রবিবাসরীয় রাত। নিউ ইয়র্কে যখন রক্তচাপ বাড়িয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ের মঞ্জীল স্পর্শ করছে টিম ইন্ডিয়া, তখন কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরে প্যারিসে নিজের নতুন টেনিস সম্রাটকে বেছে নিল লাল সুরকির রোলাঁ গারোঁ। বলা ভালো, এক টেনিস রাজপুত্রের রাজসিংহাসন লাভ হল ফিলিপ শাঁতিয়ের কোর্টে। যাঁর নাম– কার্লোস আলকারাজ।
বাঙালির একটা শারদোৎসব আছে। আর আছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেটাও দুর্গোৎসবের মতোই একটা কার্নিভাল। তিথি-নক্ষত্র মেনে মহাষষ্ঠীতে যেমন দেবীর বোধন হয়, তেমনই ক্রিকেট বিশ্বকাপেরও শুভ মহরৎ আছে। ক্রিকেট-জনতা সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ নামে চেনে। টুর্নামেন্টের সূচনা কাদের মধ্যে হল সেটা ‘এহো বাহ্য’। আসল হল, দুই প্রতিবেশী দেশের ২২ গজে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেটাই মহাযজ্ঞের দামামা বাজিয়ে দেয়। মনে হয়, আগে যা হয়েছে, সেসব ট্রেলার। বিশ্বকাপ তো এই শুরু হল। পিকচার আভি বাকি হ্যায়। তারপর যত সময় গড়ায় ক্রিকেট রোমান্সে বুঁদ হয়ে যায় জনতা। বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়। আশপাশে আর কী হচ্ছে, তা নিয়ে আগ্রহ থাকে না। এই যেমন ফরাসি ওপেন।
ভরা জ্যৈষ্ঠে কাঁঠালপাকা গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্রিকেট-উত্তাপ। সন্ধে নামতেই টিভির পর্দায় টেলি-সিরিয়াল নয়, ভেসে উঠছেন রোহিত শর্মারা। একে বিশ্বকাপ, তায় টি-টোয়েন্টি! অঘটন ওত পেতে থাকে। নরম সোফায় থিতু হয়ে বসতে না বসতেই পাকিস্তানকে কুপোকাত করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাতের কালঘুম ছুটিয়ে কিউয়ি-শিকার করে বসেন রশিদ খানরা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইন্দ্রজাল এমনই। সেই গমগমে ক্রিকেট-দামামার মধ্যে প্রায় নিঃশব্দে ফুরিয়ে গেল ফরাসি ওপেন।
রবিবাসরীয় রাত। নিউ ইয়র্কে যখন রক্তচাপ বাড়িয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ের মঞ্জিল স্পর্শ করছে টিম ইন্ডিয়া, তখন কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরে প্যারিসে নিজের নতুন টেনিস সম্রাটকে বেছে নিল লাল সুরকির রোলাঁ গারোঁ। বলা ভালো, এক টেনিস রাজপুত্রের রাজসিংহাসন লাভ হল ফিলিপ শাঁতিয়ের কোর্টে। যাঁর নাম– কার্লোস আলকারাজ।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুদ্ধশ্বাস জয়ের পর যখন উল্লাসে মাতোয়ারা নিউ ইয়র্কের নাসা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নীল গ্যালারি। উচ্ছ্বাসে গা ভাসাচ্ছেন বিরাট, বুমরারা, তখন ২২ গজের আরেক ধারে তৈরি হয়েছিল ভিন্ন দৃশ্যপট। চোখের জলের মাঠ ছাড়ছিলেন পাকিস্তানের নাসিম শাহ। শোকের অশ্রু। রবিবার রোলাঁ গারোঁয় ফরাসি ওপেনের পর আলকারাজও ভেসে গিয়েছিলেন চোখের জলে। সেই অশ্রুতে কোনও শোক ছিল না, ছিল যুদ্ধ জয়ের, সাফল্য অর্জনের আনন্দ। ২০২২-এ ইউএস ওপেনের পর গতবছর উইম্বলডন জয়। এবার ফরাসি ওপেন। সর্বকনিষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার হিসেবে হার্ড-গ্রাস-ক্লে– তিন ফরম্যাটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের নজির গড়ে ফেলেছেন বছর একুশের স্প্যানিশ তারকা। তবে এবারের ফরাসি ওপেন শুধু সাফল্য আর মর্যাদার মানদণ্ডেই নয়, আলকারাজকে দিয়ে গেল আত্মপ্রতিষ্ঠার বেদীমঞ্চ।
………………………………………………………..
চোখের জলের মাঠ ছাড়ছিলেন পাকিস্তানের নাসিম শাহ। শোকের অশ্রু। রবিবার রোলাঁ গারোঁয় ফরাসি ওপেনের পর আলকারাজও ভেসে গিয়েছিলেন চোখের জলে। সেই অশ্রুতে কোনও শোক ছিল না, ছিল যুদ্ধ জয়ের, সাফল্য অর্জনের আনন্দ। ২০২২-এ ইউএস ওপেনের পর গতবছর উইম্বলডন জয়। এবার ফরাসি ওপেন। সর্বকনিষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার হিসেবে হার্ড-গ্রাস-ক্লে– তিন ফরম্যাটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের নজির গড়ে ফেলেছেন বছর একুশের স্প্যানিশ তারকা।
………………………………………………………..
