এ পর্যন্ত আফগানিস্তান ১৫৮টা ওডিআই খেলেছে, যার অধিকাংশই আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবোয়ে ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে! আর ছ’বছরে মাত্র সাতটা টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে। যার মধ্যে দুটো বাংলাদেশ, একটা করে যথাক্রমে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। বিশ্বকাপে রশিদ-গুরবাজদের এই পারফরম্যান্সের পর কি দুঁদে টেস্ট খেলিয়ে দেশগুলো আগ্রহী হবে তাদের সঙ্গে সিরিজ খেলতে?
উত্থান পর্ব: খালি পায়ে যাত্রা শুরু
‘স্যর, এই জার্সি কি নিউজার্সি? আমরা কি তাহলে আমেরিকায় যাচ্ছি?’
আফগানিস্তান কোচ তাজ মালিকের কাছে প্রশ্ন করলেন দলের এক তরুণ ক্রিকেটার। তাজ তখন কম্পিউটারে গুগল ম্যাপ খুলে দেখালেন এই ‘জার্সি’ দ্বীপটা ইংলিশ চ্যানেলের ঠিক কোথায় অবস্থিত! ২০০৮ সাল। আইসিসি ডিভিশন-৫ প্রতিযোগিতার আসর বসছে জার্সিতে। উপমহাদেশের বাইরে প্রথমবার আফগানিস্তান দল নিয়ে যাচ্ছেন তাজ। দলে রয়েছেন নাওরজ মাঙ্গাল, মহম্মদ নবি, রাইজ আহমেদজাই, করিম সাদিক, হাস্তি গুল, নবাগত গুলবাদিন নাইব-সহ অন্যরা। সেদিনকার ক্রিকেটবিশ্বে যাঁরা নিতান্তই অখ্যাত ও অপরিচিত। যুদ্ধের ট্যাঙ্ক থেকে বাঁচতে এই ক্রিকেটারদের অনেকেই দীর্ঘদিন দেশছাড়া। পাকিস্তানের পেশওয়ারের রিফিউজি ক্যাম্পে কেটেছে যাঁদের শৈশব। এবং প্রতিবেশী দেশে বড় হয়ে ওঠার সেই কঠিন দিনগুলোয়, ক্রিকেট তাঁদের জুগিয়েছে প্রাণের স্পন্দন।
আরও একটু পিছনে ফিরে যাওয়া যাক। রাইজ আহমেদজাই, নাওরজ মাঙ্গালরা তখন নেহাতই বালক। অস্ট্রেলিয়া থেকে ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ জিতে ফিরল পাকিস্তান ক্রিকেট দল। ওয়াসিম আক্রাম-ইনজামাম উল হকদের নিয়ে উৎসব চলছে পাকিস্তান জুড়ে। বিশ্বজয়ীরা পাচ্ছেন মহানায়কের মর্যাদা। মহল্লায়-মহল্লায় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলার চল। রাইজ আহমেদজাই বলেন, ‘বিষয়টা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আমরাও রাস্তায়, ৪৫ ডিগ্রি গরমে খালি পায়ে, সামান্য উপকরণ নিয়ে মেতে উঠি ক্রিকেটে! তখন ভাবতেও পারিনি, এই ক্রিকেটের জন্যই আমরা একদিন দেশে ফিরতে পারব!’
পেশওয়ারের খুরাসানের রিফিউজি ক্যাম্পের সেই কিশোরদের নিয়েই পরে প্রথম আফগান ক্রিকেট দল তৈরি করলেন কোচ তাজ মালিক। কিন্তু আফগানিস্তানে যুদ্ধের অবসান নেই। যুদ্ধের পর গৃহযুদ্ধ, তালিবান শাসন, তারপর আবার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপরই, নাওরজ মাঙ্গালের মতো দাদাদের বিদেশের মাটিতে জিততে দেখে, ব্যাট-বল নিয়ে আনন্দে মাততে শুরু করল ছোট ছোট ছেলেরা। ক্রিকেটের নেশা ভুলিয়ে দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তের প্রাণ সংশয়।
সামান্য রসদ নিয়ে দূরদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তাজ; দলের প্রায় সব সদস্যই প্রথমবার ইউরোপের মাটিতে পা রাখলেন। কিন্তু জার্সিতে একের পর এক বাধা টপকে ফাইনালে উঠল আফগানিস্তান। পঞ্চম বিভাগের ফাইনালে আয়োজক দেশ জার্সির মুখোমুখি। মাত্র ৮০ রান তাড়া করতে জার্সির শক্তিশালী বোলিং-এর সামনে চাপে পড়ে যান আফগানরা। বোলার হাস্তি গুল ব্যাট হাতে সেদিন ত্রাতা হয়ে ওঠেন, তাঁর অপরাজিত ৩১ রান আফগানদের প্রথম আইসিসি ট্রফির স্বাদ দেয়। মাঠে আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে করমর্দন করে তাদের হাতে ট্রফি তুলে দেন জিওফ্রে বয়কট। ক্রিকেট-আফগানিস্তানের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন: চতুর্থ বিভাগে খেলার ছাড়পত্র আদায় করে দেশে ফিরলেন তাজরা। আফগানিস্তান জুড়ে তখন নাওরজ-হাস্তিদের নিয়ে আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করেছে। আফগান সরকারও নড়েচড়ে বসে; বোর্ড কর্তারা তড়িঘড়ি প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার কবির খানকে কোচ নিয়োগ করেন। এবার লক্ষ্য আফ্রিকার তানজানিয়া, যেখানে বসবে চতুর্থ বিভাগের আসর। মাঝখানে সময় মাত্র পাঁচমাস।
তখন আফগানিস্তানে ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা কল্পনা করা যেত না, ছিল না অ্যাকাডেমি বলে কোনও বস্তু। বোর্ড অফিস-সহ কাবুলে একটা ক্রিকেট মাঠের নির্মাণকাজ সবে শুরু হয়েছে। যে দেশের ক্রিকেটারদের ভিটেমাটি ছেড়ে পরবাসী হতে হয়, সেদেশে ঘরোয়া ক্রিকেট হবে কী করে? যে দেশের কিশোর-কিশোরীরা জন্ম থেকে প্রত্যক্ষ করেছে বিদেশি সেনার টহলদারি বা গৃহযুদ্ধ, প্রতি মুহূর্তে যাদের সঙ্গী ল্যান্ডমাইনে পা পড়া বা আত্মঘাতী বোমা-বিস্ফোরণের ভয়, তাঁদের কাছে ক্রিকেট খেলাটাই তো একটা স্বপ্ন! যেখানে মানবাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতার অস্তিত্বই নেই, সেখানে ক্রিকেটের মতো সারাদিনব্যাপী একটা খেলার সুযোগ। তাই হয়তো, বিদেশের মাটিতে আফগান দল জিতলে, তা দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আফগানদের এক সূত্রে বেঁধে ফেলতে শুরু করল।
এই পরিস্থিতিতে কবির খানের অধীনে আফ্রিকা রওনা হলেন নবি-সাদিক-গুলরা। তাজ মালিককে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে কিঞ্চিৎ চাপানউতরোও হল আফগান শিবিরে। টেস্ট অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কবির দলকে আধুনিক ক্রিকেটের টেকনিকে রপ্ত করাতে শুরু করলেন। আফ্রিকায় উগান্ডা-হংকং-এর মতো আইসিসি ক্রমতালিকায় ওপরে থাকা দলগুলোকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন আফগানিস্তান। একলাফে ডিভিশন-৩-এ। যার আসর বসবে আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেস শহরে! রিফিউজি ক্যাম্প ছেড়ে যাঁরা অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না, ক্রিকেটের সৌজন্যে