কোচি শহরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ গিয়েছে দুই চিকিৎসকের। দৃশ্যমানতা কমে আসায় তাঁরা গুগ্ল ম্যাপের ওপরই ভরসা করেছিলেন। এই ঘটনা যেন নতুন করে আঙুল তুলে দিল সভ্যতার দিকে। পথে নেমে পথ হারানোর স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। যন্ত্রের সঙ্গতে সেই মন কোথায় যে মিলিয়ে গেছে! এখন সব কিছুই চলে নির্দেশ মেনে। এক না-মানুষি নির্দেশ।
‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ জনহীন সৈকতে নবকুমারকে যে প্রশ্ন করেছিল কপালকুণ্ডলা, তা যেন নতুন করে ফিরে এল। কেরলের কোচি শহরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ গিয়েছে দুই চিকিৎসকের। দৃশ্যমানতা কমে আসায় তাঁরা গুগ্ল ম্যাপের ওপরই ভরসা করেছিলেন। বোঝেননি কোথায় ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে বিপদ। এই ঘটনা যেন নতুন করে আঙুল তুলে দিল সভ্যতার দিকে। যত সময় যাচ্ছে, সব কিছুতেই যন্ত্রের কাঁধে হাত রেখে এগোতে চেয়ে আমরা পথ হারিয়েছি। অথচ এমন তো কথা ছিল না।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি।’ আবার তাঁর আর একটি গান রয়েছে– ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব।’ সেদিনের বাঙালিকে আসলে এই রোম্যান্টিকতা মানাত। পথে নেমে পথ হারানোর স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। যন্ত্রের সঙ্গতে সেই মন কোথায় যে মিলিয়ে গেছে! এখন সব কিছুই চলে নির্দেশ মেনে। এক না-মানুষি নির্দেশ। বাঁয়ে এগোন। ডানদিকে ইউটার্ন নিন। সবই কেঠো নির্দেশ মাত্র। যেন গন্তব্যে পৌঁছনই শেষ কথা। পথের রোমাঞ্চ সেখানে ব্রাত্য। বাকি বিশ্বের মতো আমরাও মোবাইলের পর্দার দিকে তাকাতে তাকাতে পথ হারিয়েছি নিজেদেরই অজান্তে।
এক সময় পাড়ায় পাড়ায় যাঁরা রাস্তা ভালো চিনতেন, তাঁদের আলাদাই কদর ছিল। উত্তর কলকাতার দুরূহ কোনও গলিতে যাবেন? অমুকদা বলে দেবে। মাধ্যমিকের সিট পড়েছে তমুক স্কুলে? দাদার কাছে গেলেই মুশকিল আসান। ঠিক কাকেশ্বর কুচকুচে যেমন বাতলে দিয়েছিল তিব্বতে যাওয়ার পথ। কলকাতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট থেকে যে সওয়া ঘণ্টার সিধে পথ, তা এর আগে কেউ কোনও দিন ভাবতে পেরেছিল?
আরও পড়ুন: ছোটদের মুখে হিংসার বুলি ছড়িয়ে যাচ্ছে হাজারে হাজারে
আবার সেই সুকুমার রায়েরই ‘ঠিকানা’র কথাই যদি বলা যায়। আদ্যানাথের মেসোকে চেনাতে গিয়ে জগমোহনকে নাকাল করা হয়েছিল। বদলা নিতে জগমোহন যা ঠিকানা দিয়েছিল, তা ছিল মোক্ষম। পড়তে পড়তে ‘আমড়াতলার মোড়ে তিন-মুখো তিন রাস্তা’ ধরে আমরাও হাঁটতে থাকি। এই যে অন্বেষণ, এর মাধুর্য কি কিছু কম? পথ থেকে পথে অবান্তর ঘুরে বেড়ানোও এক ধরনের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আমরা সেসব ভুলে বেশ আছি।
আচ্ছা, দোষটা কি যন্ত্রের? তা নিশ্চিত ভাবেই নয়। একটা কার্টুন সোশাল মিডিয়ায় ঘুরেফিরে আসে। স্মার্টওয়াচ পরে হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে কারও হাতটাই ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে শরীর থেকে। ছিন্ন হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়ি বলছে, ‘দারুণ! আপনি একধাক্কায় ৭৯ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছেন।’ ঘড়ির ওই সংলাপ নেহাতই যান্ত্রিক একটা ক্যালকুলেশন মাত্র। কিন্তু সভ্যতার কানে সেটা চূড়ান্ত টিটকিরির মতো বেজে ওঠে।
গুগল ম্যাপও তো তাই। সে পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে তার ওপর অন্ধের মতো নির্ভর হতে বলছে কি? হয়তো যে বিরাট বিপুল বাজারের মধ্যে আমরা ভেসে বেড়াচ্ছি, সে এইটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। উন্নয়নের অর্থনৈতিক মডেল আসলে একটাই কথা জানে। দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ। সংক্ষেপে যাকে বলে ‘TINA’. আমরাও তাই আজ্ঞাবহ হয়ে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কেবল ওই নির্দেশটুকু নিতে গিয়ে চোখ তুলে তাকাতে ভুলে যাচ্ছি। বহু সময়ই এমন শোনা যায়, বেঁধে দেওয়া পথনির্দেশ মানতে গিয়ে গাড়ি ঢুকে পড়েছে ছোট্ট গলিতে। যেখান থেকে বেরনোই দুষ্কর। কেরলের দুই চিকিৎসক হয়তো অন্ধকার বৃষ্টির পাল্লায় পড়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি যান্ত্রিকতার খুড়োর কলের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের দিনরাতের পথ সব আগেই গুলিয়ে যায়নি?
অথচ আমরা বেশ স্মৃতিতে ধরে রেখেছি উত্তম-সুচিত্রার সাদা-কালো অতীত। এই পথ যদি না শেষ হয়। যে পথে বেরিয়েছি দু’জনে সেখানে কেবলই এগিয়ে চলা। পৌঁছনো মানেই ফুরিয়ে যাওয়া। বার্গম্যানের ‘সামার উইথ মনিকা’ ছবিতে যেমন দু’জনে মিলে বোটে চেপে পাড়ি দেওয়া এক অলস সময়-গর্ভে। আমাদের নায়কও নায়িকাকে সেভাবেই বাইকে চাপিয়ে এগিয়ে চলেন। পিছনে সরে যায় পথ। সামনেও জেগে ওঠে পথই। মনে পড়ে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। পথের ক্লান্তি ভুলে শীতল হতে চেয়ে যে যাত্রা, সেপথে ফিরে ফিরে আসে আকুতি। কত দূর আর কত দূর…
আমরা কবে ভুলে গেলাম ‘পথের পাঁচালী’? যেখানে পথের দেবতা প্রসন্ন হেসে বলে ওঠেন, ‘মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে…’ যে সংলাপ শেষ পর্যন্ত ‘দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মনন্তর, মহাযুগ পার হয়ে’ এগিয়ে চলার কথা শোনায়। পথের দেবতা জানেন না আমরা পথ হারিয়েছি। পথ থেকে পথে ছড়িয়ে রয়েছে যে অন্বেষণ, সেসব উপেক্ষা করে ‘ফাস্ট লাইফ’-এর অজুহাতে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটুকুই আজ আমাদের অভীষ্ট। প্রযুক্তির নির্দেশ ফুরিয়ে আসে। পথের দেবতার পথ কখনও ফুরোয় না। কিন্তু আমরা তাকে অনুসরণ করলে তো!