এমন একটা সময় কেরিয়ারের তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন স্প্যানিশ তরুণ, যখন অস্তিত্ব রক্ষার্থে তা একান্ত প্রয়োজন ছিল তাঁর। অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন অমূলক নয়। বছরের শুরু থেকে চোট-আঘাত সমস্যায় জেরবার হতে হয়েছে আলকারাজকে। চোট ছন্দপতন ঘটিয়েছে ফর্মে। ফাইনালে চার নম্বর আলেকজান্ডার জেরেভের বিরুদ্ধে নামার আগেও তিনি ট্রফি জয়ে ফেভারিট– একথা বুক ঠুকে বলতে পারেননি আলকারাজের অতিবড় টেনিসভক্ত। সেই প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে মনের জোরেই ক্লে কোর্টের রাজমুকুট ছিনিয়ে নিলেন আলকারাজ। সেমিফাইনালের মতো ফাইনালটাও জিতলেন পাঁচ সেটের ম্যারাথন লড়াইয়ে, প্রতিপক্ষের নিশ্চিত গ্রাস থেকে। ট্রফি-যুদ্ধে দু’কদম এগিয়ে গিয়েও অসহায়ের মতো হারটা মেনে নিতে হল জেরেভকে। ঠিক একই সময়ে যখন পাকিস্তানের সহজ জয়ের অঙ্ক কঠিন করে সাফল্যের রাজপথ নির্মাণ করছিলেন বুমরা-হার্দিকরা, তখন সোশাল মিডিয়ায় ভেসে উঠছিল নেটিজেনদের আত্মকলরব– ‘রিমেমবার, হোপ ইজ এ গুড থিংস, মে বি দ্য বেস্ট অফ থিংস, অ্যান্ড নো গুড থিংস এভার ডাইস।’ যার নিহিতার্থ অনেকটাই বাংলা প্রবাদ ‘যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ’ মার্কা। সেই আশার প্রদীপকে জিইরে রেখে কীভাবে বাবর আজমদের জয়ের গ্রাস কেড়ে নিতে হয়, বুঝিয়ে দিয়েছেন জসপ্রীত বুমরারা। ভিন্ন মঞ্চ, ভিন্ন দেশ ও পরিস্থিতিতে, একক সংগ্রামে তা বোঝালেন আলকারাজও। আসলে ‘প্রত্যাবর্তন’ শব্দটা অনেক আগেই অস্থিমজ্জায় ঢুকে গিয়েছে স্প্যানিশ তারকার। অতীতে ইউএস ওপেনে ক্যাসপার রুড কিংবা উইম্বলডনে মহারথী জকোভিচও জেরেভের মতো এই অসহায়ত্বের শিকার হয়েছেন। ফলত, রবিবাসরীয় ফিলিপ শাঁতিয়ের কোর্টে যত দীর্ঘায়িত হয়েছে আলকারাজের চ্যাম্পিয়ন ভাগ্য, তত থিতিয়ে পড়া প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়েছে নতুন করে– কার্লোসই কি তাহলে রাফায়েল নাদাল নামক টেনিস কিংবদন্তির যোগ্য উত্তরসাধক?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: শতায়ু হও, হে দ্বিতীয় শ্রেণির কামরার দেবতা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে মরশুমের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে যার আভাস ছিল, ফরাসি ওপেন শেষে পালাবদলের সেই ইঙ্গিত সুপ্রতিষ্ঠিত। ফেডেরার-সূর্য আগেই অস্তমিত হয়েছে। এবারের ফরাসি ওপেনের প্রথম রাউন্ডে রোলাঁ গারোঁর বরপুত্র নাদালের বিদায় স্পষ্ট করে দিয়েছে, কেরিয়ারের দিগন্তরেখায় পৌঁছে গিয়েছেন স্প্যানিশ মায়েস্ত্রো। যবনিকা পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। চোটের কারণে রোঁলা গাঁরোয় জকোভিচ রথ থমকে যাওয়াটাও অশনিসংকেত বইকি। সেই পরিস্থিতিতে আলকারাজের মতো সর্বগুণসম্পন্ন একজনের উঠে আসা যেন নিয়তিনির্ধারিত ছিল। নাদালের উদগ্র জয়ের খিদে আলাকারাজের খেলায় আগেই দেখেছে টেনিসবিশ্ব। যেমন দেখেছে জকোভিচসুলভ ক্ষিপ্রতা। ফেডেরার নমনীয় ফোরহ্যান্ডের ঝলকও ঠিকরে বের হয়েছে আলকারাজের টেনিস রাকেট থেকে। দরকার ছিল সাফল্যের চ্ছটা। সেই দ্যুতিও উপচে পড়ছে আলকারাজের পারফরম্যান্সে।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
তবে রাফা-রজার-জোকারের শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে আলকারাজ আদৌ ঠাঁই পাবেন কি না, সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। পূর্বসূরির মতো চোট অন্তরায় না হলে আলকারাজের ট্রফি ক্যাবিনেটে যে আরও গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব শোভাবর্ধন করবে, সে আশা করাই যায়। তখন হয়তো ক্রিকেট উন্মাদনার ফাঁক গলে চর্চায় আরও একটু জায়গা করে নেবেন আলকারাজ।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved