একদিন নিরালায় চোখ বন্ধ করে বসে ভজন গাইছি, পিছন থেকে তালে তালে ঝুমঝুম আওয়াজ হতে লাগল, কেউ যেন হাতে ক’টি ঘুঙুর নিয়ে তাল রাখছে। মা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মধুসূদনদাদার গল্পটি প্রায়ই আমাদের বলতেন, আমরা তাঁর গল্প শুনে বিশ্বাস করেছিলাম যে, ভক্তের ডাকে ভগবান এসে উপস্থিত হন। আমার মনে হল গিরিধারীই হয়তো স্বয়ং কৃপা করেছেন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! লিখছেন মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
বাবা বদলি হয়েছেন তখন, আসামের একটি নির্জন এলাকায়। তিনি প্রায়ই বদলি হতেন এখানে-ওখানে। জায়গাগুলো বন-জঙ্গলে ঢাকা, ভীষণ নির্জন। সন্ধে হলেই বাইরে বেরতে গা ছমছম করত। নির্জন জায়গা হলেও কর্মসূত্রে বাবা থাকবার জন্য ভালো ভালো বাড়ি পেতেন। আর সেখানে থাকার নানা সুবন্দোবস্ত ছিল। যে জায়গাটিতে আমরা গেলাম সেখানে বাবার জন্য বরাদ্দ মস্ত বাড়িটিতে এক সিংজি তাঁর মস্ত পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। বাড়িটি তখনই ছাড়তে চাইছিলেন না উনি, পরিবারের অসুবিধের কথা জানিয়ে আটকে রেখেছিলেন। ফলে বাবা অস্থায়ীভাবে অন্য একটি বাড়ির খোঁজ করতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে একটা বেশ বড়সড় পুরোনো কাঠের বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। বাগানওলা বাড়িটির গা বেয়ে উঠে গেছে বিশাল একটি বোগেনভেলিয়ার ঝাড়। দেখেই বাবার পছন্দ হয়ে গেল! ওটা দেবকাকুর দূর সম্পর্কের মাসির বাড়ি, মাসির ছেলে থাকে আমেরিকায়। দেবকাকু বাবার অফিসের কাছাকাছি একটি জায়গায় চাকরি করতেন। তাঁকে বাড়ির কথা বলাতে তিনি একটু দোনামোনা করতে লাগলেন। কিন্তু আমাদের থাকার জন্য তখন বাড়ি প্রয়োজন, বাবা বিশেষ অনুরোধ করায় দেবকাকু বাড়িটি পরিষ্কার করিয়ে আমাদের থাকতে দিলেন।
বাড়িখানা বেশ বড়! মাঝখানে একটা হলঘর আর দু’-পাশে দুটো সুবিশাল শোবার ঘর। ডানদিকের শোবার ঘরে একটি বিরাট খাট পাতা। ওটা ও বাড়ির খাট। মা বিছানা পেতে দিয়ে বললেন, তোমরা বোন দু’টিতে এখানে থাকবে। আর এককোণে একটা চৌকি পেতে রাখা হল হারমোনিয়াম-তবলা। আমরা মহা খুশি! প্রাণের আবেগে গান গাওয়ার সময় বাড়িয়ে নিলাম।
একদিন নিরালায় চোখ বন্ধ করে বসে ভজন গাইছি, পিছন থেকে তালে তালে ঝুমঝুম আওয়াজ হতে লাগল, কেউ যেন হাতে ক’টি ঘুঙুর নিয়ে তাল রাখছে। মা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মধুসূদনদাদার গল্পটি প্রায়ই আমাদের বলতেন, আমরা তাঁর গল্প শুনে বিশ্বাস করেছিলাম যে, ভক্তের ডাকে ভগবান এসে উপস্থিত হন। আমার মনে হল গিরিধারীই হয়তো স্বয়ং কৃপা করেছেন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! মাকে চুপিচুপি বললাম। মা প্রায় কেঁদেই ফেললেন, কাউকে বলিস না, অমনভাবে একা বসে ভক্তিভরে গান গাস! তারপর আমি ভজন-কীর্তন এসব গাইতে লাগলাম প্রাণভরে। প্রায় অশ্রুত একটি ঝুমঝুম আওয়াজ শুনতে পেতাম হামেশাই। আমার আবেগ বেড়ে উঠত।
বাবা মস্ত মস্ত মাছ কিনতেন। একটা বিরাট মাছ এসেছে বাজার থেকে, মাথাটি প্রকাণ্ড! ঠাকুমা আক্ষেপ করে বলছেন যে, বাবা যদি বুদ্ধি করে একটি লাউ কিনে আনতেন তাহলে মাছের মুড়ো দিয়ে জম্পেশ একখানি ঘণ্ট হত। কিছুক্ষণ পরে বোন তার সমান একখানা লাউ বারান্দা থেকে নিয়ে এল। সে ছিল বেজায় পালোয়ান! মা বলল, নবদ্বীপ বোধহয় বারান্দায় রেখে গেছে। নবদ্বীপ ছিল বাবার পিওন। সে অবশ্য নিজেকে ‘লবদ্দিব’ বলত। একটু বাদে নবদ্বীপ কিছু একটা দিতে এলে ওকে লাউয়ের কথা বলায় আকাশ থেকে পড়ল! বাবা দুপুরে খেতে এসে আয়েশ করে লাউঘণ্ট খেলেন। কিন্তু কেউ-ই বুঝতে পারল না কে ওটা দিয়ে গেছে।
