
সাম্প্রতিক সময়ে নেট ফরেন ইনভেস্টমেন্ট গিয়েছে ভীষণরকম কমে– কয়েক বছর খোদ নেট এফডিআই অবধি ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে, বৈশ্বিক সুদের হার ওঠাপড়া এবং মার্কিনি শুল্কনীতির রদবদলে ফেঁপে ওঠা অনিশ্চয়তায় বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী ঝুঁকি না নিয়ে, সরাসরি ভারত থেকে মূলধন তুলে নিচ্ছেন। সেই মূলধন ফেরত নিতে গিয়ে তারা টাকা বদলে ডলার কিনছেন, ফলে রুপি-র জোগান বাড়ছে এবং ডলারের চাহিদা তুমুল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার দরুন ভারতীয় মুদ্রার মূল্য উত্তরোত্তর নেমে যাচ্ছে।
বিষম পরিস্থিতি। টেনিদার ভাষায় যাকে বলে ‘পুঁদিচ্চেরি’। বর্তমানে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) যখন সাঁ-সাঁ করে বেড়ে চলেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই জাতীয় মুদ্রা ভারতীয় টাকা (আইএনআর) রেকর্ড পতনের মুখোমুখি– ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ৯০ টাকা ছুঁইছুঁই! এ এক অভাবনীয় বৈপরীত্য!
একটি গতিময় অর্থনীতি সচরাচর দেশের মুদ্রাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। ২০২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক বাজারে ভারতীয় মুদ্রার দর মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন সহজেই মাথা চাড়া দেয়– ভারতের ক্ষেত্রে ‘বৃদ্ধি’ বলতে আদতে কী বোঝায়? এবং সেই অর্থনীতির অঙ্ক ভারতীয় জনসাধারণের কাছে কতটুকু?

প্রশ্নটি বহুস্তরীয়। উত্তরও তাই। সমস্যার মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে মুদ্রার মূল্য নির্ধারণের প্রকৃত ভিত্তিতে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, সুদৃঢ় কার্যকরী পরিষেবা এবং উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণের সার-জলে দেশের অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধি ফুলেফেঁপে উঠলেও, মুদ্রার মান বা শক্তি আদতে অনেকখানি নির্ভর করে বহির্বিশ্বে অর্থের প্রবাহ– অর্থাৎ, বাণিজ্য ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত, বিদেশি বিনিয়োগ, বৈশ্বিক পুঁজি চলাচল এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদার ওপর।
ভারতে রপ্তানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি– বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, সোনা, যন্ত্রাংশ এবং বিভিন্ন কাঁচামাল। কাজেই, দেশের ভোগব্যয় ও শিল্পোৎপাদন জিডিপি-বৃদ্ধির ফলে যত বাড়ছে, আমদানির চাহিদাও বাড়ছে ততোধিক। বেশি আমদানি মানেই, ডলারের চাহিদা-বৃদ্ধি। কারণ, বিদেশি বিক্রেতাকে পণ্যের দাম মেটাতে হয় বিদেশি মুদ্রাতেই। আর ডলারের চাহিদা মাথা চাড়া দিলেই ‘ডলার-রুপি’ বিনিময়ের হার অমনি লাফিয়ে ওঠে!
