ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ বুজে এসেছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ট্রেন তখন নৈহাটিতে। সবাইকে দেখে বুঝলাম অনেকক্ষণ হল ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। সবার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম কিছু একটা ইঞ্জিনের সমস্যা। অনেকেই বেরিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। আমি একটা জলের বোতল কিনব বলে নামলাম, পাঁচ হাত দূরেই একটা দোকান। অনেকটা হাঁটলাম। কিন্তু কোনও দোকান দেখতে পাচ্ছিলাম না। লিখছেন সোমদত্তা মৈত্র
আমার তখন অপ্টোমেট্রির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। চতুর্থ বর্ষে বাইরে এল.ভি.পি.আই-তে ইন্টার্নশিপ করার ইচ্ছে। তার জন্য হাতে-কলমে কাজ শেখার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এই সময়ে আমাদের বহু আই ক্যাম্পে পাঠানো হত। ক্যাম্পে চোখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পারিশ্রমিকও পেতাম। কাজ শেখার জন্য নানা জায়গায় যেতাম, সঙ্গে বিড়ি, লজেন্স খাওয়ার পকেটমানি। এরকমই এক বুধবারে আমার এক বন্ধু একটি আই ক্যাম্পের খবর দিল। রবিবারে ক্যাম্প। নিজের লেন্স বক্স, রেটিনোস্কোপ ইত্যাদি সব নিয়ে যেতে হবে। ক্যাম্প হবে শান্তিপুরে। ওরা হাজার টাকা দেবে আর সঙ্গে দুপুরের খাবার। ‘তখন’ মানে ২০০৭ সালে অন্য যেসব জায়গায় ক্যাম্পে গেছি, তারা ৫০০ করে দিত।
আরও ১৪ ভূতের গপ্প: একঝলকে যা দেখলাম ওর মুখটা বিবর্ণ, ফ্যাকাসে
রবিবার সকাল সকাল বেলঘরিয়া থেকে শান্তিপুর লোকালে চেপে বসলাম আমি আর সম্রাট। শুনলাম, ওখানে আরও কয়েকজন থাকবে আর পেশেন্ট যে অনেক হবে, সেটা ক্লাবের লোক আগেই সম্রাটকে বলে রেখেছিল। আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছিলাম। ক্লাবের সামনে গিয়ে দেখি, লোক থিকথিক করছে। আমরা চার্ট লাগিয়ে, লেন্স বক্স বের করে বসলাম এবং হুড়মুড় করে লোকজন আসা শুরু করল। আর, ক্যাম্পে কাজ করতে করতে কীভাবে কোথা থেকে যে দুপুর দুটো বেজে গেল, খেয়াল হয়নি! ক্লাবের লোকজন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করল। খাবার খেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে, আবার পেশেন্ট দেখা শুরু করলাম। খাবার খাওয়ার পর, চোখ দুটো বুজে আসছিল, কিন্তু দরজার দিকে তাকালেই দেখছিলাম লম্বা লাইন।
আরও ১৪ ভূতের গপ্প: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
হঠাৎই সম্রাট তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে বলল, ‘সোমু, আমার এক পেশেন্টের চোখের পাওয়ারটা বড্ড বেশি আসছে। আর একবার দেখবি একটু, আর আই.ও.পি-ও একটু বেশির দিকে। একবার দেখে নে, আমি রেফার করে দেব।’ শুনে আমি আমার পেশেন্টকে বসিয়ে রেখে পাশের ঘরে গেলাম। সম্রাটের একটা ফোন আসাতে সম্রাট চলে গেল একটু দূরে। আমি ওই পেশেন্ট দেখা শুরু করলাম। পেশেন্টের মারফান্স সিন্ড্রোম। মাইনাস পাওয়ার বেশি, লেন্স সাবল্যাক্সেশান, আর আই.ও.পি-ও বেশির দিকে। ভদ্রলোকের বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। আমি জিগ্যেস করলাম ‘বাপরে, এই রোগ কতদিনের?’ বলল, ‘দিদিমণি জানিনে, ওষুধ দ্যান, ভালো দেখিনে, রাতে মানুষ না গাছ ঠাউর হয় না।’
এই বয়সে এই রোগ? এ তো আরও আগে ধরা পড়ার কথা। একে অপারেশান করতে হবে। পাওয়ার দিয়ে কোনও লাভ নেই, কারণ একটা ফিল্ড টেস্ট করাতে হবে। দরজা দিয়ে দেখলাম সম্রাট এখনও কথা বলছে ফোনে। ওরই পেশেন্ট, না জিগ্যেস করে কিছু করাও যাচ্ছে না। তাই আমি ওঁকে বসিয়ে সম্রাটকে ডাকতে গেলাম। সম্রাটেরও কথা বলা শেষ হয়ে গেছিল। আমায় দেখতে পেয়ে বলল, ‘সোমু, বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, বাবার শরীরটা ভাল না, আমি এখনই বেরুব।’ সম্রাট চলে গেল।
আরও ১৪ ভূতের গপ্প: মুখের জায়গায় একটা চেরা জিভ লকলক করছে
আমি আর বাকি ক’জন ছিলাম। কাজও প্রায় শেষের দিকে। ঘরে গিয়ে দেখি, ওই বয়স্ক মানুষটি আর নেই। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের জানালাম। ওঁদেরকে ওই পেশেন্টের নাম, রেফারেল নাম্বার সব দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম। বললাম কোনও অসুবিধেয় অবশ্যই যেন ফোন করে। আমাদের সঙ্গে বাকিরা যাঁরা ক্যাম্পে ছিলেন, তাঁরা কেউই বেলঘরিয়ার দিকে ফিরবেন না, মানে আমি একা। লেন্স বক্স, রেটিনোস্কোপ, অপথালমোস্কোপ ইত্যাদি নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়লাম। কোনওমতে স্টেশনে এসে ট্রেনে চেপে বসলাম। এখান থেকেই ছাড়বে, তাই উঠেই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। এবার ফেরার পালা। ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ বুজে এসেছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ট্রেন তখন নৈহাটিতে। সবাইকে দেখে বুঝলাম অনেকক্ষণ হল ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। সবার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম কিছু একটা ইঞ্জিনের সমস্যা। অনেকেই বেরিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। আমি একটা জলের বোতল কিনব বলে নামলাম, পাঁচ হাত দূরেই একটা দোকান। অনেকটা হাঁটলাম। কিন্তু কোনও দোকান দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল দোকানটা একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে। বেশি হাঁটার ফলে আরও বেশি জলতেষ্টা পাচ্ছিল। কেমন জানি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। একটা বাচ্চা তার বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গাটাই আমি পাঁচবার ক্রস করলাম। খুব ঘাম হচ্ছিল। চিৎকার করছিলাম কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল পড়ে যাব। হঠাৎ দেখি ক্যাম্পের সেই পেশেন্ট। ওঁর হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘দিদিমণি টেরেন ছেড়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করেন’ বলে একপ্রকার আমায় একহাতে চাগিয়ে ট্রেনে তুলে দিল। আমি দরজা দিয়ে মুখ বাড়াতেই একটা মিষ্টি গন্ধে চারদিক ভরে গেল। আর সেই ভদ্রলোক ধোঁয়ার মধ্যেই ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলেন। সিটে বসে একটু ধাতস্ত হয়ে চারদিক দেখলাম। ট্রেন দূরন্ত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের যে জায়গাগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আমি আগেও বলেছি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সাধারণ মানুষ যা প্রকাশ করতে পারে না চট করে। মনোজ মিত্র তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে দেখিয়েছেন।