Robbar

পাকিস্তানের সংস্কৃত-চর্চা প্রমাণ করে দেয় ভাষা আসলে ধর্ম-নিরপেক্ষ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 26, 2025 8:37 pm
  • Updated:December 27, 2025 12:24 am  

একটা সময় অবিভক্ত ভারতে রোজগারের তাগিদে, ফারসি শেখার ধূম পড়েছিল, ইংরেজি শেখার ধূম পড়েছিল। ধর্ম তুলে কথা বলতে হচ্ছে দুঃখের সঙ্গেই, মুসলমানদের মধ্যে গোঁড়া লোকেরা ও ধার মাড়াননি বলে তাঁদের অনেক প্রজন্মকে ভুগতে হয়েছে। আজকে যখন একটা মৃত ভাষার সঙ্গে নতুন করে আবার সম্পর্ক করছেন, তার কাছ থেকে শুধু স্বাদ নিয়ে আর একটু গোড়ায় ফিরে যাবেন বলে, এর থেকে আনন্দের কিছু নেই।

সোমনাথ শর্মা

কিছুদিন আগে আমাদের বহুল প্রচারিত একাধিক দৈনিকে খবর বেরিয়েছে– পাকিস্তানে সংস্কৃত পড়ানো হবে, লাহোরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একে পাকিস্তান তার ওপর সংস্কৃত, তা নিয়ে প্রতিবেদন– একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর! তবু একটা ভালো দিক, ভারতে এঁদের নামে খবর হয় বোম-যাত্রীর ডায়েরি হিসেবে, এবারে সংস্কৃতের সূত্রে ওমযাত্রীর ডায়েরি হল। উদ্দেশ্য সাধু, শুনছি ‘গীতা’ পড়ানো হবে, ‘রামচরিতমানস’ পড়ানো হবে। কী যে ভালো হত যদি ‘রামচরিতমানস’ শেষ করে ওখানকার বাঙালি ছেলেমেয়ে ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’-র মতো শিবরামচরিতমানস পড়ত। ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।’ কেউ কেউ নেচে উঠেছেন, গীতা-রামায়ণ-মহাভারত পড়ে যদি ওদিকের মানুষের চেতনা ফেরে। হিন্দিভাষীরা একটা সুন্দর কথা বলেন, আপনে গিরেবানমে ঝাঁক-কে দেখিয়ে। আপাতত কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা যাক।

শ্রীমদ্ভাগবত গীতা, অর্জুন এবং কৃষ্ণ

ছোটবেলায় পদ পরিবর্তন মুখস্থ করার চোটে এখনও ভুলিনি বহিষ্কার-বহিষ্কৃত, তিরস্কার-তিরস্কৃত, পুরস্কার-পুরস্কৃত, সংস্কার-সংস্কৃত। এই ভাষাটা সংস্কার অর্থাৎ ক্রমাগত পরিষ্কার হতে থেকেছে একদল পণ্ডিত বুদ্ধিমান মানুষের হাত ধরে। তাই ভাষাটার নাম সংস্কৃত। একচেটিয়া কোনও দেশের সেই অর্থে কপিরাইট নেই ভাষার ওপরে। ফলে পাঁচতলা একতলা নেই। বর্তমানে পাকিস্তানিরা যা শিখবেন বলে মনস্থ করছেন, তা তাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা। এতে তাদের কলার তোলার ব্যাপার থাকলেও, আমাদের হাততালির কিছু নেই। দেখার বিষয় ‘গীতা’ পড়ে ওঁরা অর্জুনের বিষাদটুকু ধরতে পারছেন কি না, যে প্রশ্নের সম্মুখীন কৃষ্ণকে হতে হয়েছিল, সে প্রশ্নগুলোর উত্তর ওঁরা নিজের মতো করে খুঁজে পাচ্ছেন কি না! গীতা ঘটক আর গীতা দে ওঁদের কপালে নেই, ‘গীতা’-র মতো একটা টেক্সটই সই। আর একটা সময় অবিভক্ত ভারতে রোজগারের তাগিদে ফারসি শেখার ধূম পড়েছিল। ভারতচন্দ্রকে ঠেলায় পড়ে ফারসি শিখতে হয়েছিল। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের লেখায় রাশি রাশি ফারসি।  ব্রিটিশরা আসার পর ইংরেজি শেখার হুজুগও পড়েছিল। ধর্ম তুলে কথা বলতে হচ্ছে দুঃখের সঙ্গেই, মুসলমানদের মধ্যে গোঁড়া লোকেরা ও ধার মাড়াননি বলে তাঁদের অনেক প্রজন্মকে ভুগতে হয়েছে। আজকে যখন একটা মৃত ভাষার সঙ্গে নতুন করে আবার সম্পর্ক করছেন, তার কাছ থেকে শুধু স্বাদ নিয়ে আর একটু গোড়ায় ফিরে যাবেন বলে, এর থেকে আনন্দের কিছু নেই। আর সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে আজকের যে ভারতের ভাষা– তার সম্পর্ক হচ্ছে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো করে বললে: সংস্কৃত বাংলার অতি অতি অতি অতি অতি অতিবৃদ্ধপ্রপিতামহী। ‘আরব’ কথার মানে বাক্পটু, এককালে তাদের এই পটুত্বের চোটে মাটিতে পা পড়ত না। রীতিমত লোককে নিচু চোখে দেখত তারা– যেন বাংলা ভাষা লিখেই বলে দেয়, আমরা আরবি, আমাদের মতো কথা বলতে পারবি? তাদের পা যখন ভারতের মাটিতে পড়ল, তাদের কল্যাণে আমাদের বাংলা তথা ভারতীয় ভাষাগুলো অনেকক্ষেত্রে ইমিউনিটি পেল। ভাষার এমনই জোর, আরবিতে ‘মখমল’ বলে একটা শব্দ আছে, ‘মজবুত’ বলেও একটা শব্দ আছে, ‘জল্লাদ’ বলে একটা শব্দ আরবিরা দিয়েছে, ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দটাও আরবিদের কাছ থেকেই পাওয়া। অবশ্য বিসমিল্লাহর ‘সানাই’ ফারসি শব্দ। পাকিস্তানের যে রাষ্ট্রভাষা– তা উর্দু, এই উর্দু আদি অকৃত্রিম সনাতনী ভারতীয় ভাষা। ভাষার এইসব ছলনেই তো ভুলি। যেটুকু জল মিশেছে ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়– আরবি ফারসি তুর্কি সংস্কৃতে, উর্দুতেও তাই মিশেছে। সে জলটুকু ভাষার শরীরে ঢুকে ভাষাকে বেগবান করেছে। হিন্দিভাষী ভারতীয়রা ‘জল’কে বলে ‘পানি’, উর্দুভাষী পাকিস্তানিরাও ‘জল’কে বলে ‘পানি’। পানি যদি হিন্দি বা উর্দু তবে স্কুল, লাইব্রেরি, মন্দিরের জলের জায়গায় পানীয় জল লেখা থাকে কোন দুঃখে? মূল সংস্কৃত ‘পা’ ধাতুর সঙ্গে ‘অনীয়’ প্রত্যয় জুড়ে ‘পানীয়’। উর্দুকে একটা সময় ‘রেখতা’ বলা হত, রেখতা মানে মিশ্রণ। পারস্যের লোকেরা বোধহয় পূর্ববঙ্গের লোকেদের মতো ‘স’ কে ‘হ’ বলত। সেই ভানুর কমেডি স্কেচে ছিল, পিসি ভানুকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, দেখিস ‘সোনা’ রে ‘হোনা’ কইস না। পারস্যের ‘স’ না-উচ্চারণের চক্করে আমাদের সিন্ধুনদের নাম হল ‘হিন্দুনদ’, সেই সূত্রেই আমরা ‘হিন্দুস্থান’। এই হিন্দুস্থানের সঙ্গে অন্ত্যমিল দেবে বলে দ্বিপদীতে বলা হল, ‘মাংগ রাহা হ্যায় হিন্দুস্থান/ রোজি রোটি অউর মকান’। আশ্চর্য যে ‘রোজ’ ফারসি শব্দ, ‘রোটি’-র মূল সংস্কৃত, আর ‘মকান’ আরবি শব্দ।

উর্দু ভাষায় লেখা নল-দময়ন্তীর আখ্যান

ভাষা আসলে ভাষাগোষ্ঠীর, ধর্মের সঙ্গে ভাষার কোনও যোগ নেই। ভাষা দিবসের দিন, এই ক’-বছর আগেও একজন বিখ্যাত মানুষ এই পশ্চিমবঙ্গে বললেন, ‘আমরা পানি ব্যবহার করি না, দাওয়াত ব্যবহার করি না।’ এখন নিমন্ত্রণ করতে ক’জন পারে, সবাই কি তরুণ মজুমদার! তা বলে কারও দাওয়াত-এ খাওয়াতে কার আপত্তি থাকে, সে তিনতলায় হোক বা দাওয়া-তে বসে। অবশ্য তার কথার উপযুক্ত জবাব তিনি তখনই নগদ বিদায় হিসেবে সর্বোচ্চ স্তর থেকেই পেয়েছেন, এইটা আপাত আশার কথা। এই যে ‘নগদ বিদায়’– এই ‘বিদায়’ শব্দটাও সংস্কৃত, এর অর্থ ‘দান’। আমরা যে অর্থে ‘বিদায়’ বলি, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’– এর মানে যাবার অনুমতি, আরবি ভাষার শব্দ। অত ভেবে কথা বলা যায় না কি! এসব কথা বললে তো বিয়েবাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে এসে ‘এলাহি আয়োজন’ বলা যাবে না! কেননা, মুসলমান বাস-মালিকরা যে অর্থে বাসে ‘এলাহি ভরসা’ লিখে রাখেন, সেই অর্থেই এলাহি আয়োজন বলি। দুটোর মানেই ‘বিরাট’। ধর্মানুসারীরা তো ঈশ্বর আল্লার বিরাটত্ব সম্পর্কে সর্বত্রই একমত। একসময় শুনেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানে ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’-তে সকাল-কে বলি দিয়ে, ‘ফজরে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ পড়াবার ব্যাপার ছিল। দিনকাল যা পড়েছে এখন ওই ওষুধে কাজ হচ্ছে না, ‘উদীচী’ ভাঙা হচ্ছে, ‘ছায়ানট’ ভাঙা হচ্ছে। গানবাজনার ছায়া অবধি দেখা যেন না যায়, ‘ছায়া NOT’। ‘ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যথা।’ 

লাহোরে সংস্কৃত পড়ানোর সময়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অধ্যাপক রশীদ

আদান-প্রদান যে নতুন কিছু তা না। আরাকান রাজসভার কবিরা যে বাংলায় যে কাব্য লিখেছিলেন, সেগুলোর উৎস একটু খুঁজলেই দেখা যায়– অবিভক্ত ভারতবর্ষের কবিদের কবিতার সঙ্গে তার স্পষ্ট যোগসূত্র বর্তমান। এঁদের মধ্যে মুসলমানরাও ছিলেন, তাঁদের কাব্যে কৃষ্ণরাধাও ছিল, হোলিও ছিল। হোলিকে এঁরা ছুঁৎমার্গ হিসেবে দেখেননি, ‘holy’ হিসেবেই দেখেছেন। ‘বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দি পটভূমি’– এই নামে মমতাজুর রহমান তরফদারের একটা খুব প্রয়োজনীয় বই আছে। সেখানে তিনি একটা কথা বলছেন, ‘একথা সহজভাবে বিশ্বাস করা মুশকিল যে মুসলমান কবিগণ সংস্কৃত কাব্যের সঙ্গে সরাসরি যোগ-সূত্র স্থাপন করে প্রাপ্ত কাব্য-রীতিগুলোকে আকস্মিকভাবে সম্প্রসারিত করে নিয়েছেন। কল্পনা না করে উপায় নেই যে কোনো না কোনো নির্ভরযোগ্য মাধ্যম, সংস্কৃত কবিদের সঙ্গে মুসলিম কবি মানসের সেতু রচনায় সহায়ক হয়েছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিলে একথা বলতে হয় যে সংস্কৃত ও আওয়াধী-হিন্দি কাব্য-রীতির মাঝখানে একটা শূন্যস্থান রয়ে গেছে।’

এ-কথাটা তিনি ১৯৭১ সালে বলছেন। এই শূন্যস্থানটা অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এখনও সেটাই চলছে। আজকের উপমহাদেশে সেই সামগ্রিক পরিসর নেই যে, সৈয়দ আলাওলের মতো একজনকে দুম করে আমরা পেয়ে যাব। তবু এই যে চর্চাগুলো নতুন করে শুরু হচ্ছে, এতে বিরাট কিছু সামগ্রিক উপকার হবে না। যে দেশে আটার দাম এত, সে দেশে মহাকাব্য দিয়ে দেশবদল হবে, সেটা ভাবা ‘utter nonsense’ হবে । তবু শূন্য-র থেকে এক ভালো, এই পথে যদি পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হয়, ক্ষতি কী! না হয় আজ পড়বে বাল্মীকি-বেদব্যাসের কাব্য।

…………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন সোমনাথ শর্মা-র অন্যান্য লেখা

…………………………