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই) ভারতের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা চলতি হিসেবের ঘাটতি সামলাতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হয়ে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নেট ফরেন ইনভেস্টমেন্ট গিয়েছে ভীষণরকম কমে– কয়েক বছর খোদ নেট এফডিআই অবধি ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে, বৈশ্বিক সুদের হার ওঠাপড়া এবং মার্কিনি শুল্কনীতির রদবদলে ফেঁপে ওঠা অনিশ্চয়তায় বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী ঝুঁকি না নিয়ে, সরাসরি ভারত থেকে মূলধন তুলে নিচ্ছেন। সেই মূলধন ফেরত নিতে গিয়ে তাঁরা টাকা বদলে ডলার কিনছেন, ফলে রুপি-র জোগান বাড়ছে এবং ডলারের চাহিদা তুমুল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার দরুন ভারতীয় মুদ্রার মূল্য উত্তরোত্তর নেমে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের শক্তি যেন ‘গুণময় বাগচির বাইসেপ’, সঙ্গে দোসর যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদের হার! এহেন সাঁড়াশি চাপে রুপি-সহ উদীয়মান অর্থনীতিগুলির মুদ্রা কার্যত কোণঠাসা। দেশের ভিতরে জিডিপি যতই বাড়ুক, তার প্রভাব মুদ্রার মূল্যের ওপর পড়ছে না। অর্থনীতির তত্ত্ব ‘ইমপসিবল ট্রিনিটি’ বা ‘মনিটরি-পলিসি ট্রিলেমা’ জানায় এক অসম্ভব ত্র্যহস্পর্শের কথা, ‘মুদ্রানীতি স্বাধীনতা’, ‘স্থির বিনিময় হার’ এবং ‘পুঁজির অবাধ প্রবাহ’– এই তিনটির মধ্যে কেবল যে-কোনও দু’টিকেই কেবল একসঙ্গে রাখা সম্ভব। তিনমূর্তির একযোগে আসার জো নেই।
সেই প্রেক্ষিতে ভারত ‘স্বাধীন মুদ্রানীতি’ ও ‘পুঁজি-চলাচলের স্বাধীনতা’-কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে ধাক্কা সামলানোর সব দায় গিয়ে পড়েছে ভারতীয় রুপি-র ওপর। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো ‘রুপি’-ই শেষমেশ হয়ে উঠেছে অন্যতম ‘শক অ্যাবজর্ভার’। ‘বিনিময় হার’ সেই শক-এর হিসেব কষতে গলদঘর্ম।
দৈনন্দিন জীবনেও এর প্রভাব সুবিস্তৃত। টাকার দাম পড়ে যাওয়া মানে, আমদানি করা পণ্য– অপরিশোধিত তেল, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, কাঁচামাল– টাকার হিসেবে আরও দামি হয়ে ওঠা। পেট্রোল-ডিজেলের দাম, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মূল্য, এমনকী বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি-নির্ভর পণ্যের ওপরেও এর সরাসরি প্রভাব অবধারিত। মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত হলেও, টাকার অবমূল্যায়ন একধরনের ‘সাইলেন্ট ট্যাক্স’ বা নীরব করের মতো আঘাত হানে। উৎপাদনের খরচ বাড়ে, বহু ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলি সেই বাড়তি খরচা গ্রাহকের ওপরেই চাপিয়ে দেয়। ফলে ক্রেতাকে আমদানি-উপকরণ নির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় গ্যাঁটের কড়ি খরচা করতে হয়। দৈনন্দিন খরচ বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পারেন যে, কোথাও কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু নেপথ্যের মূল অর্থনৈতিক প্যাঁচ-পয়জার সম্বন্ধে সার্বিক সচেতনতা সেভাবে গড়ে ওঠে না। সে আলোচনা আজও অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ অ্যাকাডেমিক পরিসরে বা সংবাদপত্রের আলোচনায়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষারত ব্যক্তি (অথবা নিছক বিদেশ-ভ্রমণে উৎসাহী) বা বিদেশি মুদ্রায় নেওয়া ঋণ-পরিশোধকারী সংস্থাগুলি এরকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে রীতিমতো চাপ অনুভব করে। মার্কিন ডলারে নির্ধারিত ‘টিউশন ফি’ তখন রুপির হিসেবে অনেক বেশি ব্যয়বহুল বলে মনে হয় যে! আইটি সেক্টর অথবা কিছু রপ্তানিকারক সংস্থা, যারা ডলারে আয় করে, তারা এই হুলুস্থুল থেকে সাময়িক ফায়দা তোলে। যদিও সে লাভের স্থায়িত্ব নির্ভর করে, ওইসব সংস্থার আমদানি-নির্ভর কাঁচামাল ব্যবহার করা বা না-করার ওপর। অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিক ডলারে আয় করেন না, তাই তাদের লাভের সুযোগ সীমিত, অথচ ব্যয়ের চাপ উঠছে ফুলেফেঁপে। টাকার অবমূল্যায়ন নিশ্চুপে মানুষের আয়ের ক্রয়ক্ষমতা প্রত্যহ কমিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।
দেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। টিভিতে বা খবরের কাগজে জিডিপি-র সংখ্যাগুলি ঝলসে উঠছে ইকোনমি-র ‘অটুট স্বাস্থ্যের’ ঘোষণা ও জয়ধ্বনিতে। এদিকে পেট্রোলের দর বা দৈনন্দিন খরচার বহর চড়চড় করে বাড়ছে– ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে ক্রমাগত ধন্ধে ফেলছে জনগণকে। সচেতনতা কি তবে ঘোর অন্ধকারে? মোটেই না। যাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করেন বা কর্মসূত্রে যাতায়াত করেন, তাঁরা এ ব্যাপারে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। রিয়েল-টাইমে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠাপড়া দেখেই তাঁরা টের পান ‘কত ধানে কত চাল’। বেতনভুক শ্রেণির জন্য কষ্টটি অপেক্ষাকৃত ধীরগতির, কিন্তু অসুখ যে গভীর! খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি, মুদিখানা বা গৃহস্থালির নানা টুকিটাকির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিডিপি-র জৌলুস একদিন নিশ্চিত ঢাকা পড়ে যাবে মূল্যবৃদ্ধির কুয়াশায়।

অর্থনীতি-সচেতন ও শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি– সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ও বিবিধ পেশার মানুষজন মাঝে মাঝেই প্রশ্ন তুলছেন: উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কি আদৌ বাস্তব অবস্থার সঠিক ছবি তুলে ধরছে? বহু বিশ্লেষক মনে করেন, ভোগব্যয় ও সরকারি ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রবৃদ্ধি বাড়লেও, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রধান ইঞ্জিন– ‘নেট ফরেন ইনভেস্টমেন্ট’-এর পালে তেমন বাতাস লাগেনি।
জিডিপি বাড়ল, এদিকে মুদ্রার দর কমল– এই বিচ্ছিন্নতা আদতে ভারতের অর্থনীতির গভীরতর কাঠামো এবং কৌশলগত দুর্বলতাকেই উন্মোচিত করে। পাকাপোক্ত বহিঃসমতার অভাবে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ-নির্ভর জিডিপি বৃদ্ধি আদতে নড়বড়ে। পর্যাপ্ত রপ্তানি, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স), এফডিআই অথবা বাণিজ্য-ঘাটতি সংকোচন ছাড়া শক্তিশালী মুদ্রা বজায় রাখা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, ভারতের আমদানি-নির্ভরতা সরাসরি মুদ্রার শক্তি কমিয়ে দেয়। দেশীয় মূল্য সংযোজন, উৎপাদনের বৈচিত্র্যকরণ এবং রপ্তানিমুখী উৎপাদন বৃদ্ধির বেড়া দিয়ে আমদানির তীব্রতাকে না ঠেকানো গেলে এ পরিস্থিতি শোধরানো মুশকিল। আর্থিক নীতির নিরিখে ‘ইম্পসিবল ট্রিনিটি’-তত্ত্ব মেনে এমনিতেই রুপি কোণঠাসা। ফলে সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের স্বার্থে, জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে একটি সুস্থ বাহ্যিক খাতের উন্নয়ন থাকা জরুরি। চাই আরও বেশি রপ্তানি, উচ্চতর এফডিআই, মূল্য সংযোজিত উৎপাদন এবং আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস। নচেৎ বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! কাগজে-কলমে উন্নত প্রবৃদ্ধির খাড়া দেওয়াল বেয়ে সবেগে গড়িয়ে নামছে টাকার দর। শক্তিধর ডলার ক্রমেই হয়ে উঠছে বহু-‘রুপি’!
ভারত যদি এই উচ্চ জিডিপি-প্রবৃদ্ধিকে মানুষের জন্য বাস্তব ও স্থায়ী সমৃদ্ধিতে রূপান্তরিত করতে চায়, তবে রুপিকে উপপণ্য থেকে পরিপূর্ণ ‘সূচক’ হয়ে উঠতে হবে। দায় নিতে হবে বাহ্যিক ভারসাম্য, প্রতিযোগিতা এবং বৈশ্বিক সংযুক্তির। অন্যথায়, টেকসই সমৃদ্ধির আশা হাপিস করে প্রবৃদ্ধির রকেটগতি একদিন ‘মেফিস্টোফিলিস’-এর মতোই গোঁত্তা খেয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার খোলা বাজারে।
………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা
………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved