ফি বছর শীতের আগমন হলেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে। বিশেষত ভোরের দিকে যখন কুয়াশাচ্ছন্নতা থাকে। সড়কে ভোররাতের দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের সজাগ রাখতে জেলা পুলিশ সুপারদের নির্দেশ পাঠান রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ডিজি। ভোররাতের দুর্ঘটনা কমাতে পুলিশের তরফে ট্রাক চালকদের সজাগ রাখতে তাঁদের দাঁড় করিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ানোর দাওয়াই দেওয়া হয়। এতে চালকদের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব যেমন কাটবে, তেমনই গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। সড়কপথে নতুন বন্ধুও জুটবে চায়ের কাপের সঙ্গে, দীর্ঘ সড়কপথের ক্লান্তিও দূর হবে।
নভেম্বর ২০২১-এর এক গভীর রাতে নদিয়া জেলার ফুলবাড়ি এলাকায় একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার পারমদনপুর এলাকার এক বৃদ্ধার মৃতদেহ সৎকার করতে লরিতে করে নবদ্বীপের শ্মশানে যাচ্ছিলেন তাঁর আত্মীয়রা। রাত দেড়টা নাগাদ ফুলবাড়ির কাছে হাঁসখালি-কৃষ্ণনগর রাজ্য সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা পাথর বোঝাই লরিতে ধাক্কা মারে শববাহী গাড়ি। ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে আরও কয়েকজনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। আহতদের শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃতদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ, ৭ জন নারী ও এক শিশু ছিল।
তদন্তের পরে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময়ে রাস্তায় কুয়াশা ছিল। ফলে দৃশ্যমানতাও ছিল কম। তার উপরে ওই অভিযুক্ত ট্রাকের গতি ছিল অনেক বেশি। দুইয়ের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। একই সঙ্গে মনে করা হয়, সেই সময়ে চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন। দুর্ঘটনার পর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন স্থানীয়রা। তাঁরাই প্রথমে উদ্ধারের কাজে হাত লাগান। পরে পুলিশ এসে পৌঁছয় ঘটনাস্থলে।
গাড়ি চালানোর সময় চালকদের ঘুম পাওয়া বহু দুর্ঘটনার কারণ। সড়কে ভোর রাতের দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের সজাগ রাখতে তখন জেলা পুলিশ সুপারদের নির্দেশ পাঠান রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ডিজি। ভোররাতের দুর্ঘটনা কমাতে পুলিশের তরফে ট্রাক চালকদের সজাগ রাখতে তাঁদের দাঁড় করিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ানোর দাওয়াই দেওয়া হয়। এতে চালকদের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব যেমন কাটবে, তেমনই গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। নতুন উদ্যোগ উদ্যোগী হয় পুলিশ।
আদতে, ফি বছর শীতের আগমন হলেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে। বিশেষত ভোরের দিকে যখন কুয়াশাচ্ছন্নতা থাকে।
অক্টোবর ২০২২। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে। একটি লরির সঙ্গে গাড়ির সংঘর্ষে এক শিশু-সহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িটি রায়গঞ্জ থেকে কলকাতার দিকে যাচ্ছিল। নাকাশিপাড়ায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের টোল প্লাজার কাছে সামনের দিক থেকে আসা একটি লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ওই গাড়িটির। দুর্ঘটনার কারণ, ওই জাতীয় সড়কে কাজ চলছিল। কাজ থমকে থাকায় ‘সিঙ্গেল লেন’ দিয়েই গাড়ি চলাচল করছিল।
২০২৩-এর অক্টোবরের ভোর রাতে দেউলটির ফুল মার্কেটে রাস্তার ধারে একটি ছোট পণ্যবাহী গাড়িতে ফুল তোলা হচ্ছিল। সে সময় পিছন দিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই গাড়ির পিছনে সজোরে ধাক্কা মারে। ওই দুর্ঘটনায় ছ’জনের মৃত্যু হয় এবং চারজন আহত হন। আহতদের মধ্যে তিনজনকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওই দুর্ঘটনার পরে রাতে ট্রাক চালকদের সজাগ রাখতে এবং বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ করতে জেলা পুলিশ সুপারদের কিছু নির্দেশ পাঠিয়েছেন রাজ্য ট্র্যাফিক পুলিশের এডিজি। জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা বেছে নিয়ে সেখানে গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এর সঙ্গেই রাস্তার প্রয়োজনীয় জায়গায় চেক পোস্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে।
ওই নির্দেশের পরেই বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকের চোখ বুজে আসাই রাতে দুর্ঘটনার মূল কারণ। ভোররাতের মায়াবী আলোয় গাড়ি চালাতে চালাতে চোখের পাতা বিশ্বাসঘাতকতা করতেই পারে। তাই শীত পড়লে বিভিন্ন জাতীয় সড়কে বিক্ষিপ্তভাবে ট্রাক চালকদের দাঁড় করিয়ে তাঁদের চা-জল দেওয়া হয়ে থাকে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে দু’চুমুক দিলেই ঘুম-ঘুম ভাব পালাবে তৎক্ষণাৎ। এবার শীত পড়ার আগেই ওই ব্যবস্থা চালু করা হয়।
আরও পড়ুন: যমরাজ পুজোর ছুটি পেতে পারেন শুধু কলকাতা পুলিশের সৌজন্যেই
প্রথমদিকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর আগেই মাঝপথে পুলিশের গাড়ি আটকাতে চালকরা প্রাথমিকভাবে খানিক স্তম্ভিত হয়ে যান। পরক্ষণেই এই বিশেষ অতিথিসুলভ আপ্যায়নে আপ্লুত হন তাঁরা। দুর্ঘটনা এড়াতে যে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট চালকরা প্রত্যেকেই পুলিশের এই কাজের প্রশংসা করেন।
দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যেসব যানবাহনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ট্রাক রয়েছে ২৮.৩৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৪.৮০ শতাংশ আর বাস ১৪ শতাংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানো, চালকদের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।
দেশের সড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পিছনে যেসব কারণকে দায়ী সেগুলি হল–
১. বেপরোয়া গাড়ি চালানো– নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি জোরে চালানো হলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব ইত্যাদিও দায়ী এসব দুর্ঘটনার জন্য।
২. চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ– অনেক ট্রাকচালক ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে না ঘুমিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো অবশ্যম্ভাবী। আসলে অনেক ড্রাইভারদের ফিক্সড বেতন নেই, ট্রিপ হিসাবে ইনকাম। তাই অনেকেই চেষ্টা করে একটু বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি ইনকাম করার। আর বেশি ট্রিপ দিতে হবে বলে তারা গাড়িও বেশি জোরে চালায়। চালকের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না করে এরকম ট্রিপ ভিত্তিক করার কারণে দেশে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে।
৩. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন– দেশের বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক আর চালক ফিটনেসের তোয়াক্কা করেন না। অনেক সময় তারা অন্যভাবে ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় করে নেন। অনেক গাড়িতে পুরনো টায়ার ব্যবহার করা হয়, যেটা সারা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ। এটা বার্স্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে অহরহ পুরনো টায়ার বিক্রি করা হয়। ট্রাক মালিকরা বেশি মুনাফা করতে গিয়ে এসব টায়ার কিনে বাস-ট্রাক চালান, যা দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
৪. নজরদারি আর তদারকির অভাব– ফিটনেস-বিহীন গাড়ি চলছে, অদক্ষ চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রীবহন করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো হচ্ছে। এসবের ওপর কড়া নজরদারি প্রয়োজন। সড়কে কড়া নজরদারি ও ক্যামেরা থাকা উচিত। একটি গাড়ি অতিরিক্ত গতিতে চললে সেটাকে যেন দুর্ঘটনার আগেই থামানো যায়, আইনের মধ্যে আনা যায় সেই ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। আরও আধুনিক টেকনোলজি আনতে হবে।
৫. অদক্ষতা– আমাদের দেশে চালকের লাইসেন্সে দক্ষতা যাচাই করে দেখা হয় না। দেখা গেছে, চালকদের অনেকের সড়কের চিহ্ন এবং আইন-কানুন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে লাইসেন্স হয়ে যায় টেস্ট না দিয়েও। এমনকী, অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না। সরকারিভাবে ড্রাইভিং ইন্সটিটিউট করে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে তাদের দক্ষতা বাড়তে পারে।
তবে, এ রাজ্যে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কর্মসূচিতে সাফল্য এসেছে। ২০২৩-এ দেশের সর্বাধিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত রাজ্যের তালিকা থেকে বাদ গেছে পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রের সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহণ মন্ত্রকের তরফে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে কোন রাজ্যে কত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে কতজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, কতজন আহত হচ্ছে, তার তথ্য সামনে আনা হয়েছে। ‘রোড অ্যাক্সিডেন্টস ইন ইন্ডিয়া’ ২০২২ নামের ২০০ পাতার সেই বইতে তুলে ধরা হয়েছে ৪ বছরের সময়সীমায় দেশের প্রথম ১০টি সর্বাধিক সড়ক দুর্ঘটনাময় রাজ্যের তালিকা। দেখা যাচ্ছে, দেশের ওই ১০টি রাজ্যের তালিকায় নেই বাংলা। রয়েছে তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, তেলেঙানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাত। দেশের ৭৭.৮ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটেছিল ওই ১০টি রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গ আছে ১২ নম্বরে।
কুয়াশামাখা শীতের ভোর। যত্ত আলসেমি এই সময়েই উড়ে এসে জুড়ে বসে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে গাড়ির চালকের। হঠাৎ ব্রেক কষলেন তিনি। সামনে পুলিশের নাকা। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন পুলিশ অফিসার। কাগজের কাপে তার হাতে তুলে দিলেন ধোঁয়া ওঠা গরম চা; শুভেচ্ছা বিনিময়ের সঙ্গে। তখন পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙছে শহরের। এই ছবিই থাকুক দৃশ্যপটে।