কপিলবস্তুর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রোহিনী নদী। নদীর অন্য পারে কোলিক নগর। সে বছর বৃষ্টি-বাদল বড় কম। বাঁধে যা জল রয়েছে, তা দুই নগরের চাষের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই এপার-ওপার সবারই মাথায় হাত। কোলিকবাসী কয়েকজন মাতব্বর বললে, ‘আর একটিবার সেচ দিলেই আমাদের শষ্য পেকে উঠবে, সুতরাং বাঁধের সব জল আমরা ব্যবহার করব।’
কপিলবস্তুবাসীরা বললে, ‘আবদার মন্দ নয়! তোমরা গোলা ভরা ফসল নিয়ে আয়েশ করবে আর আমরা বুঝি ধামা হাতে তোমাদের দোরে দোরে ঘুরব? ওটি হচ্ছে না, আমাদেরও জল চাই!’
–আমরা দেব না।
–আমরাও দেব না!
এরা ওদের পূর্বপুরুষ তুলে গালি দিল। ওরা এদের বোনেদের নামে নোংরা কথা বলল। এরা লাঠি হাতে তেড়ে গেল। দেখা গেল, ওদের হাতেও অস্ত্র তৈরি। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড!
ওদিকে অল্পবর্ষণের দাবদাহে রোহিনীর দু’-পারেই শষ্যের খেত নিরুপায় পুড়তে থাকল।
হঠাৎ এক ভোরে শ্রাবস্তী থেকে বুদ্ধদেব কয়েকজন অনুগামী-সহ সেখানে এসে উপস্থিত। তাঁকে বাঁধের ওপর দেখে যুযুধান দুই পক্ষই অপ্রতিভ হল।
–প্রভু, আপনি?
–তোমাদের এক গল্প শোনাতে এলাম। স্পন্দনের গল্প।
–স্পন্দন মানে পলাশ গাছ। পলাশ গাছের গল্প?
সামান্য ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বুদ্ধ বলতে শুরু করলেন, হিমালয়ের হিমবন্ত অঞ্চলে এক অরণ্য। সেখানে পলাশ গাছ একটিই। বহু প্রাচীন, বিশাল বৃক্ষ। তার তলায় বিশ্রাম করছিল কৃষ্ণবর্ণের এক দশাসই সিংহ। প্রায়শই যেমন করে।
–সিংহের রং কালো?
–সেই বৈশিষ্ট্যের জন্যই সে বনের রাজা। শিকার করে এসে তৃপ্ত মুখে পলাশের তলায় সে জিরোচ্ছে। এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের মাঝে সামান্য মতান্তর, অপরিণামদর্শী রোষ কেমন উভয়কেই ধ্বংস করে শোনো।
নগরবাসীরা বুঝেই ছিল, গল্প শোনানোর ভনিতায় শান্তির শিক্ষা দিতে বুদ্ধ এসেছেন তাদের কাছে। তারা আরও উদগ্রীব হল। বুদ্ধ বলে চলেন, “ঘটনা সামান্য– অকস্মাৎ এলোমেলো ঝড় উঠল। পলাশ গাছের এক বড় শুকনো ডাল ভেঙে পড়ল। পড়ল একেবারে সিংহের ঘাড়ে। আহত সিংহ বলল, ‘ওরে হতচ্ছাড়া গাছ, তুই বুঝি আমায় খুন করতে চাস! দেখ, তোর কী সর্বনাশ করি।’ এমন অসমীচীন বিষোদ্গারের উত্তরে গাছও কিছু মন্দ কথা বলল। তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল। দু’জনেই দু’জনের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে লাগল।
একদিন একদল কাঠুরিয়া আর কাঠমিস্ত্রি বনের মধ্যে ঢুকল। রাজার রথ বানাবে তারা। সিংহ দেখল, এই সুযোগ। সে বললে, ‘কী কাঠ খুঁজছ তোমরা?’
–শাল আর খয়ের গাছের কথাই ভেবেছি। বনরাজ, তুমি তো আরও ভালো বলতে পারবে।
সিংহ একটু চুপ করে থেকে বললে, ‘হুঁউউ, কিন্তু তার চেয়েও ভালো পলাশ গাছ।’
–অ, কিন্তু এখানে পলাশ কই?
–একটিই আছে। কিন্তু যা বড়, তাতেই গোটা রথ বানানো হয়ে যাবে।
যে গাছের নীচে কথা হচ্ছিল, সেই গাছ খবরটা দিল তার চারপাশের গাছদের। তারাও খবরটা ছড়াল। কানাকানিতে খবর পৌঁছল পলাশের কাছ অবধি। সে দম বন্ধ করে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগল। তার গায়ে যখন কুঠারের প্রথম ঘা পড়ল, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলে পলাশ বলল, ‘তোমরা আমার কাঠ দিয়ে রাজরথ বানাতে চাইছ, কিন্তু তার জন্য বিশেষভাবে চাকা বানাতে হয়, জানো কী?’
–না তো!
–চাকায় কালো সিংহের গলার চামড়া জড়িয়ে দিলে তা খুব মজবুত হয়, রথ হাওয়ার বেগে দৌড়য়।
পলাশ গাছের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাঠুরে আর কাঠমিস্ত্রীদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হল।
বিষাক্ত বর্শা হাতে তারা দৌড়ল বনের গভীরে। বনরাজ আর পালাবে কোথায়?
মড়মড় করে ভেঙে পড়ার আগে পলাশ বৃক্ষ শুনতে পেল এক আকাশ ফাটানো আর্তনাদ। কালো সিংহের। যাকে সে এতদিন ছায়া দিয়ে এসেছে।”
বুদ্ধদেব থামলেন। রোহিনী নদীর দু’-পারের মানুষগুলো অধোবদন হল।