দাদুর ঘড়িটা পাওয়া যাচ্ছে না। সবার ধারণা– ভোলাই ওটা নিয়েছে। সে বয়সে কিশোর, কিন্তু মহা পাকা! কিন্তু না দেখে তো কাউকে কিছু বলা যায় না, ফলে ভোলাকে বলা যাচ্ছে না কিছুই! তৃতীয় দিনের মাথায় সে ঘড়িটা দাদুকে দিয়ে বলল, ও এটা কাঠবাড়ির তলা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে। তার চোখগুলোতে কেমন ভয়-ভয় ভাব আর কান দুটো বেজায় লাল, কেউ খুব জোরে কান পেঁচিয়ে দিলে যেমনটি হয়, সেরকম। সেইদিন ও অন্যদিনের মতো একটিও জ্ঞানগর্ভ কথা না বলে চুপচাপ কাজ করল, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! তবে ও একটু বাদে বাদেই এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজতে লাগল। পরদিন থেকে সে আর কাজে এল না। গেঁন্দাদা খবর নিয়ে এল যে, ও গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, কবে আসবে ঠিক নেই। গেঁন্দাদাকেও ও কাজ ছেড়ে দিতে বলেছে, কারণ এ বাড়িতে একজন কেউ আছে যাকে দেখা যায় না, কারওর কোনও শখের জিনিসে হাত দিলেই সে এসে কান মুলে দেয়। আমরা একথা শুনে ভারি অবাক হয়ে গেলাম!
বাবা একদিন একটা নতুন খাট বানিয়ে নিয়ে এলেন। পুরোনো খাটটির ঠাঁই হল একটি পরিত্যক্ত ঘরে। সেখানে নানা পুরনো জিনিস জমানো ছিল, সেগুলো আমাদের নয়। সেদিন রাতে বেজায় শব্দ হতে লাগল, খাট-আলমারি টানাটানি করলে যেমন শব্দ হয় তেমনটা। কোথা থেকে হচ্ছে কেউ টের পেল না, কিন্তু কেউই ঘুমতে পারল না! তার পরদিন কাজেকম্মে সকলে ভুলেই গেল। কিন্তু রাত্তিরে আবার সেই শব্দ। আজ মনে হল যেন ওই বন্ধ ঘরের দিক থেকেই আসছে। ঘুম এলেই ওই শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।
পরদিন সকালে বাবা খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। দাদু আরও গম্ভীরভাবে বললেন, নতুন খাট সরিয়ে পুরনো খাটটি পেতে দাও। যার বাড়ি, সে এসব সইবে কেন! বাবা লোক-লশকর ডেকে তাই করলেন। আশ্চর্য! রাতে আর কোনও শব্দ হল না। কিন্তু সেইদিন থেকে আমাদের ভারি গা ছমছম করতে লাগল। ঘরে অনেক আলো জ্বালিয়েও মনে হল আলোটা যেন কম-কম। সব দরজা-জানলা বন্ধ, অথচ কোথা থেকে যেন কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল। সামনের দরজাটা বিনা হাওয়াতে কেঁপে উঠে শব্দ করতে লাগল। আমরা কেউই কাউকে কিছু বললাম না, কিন্তু সবাই একটা ঘরেই জোট পাকিয়ে বসে থাকলাম।
তার পরদিন বাবা অনেক সকালে সকলকে ডেকে তুললেন। বললেন, তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না সেরে সকলে খেয়ে নাও। গুছিয়ে নাও। আজই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। গতকাল আমি আমার কোয়ার্টার্স পরিষ্কার করিয়েছিলাম, সিংজি চলে গেছেন। শুনে আমাদের কিন্তু মন খারাপ হল, বাড়িটাও নিমেষে মুষড়ে পড়ে কেমন ছিরিছাঁদহীন হয়ে পড়ল। বাবা আগের দিনই জেনেছিলেন, এ বাড়িতে যারা থাকতে আসে অপঘাতে মারা পড়ে। লোকে বলে, বাড়ির গিন্নি বাড়িটার মায়া কাটাতে পারেনি, ওই বাড়িতেই থাকে।
আমার কিন্তু সংগীতরসিক আমুদে ওই ভূত দিদুনের কথা খুব মনে পড়ে।