তাঁদের সামনে খুলে যাচ্ছে একের পর এক মহাদেশের দরজা! ২০১১-র বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন তখন নাওরজ মাঙ্গালদের চোখে-মুখে, ছাড়পত্র পেতে গেলে পেরতে হবে আরও দুটো ধাপ। কিন্তু আর্জেন্টিনায় জিতলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় মূল কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলায় স্বপ্নভঙ্গ হল আফগানদের। ওই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন টিম আয়ারল্যান্ডকে প্রথম ম্যাচে হারিয়েও শেষ রক্ষা হল না। কানাডার কাছে হেরে ছিটকে গেলেন মহম্মদ নবি-করিম সাদিকরা। তবে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে পঞ্চম স্থান অধিকার করলেন তাঁরা, আর আদায় করে নিলেন আগামী চার বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ছাড়পত্র। কিন্তু আইসিসি অ্যাফিলিয়েট সদস্য হওয়ায়, টেস্ট খেলিয়ে দেশের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাওয়া সম্ভব ছিল না আফগানদের। একদিনের আন্তর্জাতিক বলতে স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, বড়জোর জিম্বাবোয়ের সঙ্গে ম্যাচ। কিন্তু প্রথা ভেঙে আফগানিস্তানই প্রথম অ্যাফিলিয়েট সদস্য, যারা টেস্ট খেলিয়ে দেশের সঙ্গে ওডিআই খেলে; আমিরশাহি সফরে মিসবা-উল-হকের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০১২-র ফেব্রুয়ারিতে একমাত্র ম্যাচ।
২০১০-এ এসে গেল আরও একটা সুযোগ। টি-২০ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের আসর বসল সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। প্রথমবারেই বাজিমাত আফগানিস্তানের; ফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে মূল পর্বের খেলার ছাড়পত্র পকেটে পুড়ে ফেলল আফগানরা। এতদিনে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় মঞ্চে পা রাখলেন মহম্মদ নবি-আসঘর স্ট্যানিকজাইরা। আফগানিস্তানেও ততদিনে ক্রিকেট নিয়ে প্রবল উৎসাহ তৈরি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে, কংক্রিটের পিচে ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়ছে কিশোররা। দেশের মধ্যেই নতুন প্রতিভার সন্ধানে নেমেছে আফগান ক্রিকেট বোর্ড। ২০১৩-এ আইসিসি অ্যাসোসিয়েট সদস্য হল আফগানিস্তান। তারপর অস্ট্রেলিয়ায়-নিউজিল্যান্ডে ২০১৫-এ প্রথম বিশ্বকাপ খেলা– স্বপ্ন সফল হল নবি-আহমেদজাইদের। ১৯৯২-এর পাকিস্তানের বিশ্বজয়ের কথা ভুলতে পারেননি প্রথম প্রজন্মের আফগান ক্রিকেটাররা; তাই ইনজামাম উল হককে কোচ নিয়োগ করে জিম্বাবোয়েতে প্রথম পূর্ণ সফরে যায় আফগানিস্তান। ওডিআই ও ট-২০– দুটো সিরিজই জিতে ফেরে ইনজামামের দল। পাক সেনা-শাসকদের সঙ্গে যত সমস্যাই থাক আফগানিস্তানের, আফগান ক্রিকেটের প্রতি বরাবর সহমর্মিতা দেখিয়েছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন তারারা। একসময় মহম্মদ নবিকে তুলে এনেছিল প্রাক্তন পাক অফস্পিনার আর্শাদ খানের অ্যাকাডেমি। পরে ইনজামামের কোচিং-এই ২০১৬ ভারতে টি-২০ বিশ্বকাপে সুপার-টেনে উঠল দল। দেশে তখন কাবুল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি পুরোদমে চালু হয়ে গিয়েছে। রশিদ খান, রহমনুল্লা গুরবাজদের স্পট করে তৈরি করা হচ্ছে আফগান ক্রিকেটের পরের প্রজন্মকে। এরই মধ্যে ২০১৭-এ টেস্ট খেলার স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন আসঘর আফগান-গুলবাদিন নাইবরা; ডিভিশন-৫-এ শুরু করে দশ বছরের মধ্যে আইসিসি-র পূর্ণ সদস্য!
ঈর্ষণীয় সাফল্যের পরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে
দিল্লি মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে কালো-লাল-সবুজ আফগান পতাকা হাতে ছুটছেন একদল তরুণ; সবাই মিলে গাইছেন গান। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ফিরোজ শাহ কোটলায় ধরাশায়ী করেছে আফগানিস্তান। দুরন্ত জয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে তাঁদের ছোটবেলার বন্ধু রহমনুল্লাহ গুরবাজের ব্যাট। কয়েক দিন আগেই হেরাটে প্রবল ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছেন দু’ হাজার মানুষ; গৃহহীন আরও কয়েক হাজার। ২০২২ থেকে এই নিয়ে দশবার ভূমিকম্প হল আফগানিস্তানে। হেরাটের ছবি মোবাইল-স্ক্রিনে বারবার দেখে গুরবাজ তাদের কথা দিয়েছিলেন, সেঞ্চুরি করে পীড়িত দেশবাসীর ক্ষতে প্রলেপ দিতে চান। বন্ধু কথা রাখতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু তার ৫৭ বলে ৮০ রানের এই ইনিংস সহজে ভুলতে পারবেন না কোনও আফগানিস্তান সমর্থক! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবার জয়; এবার বাঁধভাঙা উৎসবে মেতে উঠলেন আফগানরা; কাবুলে আতসবাজির ফাটল নির্বিচারে। কিছুদিন আগেই কয়েক লক্ষ আফগান উদ্বাস্তুকে পাক সীমান্তের বাইরে বের করে দিয়েছে পাক-সেনা! পাক রিফিউজি ক্যাম্প থেকে তালিবান শাসকের রক্তচক্ষু, বিদেশি যুদ্ধবিমান থেকে ভূমিকম্প, এই ক্রিকেট শুরু থেকেই আফগানদের জীবনসংগ্রামের প্রতীক। জন্মলগ্ন থেকে দলের সদস্য মহম্মদ নবি থেকে তরুণ প্রজন্মের গুরবাজ, ক্রিকেটমাঠে আক্রান্ত জাতির মহাকাব্যই রচনা করে চলেছেন। আফগান বোর্ড-নির্মিত এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে গুরবাজ জানিয়েছেন, তাদের খোস্ত অঞ্চলে নাওরজ মাঙ্গালদের নায়কের মর্যাদা পেতে দেখে কীভাবে তিনি ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হন। ও কীভাবে ক্রিকেটের সরঞ্জাম কেনার জন্য তাদেরই গৃহনির্মাণের কাজে নিযুক্ত এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করতেন তিনি। ইশকুল পালিয়ে, পরিবারের সদস্যদের লুকিয়ে ক্রিকেটের স্বপ্নকে তাড়া করে গিয়েছেন এই আফগান তরুণ। এই বিশ্বকাপের সমস্ত ম্যাচ-ফি ভূমিকম্প আক্রান্তদের তহবিলে দিয়ে দিয়েছেন রশিদ খান। দেশপ্রেম মানে কি ভিত্তিহীন যুদ্ধ-উন্মাদনা আর সমাজমাধ্যমের আস্ফালন? মাঠ ও গ্যালারিতে যে কালো-লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে, তা বিধ্বস্ত জাতির অস্তিত্বের লড়াইয়ের সাক্ষ্য দেয়: যে পতাকা তালিবান সরকারের অনুমোদিত নয়! ৯/১১-এর ঘটনা বদলে দিয়েছিল আফগানিস্তান-ইতিহাসের ছায়াপথ; বদলে গিয়েছিল আম-আফগান যুবক সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা। রবিঠাকুর বর্ণিত কলকাতার রাস্তায় আখরোট-পেস্তাবাদাম ফেরি করা কাবুলিওয়ালা তেজারতির কারবারি, কিন্তু হৃদয়বান। ৯/১১-র পর সেই কাবুলিওয়ালাই বনে যান ‘সন্ত্রাসবাদী’! মাঠে ও মাঠের বাইরে রহমনুল্লা গুরবাজ-রশিদ খানদের আবেদন গত ২০ বছর ধরে গড়ে ওঠা সেই মিথ ভেঙে দিয়ে, এক নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করছে– আফগান যুবক মানে ধ্রুপদী ক্রিকেট ও সংবেদনশীল মনের সমন্বয়!
সরকারি টেস্ট খেলার স্বীকৃতি পাওয়ার পর গত ছ’বছরে আফগানরা বারবার সংবাদ-শিরোনাম দখল করেছেন। কখনও টিম হিসেবে, কখনও বা রশিদ খানদের মতো তারার ব্যক্তিগত নজিরের জোরে। আইপিএলের মতো বড় লিগগুলো ছুটছে আফগান ক্রিকেটারদের পিছনে। যেখানে নিয়মিত খেলা রশিদ-গুরবাজ-মুজিব-উর রহমানদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও ধারালো করে তুলেছে। ২০১৮-র আইসিসি কোয়ালিফায়ার ট্রফিতে ক্রিস গেল-সহ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দু’বার হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আফগানিস্তান ১৯-এ দশ দলের বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। মাত্র ৪৪ ম্যাচে ১০০ উইকেট নিয়ে একদিনের ক্রিকেটে রেকর্ড করেন লেগস্পিনার রশিদ খান। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অনভিজ্ঞতার জন্য কোনও ম্যাচ জিততে না পারলেও, রশিদ-মুজিব-উর-নবিদের নিয়ে গড়া স্পিন আক্রমণ বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ে।
২০২১ তালিবানরা ক্ষমতায় ফেরায়, নিজেদের দেশে যথাযথ প্রস্তুতি আর সম্ভব ছিল না। দমে না গিয়ে কখনও ভারতের দেহরাদুন আর কখনও আমিরশাহিকে বেস করে, ইংরেজ কোচ জোনাথন ট্রটের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতি চালিয়ে যায় ক্রিকেট-আফগানিস্তান। ট্রটের সম্বল একঝাঁক উঠতি ক্রিকেটার। প্রাক্তন ক্রিকেটার আহমেদজাই এখন ব্যাটিং-কোচ। আফগানিস্তান ঘুরে আহমেদজাই-মাঙগালরা আবিষ্কার করেছেন নূর আহমেদের মতো একাধিক তরুণ প্রতিভাকে। পরে দলের সঙ্গে মেন্টর হিসেবে যুক্ত হন অজয় জাদেজা। কিন্তু তালিবানরা ক্ষমতায় এসে হামিদ শিনওয়ানিকে সরিয়ে নিজেদের লোক নাসেবুল্লা হাক্কানিকে ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর করায়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে। অস্ট্রেলিয়া জানুয়ারিতে আমিরশাহিতে আফগান সফর বাতিল করে! বহু দেশ আফগান ক্রিকেটারদের ভিসা দিতেও অস্বীকার করে। দেশের মহিলা-ক্রিকেট নিষিদ্ধ, মহিলা-ক্রিকেটাররা প্রায় সবাই দেশছাড়া। এই পরিস্থিতিতেও, শ্রীলঙ্কা-ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলতে হলেও, আফগানিস্তান ২০২৩-এর বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার ছাড়পত্র পায়! এবং ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা– তিনটে প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে ইব্রাহিম জাদরান-মুজিব-উর-রহমানরা বুঝিয়ে দিলেন, বড় টিমগুলোর থেকে আর তারা মানসিক ভাবে পিছিয়ে নেই। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের রূপকথার ইনিংস এবারের মতো হাশমাতুল্লা শাহিদিদের দৌড় থামিয়ে দেয়। কিন্তু আগামী দিনে কোথায় গিয়ে থামবে আফগানিস্তান?
রাইজ আহমেদজাই আশাবাদী। তবে বারবার শোনালেন, অন্যান্য টেস্ট খেলিয়ে বড় টিমগুলোর সঙ্গে নিয়মিত না খেলতে পারার আক্ষেপ। ‘ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমরা তিনবার খেলেছি, পরপর তিনটে বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও তাই। ভারতের সঙ্গে খেলেছি এ পর্যন্ত মাত্র চারটে ম্যাচ! মাঝখানের সময়ে এই দলগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকটা ম্যাচ খেললে আমরা আরও উন্নতি করব।’ প্রথম দিন থেকে আফগান ক্রিকেটের সঙ্গে থাকা আহমেদজাইর পর্যবেক্ষণ নিখুঁত। এ পর্যন্ত আফগানিস্তান ১৫৮টা ওডিআই খেলেছে, যার অধিকাংশই আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবোয়ে ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে! আর ছ’বছরে মাত্র সাতটা টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে। যার মধ্যে দুটো বাংলাদেশ, একটা করে যথাক্রমে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। বিশ্বকাপে রশিদ-গুরবাজদের এই পারফরম্যান্সের পর কি দুঁদে টেস্ট খেলিয়ে দেশগুলো আগ্রহী হবে তাদের সঙ্গে সিরিজ খেলতে?
আফগান ক্রিকেটের সঙ্গে বোলিং কোচ হিসেবে কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন প্রাক্তন পাক-ক্রিকেটার উমর গুল। গুল মনে করেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যার অভাবে ভুগতে হতে পারে আফগানিস্তানকে। ‘পর্যাপ্ত ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো না থাকলে এই সাফল্য ধরে রাখা কঠিন। ঘরোয়া ক্রিকেটই যে কোনও দেশের সাপ্লাই লাইন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদেরও ফিট রাখে ঘরোয়া ক্রিকেট।’ এর সঙ্গে গুল মনে করিয়ে দেন, ‘তবে আইসিসি-র উচিত আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোর জন্য ম্যাচ ফি ও আর্থিক-বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। যাতে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে জুনিয়র দল, যথাযথ পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে তারা।’ আফগান অনূর্ধ্ব-১৯ দল যে কোনও প্রতিযোগিতায় এক বড় চমক, এই বিশ্বকাপ দলের ইব্রাহিম জাদরান-মুজিব উর রহমান-নূর আহমেদ সহ অনেকেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফসল। ঘরোয়া ক্রিকেটে চারদিনের একটা প্রতিযোগিতা শুরু করেছে বোর্ড, তবে তাতে বর্তমান দল সংখ্যা মাত্র চার! এছাড়া রয়েছে টি-২০ স্ফাগিজা লিগ, যাও মাত্র ছ’দলীয় প্রতিযোগিতা। ৫০ ওভারের নতুন আটদলীয় প্রতিযোগিতাও চালু করেছে আফগান বোর্ড। তবে গুল, আহমেদজাই-সহ বহু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য যথেষ্ট নয়।
আরও একটা সমস্যা আফগান ক্রিকেটের চিরসঙ্গী। তা হল ক্রিকেটমাঠ ও ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা। ক্রমশ বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তার জন্য ক্রিকেট মাঠকেও টার্গেট করেছে সন্ত্রাসবাদীরা। কাবুলে একটা ঘরোয়া ম্যাচে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে তিনজন মারা যান। যদিও পরের দিনও খেলা হয়, ভীতি উপেক্ষা করে মাঠে আসেন বহু দর্শক। তবে কোনও বিদেশি দল বা প্লেয়ারদের খেলানোর উপযোগী পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি আফগানিস্তানে। একসময় তালিবানদের হুমকিতে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল ফুটবল স্টেডিয়াম। সাফ ফুটবলে ভারতকে হারিয়ে আফগানরা তখন চ্যাম্পিয়ন, ভারতের আই-লিগ সহ অন্যান্য দেশে চুটিয়ে খেলছেন বহু আফগান ফুটবলার। কিন্তু অচিরেই আফগানিস্তান ফুটবল দল হারিয়ে যায়। প্রবল জনপ্রিয়তার জন্য পুরুষ-ক্রিকেট দল নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনওরকম বিরূপ মনোভাব তালিবান শাসকরা না করলেও, রশিদ খান-ইব্রাহিম জাদরানরা তাই জানেন না কবে তাঁরা দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারবেন। বা আদৌ কোনও দিন পারবেন কি না? আফগান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েও তাই আশার সঙ্গে থেকে যাচ্ছে একরাশ আশঙ্কাও! এই আশঙ্কার কালো মেঘের মধ্যে আলোক-রশ্মির মতো ইব্রাহমিম জাদরানের নিখুঁত টেকনিক, গুরবাজের স্ট্রোক প্লে, রশিদ-মুজিব-উরদের দুরন্ত ঘূর্ণি-বোলিং, যা অসংখ্য আফগান কিশোর-কিশোরীকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। সমগ্র বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা চাইবেন না যে নবি-রশিদ-গুরবাজদের সোনালি প্রজন্মের পরই হারিয়ে যাক আফগানিস্তান।