদির হত্যা নিশ্চিত এক জঘন্য সন্ত্রাসবাদী কাজ। কিন্তু তারপর থেকে গাজার বুকে গত তিন সপ্তাহ ধরে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের যে হত্যালীলা চলছে, তাও তো মানবতার ইতিহাসে বিরল। এই ক’দিনে যে হাজার আটেক প্যালেস্তিনীয় প্রাণ হারিয়েছে তার অর্ধেক শিশু। প্যালেস্তিনীয় শিশুর মৃত্যু কি হলোকাস্ট বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতি উসকে দেয় না? আর কত প্যালেস্তিনীয়র প্রাণ গেলে ইজরায়েল গাজায় বোমা বর্ষণ বন্ধ করবে, তা এখনও অস্পষ্ট। রাষ্ট্র সংঘে ১২০টি দেশ মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির পক্ষে প্রস্তাব নিলেও নেতানিয়াহু গোটা বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখাতে কসুর করছেন না। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত তাঁদের যুদ্ধাভিযান চলবে।
দোদুল্যমান অবস্থা ভারতের। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ভারসাম্যের কূটনীতির কথা। ভারত একদিকে যেমন প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে, তেমন অন্যদিকে হামাসের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পক্ষে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণসভায় আনা প্রস্তাবে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশের সঙ্গে ভোট দিতে ভারতের অনীহা কেন? নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাছে জুতসই জবাব নেই। এটা কি আমেরিকাকে খুশি করার চেষ্টা? নাকি ইজরায়েলে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা? রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিও বিজেপির মাথায় রয়েছে। ইজরায়েলের পক্ষ নিয়ে দেশে মেরুকরণের চেষ্টাও আছে। কিন্তু সংখ্যাগুরু হিন্দুদের কি কখনও জায়নবাদীদের সঙ্গে এক সরলরেখায় আনা সম্ভব?
আবার অশোধিত জ্বালানি তেলের জন্য আরব দেশগুলোর ওপর ভারতের নির্ভরতাও রয়েছে। সে কারণে মোদিকে প্যালেস্তিনীয় অথরিটির প্রেসিডেন্টকেও ফোন করতে হয়। গাজায় ত্রাণের লরি পাঠাতে হয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। তিন হাজার বছরের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করার পথে কি মানবসভ্যতা, আজ প্রশ্ন সেটাই।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved