২০০৩ সালে ছোট বুশ ইরাক আক্রমণ করলেন। যুদ্ধের ছবির ভোঁতা হয়ে যাওয়ার সেই শুরু। তার একটা কারণ, যুদ্ধ বাধলে এতদিন সাংবাদিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে দৌড়তেন নিজেরা। কিন্তু এই সেই প্রথম যুদ্ধ, যেখানে শোনা গেল ইংরেজি শব্দ ‘এমবেডেড’। অর্থাৎ কিনা যে সাংবাদিক সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধ কভার করতে যান। ততদিনে অবশ্য প্রযুক্তিও বদলে গেছে বৈপ্লবিকভাবে। বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। এই দুইয়ের যোগফলে হঠাৎ করে যুদ্ধ এবং তার ভয়াবহতা বদলে গেল দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের বিস্ফোরণে। মানুষ ঘরে বসেই ভিডিও গেমের মতো দেখতে শুরু করল ক্ষেপণাস্ত্রের মহোৎসব। ক্রমশ দেখা গেল, শহর বাগদাদ ধ্বংস হচ্ছে আর ঘরে বসে মানুষ দেখছে তার সরাসরি সম্প্রচার, দীপাবলির বাজি-পোড়ানোর সঙ্গে তার আর কোনও তফাত নেই।
একুশ শতকে যুদ্ধের ছবি কীরকম ভোঁতা হয়ে গেছে। তার আগে গোটা বিশ শতক জুড়েই যুদ্ধের ছবির একটা আলাদা প্রভাব ছিল জনমানসে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ এবং তারপর জাপানের আত্মসমর্পণে আমেরিকায় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গিয়েছিল। লোকজন ‘পাষণ্ড’ বলে নয়, এর একটা বড় কারণ হল পরমাণু বোমাটা ঠিক কী জিনিস, তার ছবি, আমজনতার একেবারেই জানা ছিল না। টিভি তখনই চলে এসেছে আমেরিকায়, কিন্তু পৃথিবীটা ঠিক ছোট হতে হতে হাতের মুঠোয় বন্দি হয়নি। দুনিয়ার এক দিক থেকে আরেক দিকে খবর এসে পৌঁছতে সময় লাগত। এক্ষেত্রে আনন্দে চোনা পড়তে সময় লেগেছিল এক বছর। হিরোশিমা ঘুরে এসে ১৯৪৬ সালে জন হার্সি লিখেছিলেন এক প্রতিবেদন। নিউ ইয়র্কার পত্রিকার রবিবারের সংস্করণে সেদিন ছাপা হয়েছিল ওই একটাই লেখা। তাতে বিশেষ কোনও গ্রামভারি তথ্য ছিল না। কলমের টানে শুধু আঁকা হয়েছিল ছবি। পরমাণু বিস্ফোরণে ছ’জন বেঁচে যাওয়া মানুষের কথা, আর তাদের চোখে দেখা ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ লিখেছিলেন জন, যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল শুধু আমেরিকা নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষকে।
একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধেও। পৃথিবী জুড়ে তখন ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ। ১৯৬২ সালে কিউবার মিসাইল সংকটকে ঘিরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় লেগে-যায় লেগে-যায় অবস্থা। নিজের দেশে এবং গোটা পশ্চিমি দুনিয়ায় আমেরিকার দাবি ছিল, তারা ভয়ানক কমিউনিস্ট বিপদের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার লড়াই লড়ছে। সেই ভাষ্য একরকম করে গ্রাহ্যও হত। কিন্তু বাদ সাধল কিছু ছবি। পশ্চিমি চিত্রগ্রাহকদের তোলা কিছু ছবি প্রকাশ পাওয়ার পর, দেখা গেল বিষয়টা অত সোজা না। স্রেফ কিছু ছবি, কিন্তু তার জোর ছিল হাজার-লক্ষ শব্দেরও বেশি। বহুবার ছাপা এবং ছড়িয়ে পড়া সেইসব ছবির একটাতে দেখা যায়, সায়গনে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আগুন জ্বেলে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন প্রতিবাদে, আগুন দাউদাউ জ্বলছে, সন্ন্যাসী পদ্মাসনে স্থির। অন্য আরেকটা ছবিতে দেখা যায় সায়গনের রাস্তায় এক ভিয়েতনামি সৈনিককে দাঁড় করিয়ে মাথায় গুলি করা হচ্ছে। এবং যে ছবিটা আজও সর্বত্র ছড়িয়ে, সেটা হল বোমা বিস্ফোরণের পর গ্রাম থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে এক ছোট্ট মেয়ে, সে সম্পূর্ণ নগ্ন। এইসব ছবি দেখেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা নয়, কিন্তু এদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
এই ঐতিহ্য চলেছিল বহুদিন। ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার মাটিতে খুন হওয়া চে গুয়েভারার মৃতদেহের ছবির কথা কে ভুলতে পারে, যার থেকে প্রবাদই ছড়িয়ে পড়েছিল লাতিন আমেরিকায় যে, মৃত চে জীবিত চে-র থেকেও বিপজ্জনক। অথবা ১৯৮৯ সালে চিনের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে ট্যাঙ্কের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া সেই যুবকের ছবি। সেটা অবশ্য স্থিরচিত্র না, কারণ ভিডিওগ্রাফি তখন সহজ হয়ে গেছে। যাঁরা বামপন্থী তাঁরাও শিহরিত হয়েছিলেন সে দৃশ্য দেখে। একই ভাবে রোমানিয়ার শাসক চাওসেস্কু দম্পতির ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানোর ভিডিও-ও ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবীতে। স্বৈরাচারী হন আর যাই হন, এভাবে সস্ত্রীক দাঁড় করিয়ে খুন, হজম করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এই দুটো জিনিসেই অবশ্য ইতিহাসের গতি আটকায়নি। কিন্তু বিশ্বজনমতকে কাঁপিয়ে দেওয়ার কাজ ছবি করে গেছে অবিচলভাবে। গোটা বিশ শতক জুড়ে।
ছবির এই ভূমিকা বদলাল নতুন শতকে এসে, যখন ২০০৩ সালে ছোট বুশ ইরাক আক্রমণ করলেন। যুদ্ধের ছবির ভোঁতা হয়ে যাওয়ার সেই শুরু। তার একটা কারণ, যুদ্ধ বাধলে এতদিন পর্যন্ত সাংবাদিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে দৌড়তেন নিজেরা। তাঁরা ছিলেন ‘স্বাধীন’। কিন্তু এই সেই প্রথম যুদ্ধ, যেখানে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে শোনা গেল আরেকটা ইংরেজি শব্দ ‘এমবেডেড’। অর্থাৎ কিনা যে সাংবাদিক সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধ কভার করতে যান। ততদিনে অবশ্য প্রযুক্তিও বদলে গেছে বৈপ্লবিকভাবে। বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। এই দুইয়ের যোগফলে হঠাৎ করে যুদ্ধ এবং তার ভয়াবহতা বদলে গেল দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের বিস্ফোরণে। মানুষ ঘরে বসেই ভিডিও গেমের মতো দেখতে শুরু করল ক্ষেপণাস্ত্রের মহোৎসব। আর মাত্রাতিরিক্ত জোগান থাকলে যা হয়, ক্রমশ ভোঁতা হতে থাকল যুদ্ধের ছবির, ভয়াবহতার শিহরন।
ক্রমশ দেখা গেল, শহর বাগদাদ ধ্বংস হচ্ছে আর ঘরে বসে মানুষ দেখছে তার সরাসরি সম্প্রচার, কিন্তু দীপাবলির বাজি-পোড়ানোর সঙ্গে তার আর কোনও তফাত নেই। সবই দেখা যাচ্ছে বৈঠকখানায় বসে, কিন্তু পুরোটাই কেমন দূরবর্তী ভিডিও গেম। যুদ্ধের ছবি থেকে মানবিকতা ব্যাপারটাই ক্রমশ উবে যেতে থাকল। সবই দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ আর বিচলিত হচ্ছে না। শিহরন, আবেগের জায়গা নিয়ে নিয়েছে কৌশল, বিশ্লেষণ, সরকারি ভাষ্য এবং অবশ্যই দৃশ্যের বন্যা। অবিশ্বাস্য লাগলেও, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল। যুদ্ধ লাগার তিন-বছর পর, সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসি হল ২০০৬ সালে। ততদিনে ইন্টারনেট হইহই করে এসে গেছে, সেই ভিডিও দেখা গেল ইউটিউবেও। বিশ্বজুড়েই। কিন্তু তার প্রভাব? তেমন কিছুই না। যুদ্ধ ও ধ্বংসের দৃশ্য ততদিনে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে। নতুন করে আর কোনও ছাপ ফেলে না, বরং একরকম উদ্দীপনা তৈরি করে।
এই ব্যাপারটা অবশ্য একেবারে নতুন কিছু নয়। হাজার-দুই বছর আগে রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারকে এইরকম একটা কাজেই ব্যবহার করা শুরু হয়। অর্থাৎ কিনা যুদ্ধ এবং হিংসাকে জনতার উৎসবে পরিণত করা। রোমান অর্থনীতি ছিল একরকম করে যুদ্ধ অর্থনীতি, ফলে হিংসা থেকে মানবিক অংশটাকে ছেঁটে ফেলে তাকে স্রেফ দর্শনীয় বস্তুতে রূপান্তরিত করার প্রয়োজন ছিল। রোম সাম্রাজ্যের ব্যপ্তিই প্রমাণ করে, সে কাজটা ভালো মতোই করা গিয়েছিল। তার প্রায় দুই সহস্রাব্দ পরে, যুদ্ধ, আবারও পশ্চিমি সভ্যতার ‘স্বাভাবিক’ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাওমি ক্যাম্পবেল যাকে বলবেন ‘বিপর্যয়ের পুঁজিবাদ’। অর্থাৎ, যুদ্ধ আর মারা বা মরার জন্য না, এখন নিয়মতান্ত্রিক কিছু বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলা প্রয়োজন, অর্থনীতি এবং সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই। যুদ্ধ হলে মারণাস্ত্র বিক্রি হয়, যুদ্ধের পর পুনর্গঠনের বহু বিলিয়ন ডলারের কনট্রাক্ট। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে দেওয়া যায় ‘শক-থেরাপি’। একুশ শতকে এই বাস্তবতার মূর্ত প্রয়োগ আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করা হয়নি। বরং ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে কিছু এলাকায় যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার। যারা যুদ্ধকে পরিণত করবে উৎসবে, ক্রিকেট ম্যাচ বা রিয়েলিটি শো-তে। আমরা ঘরে বসে পুইয়ে নেব তাপ। আলোচনা করব বিশ্ব রাজনীতি, কৌশল। ধ্বংসস্তূপের নিচে ছবি হয়ে যাওয়া মানুষগুলো অবশ্য তাতে কোনও দীর্ঘশ্বাস ফেলবে না, কারণ তারা ইতিমধ্যেই মৃত।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved